বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দিতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় কিছু নারী শ্লীলতাহানি ও হামলার শিকার হয়েছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে এমন একটি ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী। এতে তার একটি হাত ভেঙ্গে যায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের উপস্থিতি থাকলেও কেউ হামলার শিকার নারীদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। এমনকি ঘটনাস্থল থেকে আটক করা চার-পাঁচজন হামলাকারীদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। এই ঘটনার কারণ হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর সীমাহীন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের গাফিলতিকে উল্লেখ করে জড়িতদের গ্রেফতার করে শাস্তির দাবি জানিয়েছে কিছু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠন। এদের পক্ষ থেকে বুধবার দিনভর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদী মিছিল, সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে।
একই দাবিতে বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। মঙ্গলবারের যৌন হয়রানির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘নির্লিপ্ত’ রয়েছে অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, টিএসসির সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের বাইরে যেখানে নারীদের ওপর এই হামলা হয়, সেখান থেকে কয়েক গজ দূরেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে প্রাণ হারান বিজ্ঞানমনোস্ক লেখক অভিজিত রায়। সে সময়ও সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগ ছিল। পুলিশ উপস্থিত থাকলেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হলেও তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি দেখায়, যা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানান সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এ সময় সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসান তারেক, সহসভাপতি মারুফ বিল্লাহ তন্ময়, দফতর সম্পাদক আল আমিন, ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক তুহিন কান্তি দাশ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে যৌন নিপীড়কদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের দাবি জানান প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা।
বিক্ষুব্ধ নারী সমাজের সমাবেশ ॥ একই ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথের মুখে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। ‘বিক্ষুব্ধ নারী সমাজ’ ব্যানারে আয়োজিত ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কয়েকটি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ও হামলাকারীদের থামাতে গিয়ে আহত হওয়া ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি লিটন নন্দী।
তিনি বলেন, আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি, যেখানে পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে মা-বোনদের শ্লীলতাহানি করা হচ্ছে অথচ কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। আমরা কয়েকজন মিলে চেষ্টা করেছি, পুলিশ ভাইদের ডেকেছি, কেউ কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। একের পর এক নারীদের জোর করে শাড়ি খুলে, জামা ছিঁড়ে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এমন একজন নারীকে জড়িয়ে ধরে তাঁর স্বামী কাঁদছিলেন, আর চারপাশে থাকা লোকজন ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দিয়ে একের পর এক স্পর্শ করে যাচ্ছিল। পরে আমি গিয়ে তাদের সরিয়ে দিয়ে মেয়েটির গায়ে আমার পাঞ্জাবি খুলে জড়িয়ে দেই। পরে তাদের রোকেয়া হলে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয় এবং পরে তারা চলে যান। এদিন যাদের সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে তারা কোন দিনই সুস্থা মানসিকতা নিয়ে বাঁচতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও মিলন চত্বরে পুলিশের অবস্থানের কাছাকাছি জায়গায় এই ঘটনা ঘটে, যেখানে পুলিশের কন্ট্রোলরুম ও ১৯টি সিসি ক্যামেরা ছিল। তার পরেও পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ নিতে টালবাহানা করছে।
ছাত্র ইউনিয়নের এই নেতা আরও বলেন, বর্ষবরণ উৎসব নির্বিঘেœ করতে আগের দিন তারা ক্যাম্পাসে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং ফুটপাথে দোকান বসতে না দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেছিলেন। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, পহেলা বৈশাখে দুপুরের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাগুলো দিয়ে অবাধে গাড়ি চলতে ও ফুটপাথে দোকানপাট বসতে দেয়া হয়। এর ফলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ জনসাধারণের চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ দায়সারা বক্তব্য দিয়ে একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, আমাদের দেশে নারীরা শুধু বাইরেই নয়, ঘরেও নির্যাতিত হচ্ছে। এমন ঘটনাগুলো বিচার না হওয়ায় হামলাকারীরা উৎসাহ পাচ্ছে। আমরা এখন এমন একটি জায়গায় এসে পৌঁছেছি যেখানে কোন কিছুরই বিচার হয় না। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
সমাবেশে নাট্যকার জাহানারা নূরীর উপস্থাপনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক, ফাহিমা দূররাত, ফটোসাংবাদিক নুসরাত প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। বাংলা নতুন বছর উপলক্ষে মঙ্গলবার দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান, তাতে সারা ঢাকা থেকে অনেকে যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় সংঘবদ্ধ কয়েক দল যুবক নারীদের যৌন হয়রানি করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তারা জানান, টিএসসি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে কয়েকজন নারীর ‘শ্লীলতাহানির’ চেষ্টা চালায় ওই যুবকের দলগুলো। তারা কারও কারও শাড়ি ধরেও টান দিয়েছিল। পুলিশ ও ছাত্র ইউনিয়নের কয়েক নেতাকর্মীরা কয়েক দফা লাঠিপেটা করেও ভিড়ের মধ্যে ওই যুবকদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। যৌন হয়রানির এ ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী পুলিশের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছেন। তবে শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলামের দাবি, তারা তৎপর থাকলেও ‘বিচ্ছিন্ন’ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। তারা অপরাধীদের শনাক্ত করে আটকের চেষ্টা করছেন।