ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে এক পাকি এনজিও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে

ঢাকায় প্রকাশ্যে জঙ্গী সংগ্রহে নেমেছে দা’ওয়াতে ইসলাম

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১১ এপ্রিল ২০১৫

ঢাকায় প্রকাশ্যে জঙ্গী সংগ্রহে নেমেছে দা’ওয়াতে ইসলাম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকায় প্রকাশ্যেই তৎপরতা চালাচ্ছে দা’ওয়াতে ইসলাম নামের উগ্র মৌলবাদী সংগঠনটি। মোহাম্মদপুরের একটি চারতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে রীতিমতো সাইনবোর্ড টাঙিয়ে চলছে কার্যক্রম। মাস দুই আগ থেকে সংগঠনটি মহিলা শাখার কার্যক্রম চালাচ্ছে। সংগঠনটির বিরুদ্ধে জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত থাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের হয়ে কর্মী সংগ্রহ করার অভিযোগ রয়েছে। দেশের ১৭ জেলায় থাকা ৭০টি বিহারী ক্যাম্প ও জামায়াত-শিবিরের প্রভাব থাকা জেলাগুলোতে প্রায় তিন বছর ধরে গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে সংগঠনটি। তবে আচমকা ঢাকায় হেড অফিস খুলে তৎপরতা চালানোর ঘটনায় রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দা’ওয়াতে ইসলামী একটি উগ্র মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিহ্নিত। জঙ্গীবাদ নিয়ে গবেষণা করা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের গবেষণা মোতাবেক দেশে জঙ্গী ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের সংখ্যা ১২৫। এর মধ্যে দা’ওয়াতে ইসলাম অন্যতম। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এনজিও সংগঠনটিকে অর্থায়ন করছে। ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবিরের প্রভাব থাকা জেলাগুলোতে আচমকা দা’ওয়াতে ইসলামের কার্যক্রম প্রকাশ পায়। কিন্তু ঢাকায় প্রকাশ্যে কোন সময়ই সংগঠনটির তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। ওই সময় গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, রাজশাহী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, যশোর, সাতক্ষীরাসহ জামায়াত-শিবিরের প্রভাব থাকা জেলাগুলো থেকে দা’ওয়াতে ইসলামের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের সদস্য। অভিযানের মুখে সংগঠনটির প্রকাশ্য তৎপরতা থেমে গেলেও গোপন তৎপরতা অব্যাহত ছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৪৫ জনই জামিনে মুক্ত হয়ে নতুন করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন তাজমহল রোডের সি ব্লকের ২/২০ নম্বর চারতলা বাড়ির সামনে বিশাল আকারের সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে জামিয়া’তুল মদিনা ও মাদ্রাসাতুল মদিনা লিল বানাত (মহিলা শাখা)। সেখানে মহিলাদের ইসলামী নানা বিষয়ে বিনা পয়সায় শিক্ষা দেয়া হয়। নিচে লেখা দা’ওয়াতে ইসলাম। বাড়িটির সামনে একাধিক ভারী লোহার গেট। তৃতীয় তলায় একটি ল’ চেম্বার রয়েছে। বাড়ির সামনের দিকে পেষ্ট কালার করা। বেশ কয়েক দফায় চেষ্টা করেও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি বাড়ির কারও সঙ্গে কথা বলাও সম্ভব হয়নি। তৃতীয় তলা থেকে একজন পুরুষ উঁকি দিয়েই আবার পর্দা নামিয়ে দেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পের দুই বাসিন্দা মাত্র দুই মাস আগে বাড়িটি ভাড়া নেন। এরপর ওই বাড়িতে আসেন পাকিস্তানী একটি পরিবার। পঞ্চাশোর্ধ পরিবারের কর্তাব্যক্তি পাকিস্তানভিক্তিক একটি এনজিওর কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। এনজিওটির বিরুদ্ধে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তিনি এনজিও কর্মকর্তা হলেও মূলত দা’ওয়াতে ইসলামের প্রচার চালাচ্ছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ঢামাডোলের সুযোগে বিহারী ক্যাম্পগুলোতে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে সংগঠনটি। ওই পাকিস্তানী এনজিও কাজের কথা বলে দেশের ১৭ জেলায় থাকা ৭০টি বিহারী ক্যাম্প চষে বেড়াচ্ছেন। পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের প্রভাব থাকা জেলাগুলোতেও নিয়মিত যাতায়াত করছেন। বিহারী ক্যাম্পগুলোতে দা’ওয়াতে ইসলামের তৎপরতা চালানো হচ্ছে। আর মোহাম্মদপুরের ওই বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত মহিলাদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিহারী ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, বিহারী ক্যাম্পগুলোতে দা’ওয়াতে ইসলামের কোন অফিস খোলা হয়নি। সংগঠনের সন্দেহজনক কার্যক্রম আড়াল করতে বিভিন্ন দোকানপাট অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিহারী ক্যাম্পের একাধিক বিরিয়ানীর দোকান ব্যবহৃত হচ্ছে সংগঠনের কার্যক্রম চালানোর জন্য। দা’ওয়াতে ইসলামের পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের নেতারাও মাঝে মধ্যেই ঢাকায় যাতায়াত করছেন। তারা বিহারী ক্যাম্প ও দা’ওয়াতে ইসলামের তাজমহল রোডের ২/২০ নম্বর ওই বাড়িতে গোপন বৈঠক করছেন। মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পের ফায়জানে মদিনাসহ বেশ কয়েকটি বিরিয়ানী ও কাপড়ের দোকানে ব্যবাসায়িক আলোচনার আড়ালে দা’ওয়াতে ইসলামের নেতাকর্মীরা ঘন ঘন মিলিত হচ্ছেন। ফায়দানে মদিনা বিরিয়ানীর দোকানটি আটকেপড়া পাকিস্তানীদের সংগঠন এসপিজিআরসি অফিস এলাকায়। দোকানটির মালিক আট ভাই। তারা দা’ওয়াতে ইসলামের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সবার বড় ভাই দা’ওয়াতে ইসলামের পাকিস্তান শাখার বড়মাপের নেতা বলেও জানা গেছে। আট ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে অস্ত্রসহ ইতোপূর্বে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু দা’ওয়াতে ইসলামী নয়, যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীসহ অপতৎপরতার বিষয়ে তারা সজাগ রয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে কবি শামসুর রাহমানকে (প্রয়াত) হত্যাচেষ্টার উদ্দেশ্যে হামলা, ২০০৪ সালের ২৭ ফেরুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে টিএসসিতে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে লেখক হুমায়ুন আজাদকে আহত করা এবং পরবর্তীতে বিদেশে তাঁর মৃত্যু, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা, ২০১৩ সালের গত ৯ এপ্রিল দিনদুপুরে বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের আবাসিক ছাত্র আরিফ রায়হান দীপকে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা, ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন রামকৃষ্ণ (আর কে) মিশন রোডের বাড়িতে জবাই করে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি ও বিশ্বত্রাণ কর্তা দাবিদার লুৎফোর রহমান ফারুক (৫৫), তার ছেলে বেসরকারী সিটি ব্যাংকের সদরঘাট শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সানোয়ারুল ইসলাম মনির (৩০), গৃহকর্মী হিসেবে ওই বাড়িতে থাকা লুৎফোর রহমানের সেবক বা খাদেম মঞ্জুর আলম (২৮), মুজিবুল সরকার (৩২), শাহীন (২৪) ও রাসেলকে (৩৭) হত্যা, ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাড়িতে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের শান্তির পথে ও কাফেলা নামক ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যা, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিত রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা ও তাঁর স্ত্রীকে আহত করা এবং সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ রাজধানীতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যাকালে দুই মাদ্রসাা ছাত্র হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়ার পর উগ্র মৌলবাদী সংগঠন ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে। এসব হত্যাকা-ে উগ্র মৌলবাদী সংগঠন জড়িত বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এক প্রকার নিশ্চিত। তাই নতুন করে উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের ঢাকায় প্রকাশ্যে তৎপরতা রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে। র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোন ধরনের অপতৎপরতা রোধে র্যাব কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গীবাদ দমনে জিরো ট্রলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের সংগঠন এসপিজিআরসির সভাপতি জব্বার খান জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেন, দা’ওয়াতে ইসলামের তৎপরতা শুধু বিহারী ক্যাম্পগুলোতে নয়, সারাদেশেই আছে। তবে দা’ওয়াতে ইসলাম কোন জঙ্গী বা উগ্র মৌলবাদী সংগঠন নয়। বিহারী ক্যাম্পগুলোতে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গী তৎপরতা থাকার অভিযোগ বহু পুরনো। ক্যাম্পে মাদক, জাল টাকা, বোমা তৈরি, মজুদ ও সরবরাহ করা ছাড়াও ক্যাম্পগুলো ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের জঙ্গীরা নিরাপদে বসবাস করছে। ভারতের গুলশান কুমার হত্যা মামলার পলাতক আসামি আব্দুর রউফ দাউদ মার্চেন্ট, ছোটা শাকিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগীসহ বহু ভারতীয় ও পাকিস্তানী ফেরারি আসামি বিহারী ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার হয়েছে। এখনও অনেক বিদেশী আসামি বিহারী ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। শুধু ভাষাগত মিল থাকার কারণে এবং আসলের মতো হুবহু ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ জাল পাসপোর্ট থাকার কারণে তাদের গ্রেফতার করতে অনেক সময়ই ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিহারী ক্যাম্পগুলোতে সরকারবিরোধী নানা তৎপরতা চলে। ক্যাম্পে তৈরি বোমা সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে নাশকতা চালাতে ব্যবহৃত হয়। এমনই ঘটনা ঘটেছিল মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর। ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে শাহীন ও নাদিম নামে দুই বিহারী আহত হয়। আবিষ্কৃত হয় বোমা তৈরির কারখানা। কারখানা থেকে গ্রেফতার হয় আহত দুইজনসহ তিনজন। উদ্ধার হয় ১শ’ তাজা বোমা। পরদিন জেনেভা ক্যাম্পে আরেকটি বোমা তৈরির কারখানা থেকে ৩২টি তাজা বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃতদের তৈরি বোমা দিয়ে সরকারবিরোধী কর্মসূচীতে নাশকতা চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-শিবির। তারা বোমা তৈরি করে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নাশকতা-কারীদের কাছে সরবরাহ করত। আর বিহারী ক্যাম্পগুলোতে অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে মাদক ব্যবসা। মাদক, জাল টাকা ও ভারতীয় জাল রুপীর ব্যবসার অধিকাংশই নিয়ন্ত্রিত হয় ঢাকার বিহারী ক্যাম্পগুলো থেকে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভোরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় জাল রুপীসহ পাকিস্তানী নাগরিক সাজ্জাত হোসেন (৪৯) এবং একই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার চোরাই পোশাকসহ গ্রেফতার হয় পাকিস্তানী নাগরিক মুহম্মদ কাজ্জাফি ও ভারতীয় নাগরিক আসিফ হাসান। গ্রেফতারকৃত তিনজনেরই মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে যাতায়াত ছিল। গ্রেফতারকৃত দুই পাকিস্তানীর মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পে একাধিক কাপড়ের দোকান রয়েছে। তারা নানা ধরনের অপতৎপরতা চালাতে প্রায়ই ভারত-পাকিস্তান যাতায়াত করত।
×