ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৭ এপ্রিল ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করে। সকল সৃষ্টির ওপর মানুষের মর্যাদাকে তিনি বলবত করেছেন তাকে খলীফাতুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবী নামক গ্রহে প্রেরণ করে। মানুষ যাতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে সেজন্য তিনি বিধান দিয়েছেন ওহীর মাধ্যমে, এজন্য যুগে যুগে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন। এবং তাঁদের নিকটই ওহী বা প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। নবী-রসূলগণ মানুষকে আল্লাহর দেয়া প্রত্যাদেশ অনুযায়ী সৎপথের দিশা দিয়েছেন। সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হচ্ছেন হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। তাঁরই মাধ্যমে আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা ইসলামের পূর্ণতা আনে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ মুতাবেক ১০ হিজরীর ৯ জিলহজ শুক্রবার আরাফাত ময়দানে ১ লাখ ৪০ হাজার হজ পালনরত সাহাবীর বিশাল সমাবেশে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বিদায় হজের খুতবা প্রদান করা শেষে ওহীর মাধ্যমে ইরশাদ করেন : আল ইয়াওমা আক্মালতু লাকুম দীনাকুম ওয়া আত্মামতু আলায়কুম নি’মাতি ওয়া রাদীতুলাকুমুল ইসলামা দীনাÑ আজ তোমাদের দীনকে (জীবন ব্যবস্থা) পূর্ণাঙ্গ করলাম, আমার নি’আমত তোমাদের প্রতি পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের দীন ইসলামকে সানন্দে অনুমোদন দান করলাম (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩)। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যে মানুষ পৃথিবীর জীবনকে আলোকিত করতে পারে সেই মানুষ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যেমন স্বাধীন সত্তা দিয়েছেন তেমনি তাকে স্বাধীনতার সুফল লাভ করার এখতিয়ার দিয়েছেন। আল্লাহর দেয়া স্বাধীনতা অনাচার, পাপাচার, স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার, ভ্রষ্টাচার ও দুর্বৃত্তায়নকে প্রশ্রয় দেয় না, বরং ওগুলোর সমস্ত দরজা রুদ্ধ করে দিয়ে মানবিক মূল্যবোধের বৃত্তের আওতায় নীতি ও নৈতিকতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির দুনিয়া গড়ার তাকীদ দেয়, সে স্বাধীনতা আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক আদায়ের সমান গুরুত্ব দেয়, শ্রেণী বিভক্ত সমাজব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূরীভূত করে। বিদায় হজের সেই ঐহিতাসিক খুত্বায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে মানুষ (আইয়ুহান্নাস)! কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন আরবের ওপর কোন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে। সেই খুত্বার শুরুতেই তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বলেন, আজকের এই দিনটির (হজের দিন) মতো, এই মাসটির (জিলহজ মাস) মতো, এই জনপদের (মক্কা মুকাররমা) মতো তোমাদের একের ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত, রক্ত তোমাদের পরস্পরের নিকট অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু এরশাদ করেন : হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে। যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)। কুরআন মজীদে আরও ইরশাদ হয়েছে : হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা থেকে তাঁর স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দু’জন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন। এবং আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচনা কর এবং সতর্ক থাক জ্ঞাতিবন্ধন সম্পর্কে (সূরা নিসা : আয়াত ১)। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি ইসলামই প্রকৃত স্বাধীনতার মহাসড়ক নির্মাণ করেছে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আইয়ামে জাহিলিয়াতের নিকষ কালো অন্ধকারে ধুঁকে ধুঁকে মরণাপন্ন মানবতাকে উদ্ধার করে মুক্তির সুখসাগরে অবগাহন করান। গুটি কয়েক সমাজপতির কব্জায় জিম্মি হয়ে বন্দীদশাপ্রাপ্ত মানবতাকে তিনি স্বাধীনতার আস্বাদন দান করেন। নারী মুক্তির প্রশস্ত পথ উন্মোচিত করেন, ক্রীতদাস প্রথার শেকড় পর্যন্ত উপড়িয়ে ফেলেন, কাফ্রি গোলাম হযরত বিলাল রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু হয়ে যান প্রথম মুয়ায্যিন। তিনি মদীনা মনওয়ারায় ৬২২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস মুতাবিক রবিউল আউয়াল মাসে আপন জন্মভূমি মক্কা মুকাররমা ত্যাগ করে হিজরত করে এসে এখানে একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের বুনিয়াদি কাঠামো সংস্থাপন করেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা মদীনার সনদ বা ‘চার্টার অব মদীনা’ নামে পরিচিত। একে ‘চার্টার অব লিবার্টিও’ বলা হয়। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এই শাসনতন্ত্রে সর্বস্তরের, সর্ব ধর্মের এবং সকল বর্ণের মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং মদীনা রাষ্ট্রকে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই স্বাধীন মদীনা রাষ্ট্র তাঁর সময়েই ইয়ামেন থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এবং এরই মাধ্যমে রাজতন্ত্রের শেকড় উৎপাটিত হয়ে স্বাধীনতার সুবাতাস প্রবাহিত হতে থাকে। টমাস কার্লাইলের মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি আরবদের প্রাচীন ইতিহাস তুলে ধরে বলেছেন : These Peoples roaming in their desert since the creation of the world. A hero Prophet was came down to them with a word they could believe. See! the unnoticed becomes world notable, the small has grown world great. Within a century afterwards Arabia is in Granada on this hand and Delhi on that..... সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই মানুষ তাদের মরুভূমিতে বিচরণ করে বেড়াত। সেই তাদের কাছে আবির্ভূত হলেন একজন বীর নবী একটি কালাম নিয়ে, যা তারা বিশ্বাস করল, দেখ! যারা ছিল অজ্ঞাত তারা হয়ে গেল জগতখ্যাত, যারা ছিল নগণ্য তারাই হয়ে উঠল বিশ্বজুড়ে শ্রেষ্ঠ। একশ’ বছর যেতে না যেতেই আরব বিস্তৃত হলো গ্রানাডা পর্যন্ত এদিকে, আর ওদিকে দিল্লী পর্যন্ত। ইসলাম ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে বাকস্বাধীনতার বহু নজির রয়েছে। এক জুমআর দিনে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু মসজিদুন্নববীতে জুমআর খুতবা দেবার জন্য যেই মিম্বারে উঠেছেন অমনি এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন : খলীফা! আমার একটা জিজ্ঞাসার জবাব না দিয়ে আপনি খুতবা দিতে পারবেন না। প্রবল প্রতাপশালী খলীফা ফারুক আজম হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু কোনরূপ রাগান্বিত না হয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন : ভাই, তুমি কি জানতে চাইছ? লোকটি বললেন : এবার বায়তুল মাল থেকে যে কাপড় বণ্টন করা হয়েছে তা দিয়ে আমাদের জামা লম্বা করা সম্ভব হয়নি। আমরা যতটুকু কাপড় পেয়েছি আপনারও তো ততটুকু কাপড় পাওয়ার কথা, অথচ আপনার পরিধানে যে জামা রয়েছে তা লম্বা তো বটেই, তাছাড়াও আপনার জামার আস্তিনও লম্বা। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন : এ ব্যাপারে আমার ছেলে সাক্ষ্য দেবে। তখন আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়িয়ে বললেন : আমার আব্বা হুজুরের কোন ভাল জামা নেই। যে কারণে এবার বায়তুল মাল থেকে আমি যে কাপড় পেয়েছি তা আব্বা হুজুরকে দিয়েছি। আমার আব্বা হুজুর তাঁর ভাগের কাপড়খ- এবং আমার ভাগের কাপড়খ- একত্র করে ওই জামা বানিয়েছেন। এ কথা শুনে লোকটা লজ্জায় বসে পড়লেন। আর ওদিকে বাকস্বাধীনতার বিজয়বার্তা ঘোষিত হলো যুগ যুগ ধরে বিশ্বমানবের জন্য। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৎ চিন্তা করার স্বাধীনতা দিয়েছেন, ন্যায্য কথা বলার স্বাধীনতা দিয়েছেন, সৎ পথে উপার্জন করার স্বাধীনতা দিয়েছেন, সুন্দর জীবন গড়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু স্বাধীনতা নামক যে খাস নি’আমত দান করেছেন তাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে লালন করারও বিধান দিয়েছেন। মানুষকে পানাহার করার স্বাধীনতা তিনি দিয়েছেন, সেইসঙ্গে হালাল ও পবিত্র জিনিস গ্রহণের এবং হারাম ও অপবিত্র জিনিস বর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে সৎ চিন্তার বিকাশ ঘটানো, সুন্দর পবিত্র জীবনযাপন ও মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা। স্বাধীনতা মানে যথেচ্ছা জীবনযাপন করা নয়। স্বাধীনতা হচ্ছে সুশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে দেশপ্রেমকে অন্তরে ধারণ করে অবাধে, নির্বিঘ্নে এবং সুখ-শান্তিতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ভৌগোলিক নিজস্ব সীমানায় সম্মিলিত প্রয়াসে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ঐক্য ও সংহতির বাতাবরণ গড়ে তোলা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া তাসিমু বি হাবলিল্লাহি জা’মিআও ওয়ালা তাফাররাকু- তোমরা সম্মিলিতভাবে মজবুত করে আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (সূরা আল-ইমরান : আয়াত ১০৩)। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি নবজাতক জন্মগ্রহণ করে ফিতরতের ওপর (মুসলিম শরীফ)। ফিতরত শব্দের অর্থ প্রকৃতি বা সহজাত স্বভাব। এই ফিতরতই হচ্ছে ইসলাম, আর এই ফিতরতেই নিহিত রয়েছে স্বাধীনতার মর্মবাণী। ইসলাম শব্দের শব্দমূল হচ্ছে সালাম- যার অর্থ শান্তি। আর এই শান্তিই স্বাধীনতার মূল উৎস। কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ধর্মে কোন জোরজরবদস্তি নেই (সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৬)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের খুত্বায় বলেন, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্র্তী অনেক কওম ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসলাম স্বাধীনতার যে চেতনা সঞ্চারিত করে তা সমগ্র মানবজাতিকে একই সমতলে এনে দাঁড় করিয়ে একটি সুখী-সুন্দর জীবনের দিকে চালিতে করে। জর্জ বার্নার্ড শ’ তাই বলেছেন : If all the world was united under one leader then Muhammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness. লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×