ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঝিল থেকে ১২ লাশ উদ্ধার ॥ এলাকায় শোকের ছায়া

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৭ এপ্রিল ২০১৫

ঝিল থেকে ১২ লাশ উদ্ধার ॥ এলাকায় শোকের ছায়া

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রামপুরার পূর্ব হাজীপাড়ার বউবাজার এলাকার আদর্শ গলিতে ঝিলের গভীর পানিতে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি নির্মাণ করায় তা দেবে গিয়ে ১২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। রিপন নামে এক কিশোর নিখোঁজ রয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। হাজার হাজার উৎসুক জনতা ভিড় করেছেন সেখানে। ক্ষতিগ্রস্তরা ঘটনার জন্য দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন। দুর্ঘটনার পর এখন অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়ার কাজ চলছে। বাড়িটির মালিক স্থানীয় যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান চৌধুরী ওরফে মনির বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় মামলা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আজও ভারী ক্রেন দিয়ে পানির নিচে অভিযান চালানো হবে বলে জনকণ্ঠকে বলেছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ। সরেজমিন দেখা গেছে, হাজীনগরের আর্দশ গলি, মাটির মসজিদ আর তালতলার সরু গলি দিয়ে ঝিলের দিকে যাওয়ার রাস্তা। ঝিলটির অবস্থান অন্তত ৫০ একর জমির উপর। তাতে কোথাও ১০ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত পানি রয়েছে। ঝিলের চারদিকে কাঠ, বাঁশ, টিন আর আধাপাকা অন্তত দুই শতাধিক বাড়ি রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়ি রয়েছে আদর্শ গলিতে। এ গলিতে ঝিল দখল করে অন্তত এক শ’ ঘর তোলা হয়েছে। আর অন্তত ৬৫ থেকে ৭০টি ঘর তোলা হয়েছে মাটির মসজিদ এলাকার ঝিলের উপর। অন্য ঘরগুলো তালতলা এলাকায় থাকা ঝিলের উপর গড়ে উঠেছে। এসব বাড়িতে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষের বসবাস। বসবাসকারীদের অধিকাংশই গার্মেন্টস শ্রমিক, রিক্সা-ভ্যানচালক, ভাসমান হকারসহ নানা শ্রেণী-পেশার নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। অনেকটা বস্তির মতো গড়ে ওঠা বাড়িতে বিদ্যুত ও পানির অবৈধ সংযোগ রয়েছে। কক্ষের আকারভেদে প্রতিটির ভাড়া দুই থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। এসব বাড়ির অন্তত ২৫ জন মালিক রয়েছে, যারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তারাই ঝিলের জমির উপর বাড়ি নির্মাণ করে তা ভাড়া দিয়ে আসছে। এসব বাড়ির কোন হোল্ডিং নম্বর নেই। যে বাড়িটি দেবে গেছে সেটির অবস্থান আদর্শ গলিতে। গলি থেকে সরু রাস্তা ধরে প্রায় ৫শ’ গজ এগোলেই বাড়িটি দেখা যায়। বাড়িটির অবস্থান ঠিক ঝিলের মাঝখানে। ঝিলের আশপাশ মাটি আর ময়লা দিয়ে ভরাট করা। ভরাট জায়গা থেকে দেবে যাওয়া বাড়িটির দূরত্ব অন্তত ২শ’ গজ। বাড়িতে বসবাসকারীদের যাতায়াতের জন্য রাস্তাটিতে বাঁশের সাঁকো বানানো হয়েছে। সাঁকোটি অন্তত ২শ’ ফুট লম্বা। আর চওড়ায় অন্তত পাঁচ ফুট। দেবে যাওয়া বাড়িটির অপর প্রান্ত মাটির মসজিদের দিক থেকে অন্তত এক শ’ ফুট দূরত্বে। ওই জায়গায়ও মাটি, ময়লা, ইটের খোয়া ফেলে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বাড়িটিতে দুই দিক থেকেই যাতায়াতের রাস্তা ছিল। স্থানীয়রা জানান, দেবে যাওয়া বাড়িটি লম্বায় প্রায় ২শ’ ফুট আর প্রস্থে ছিল অন্তত দেড় শ’ ফুট। বাড়িটি নির্মাণ করতে প্রথমে ঝিলের ভেতরে স্টিলের লম্বা লম্বা বার পোঁতা হয়েছে। আর সেই স্টিলবারের উপর প্রায় দশ ইঞ্চি চ্যাপ্টা স্টিলবার দেয়া রয়েছে। স্টিলের বার দুটি ওয়েল্ডিং করে আটকানো। বাড়ির চারদিকে এভাবেই কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। বাড়ির নিচের দিকে ভেতরেও কয়েকটি জায়গায় স্টিলের বার বসানো হয়েছে। তবে অধিকাংশ জায়গায়ই মোটা বাঁশ পোঁতা হয়েছে। মোটামুটি একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। বাড়িটির চারদিকের কাঠামোর উপর ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই দেয়া হয়েছে। পানি থেকে প্রায় পাঁচ ফুট উপর প্রথমে কাঠ আর বাঁশের পাটাতন তৈরি করা হয়েছে। তার উপর প্রথম তলাটি করা হয়েছিল। একই ভাবে বাঁশ-কাঠের পাটাতন তৈরি করে তার উপর দ্বিতীয় তলা করা হয়। বাড়িটিতে ২০টি পরিবার ভাড়া ছিল। কক্ষগুলো অনেক বড় ছিল। বাড়িতে অন্তত দেড় শ’ মানুষের বসবাস ছিল। প্রায় এক বছর আগে স্থানীয় প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান চৌধুরী ওরফে মনি (৩৫) বাড়িটি নির্মাণ করেন। দেবে যাওয়া বাড়ি থেকে আদর্শ গলির আরেকটি বস্তির ৩৯টি কক্ষের ম্যানেজার আব্দুস সাত্তারের ঘরের দূরত্ব আনুমানিক এক শ’ ফুট। তিনি বলেন, তিনি যে ৩৯টি কক্ষের ভাড়া তোলেন সেগুলোর মালিক রামপুরার প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবসায়ী হারুনুর রশীদ। ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার বলেন, বুধবার বিকেল তিনটার দিকে আচমকা হুড়মুড় করে বাড়িটি নিচের দিকে পানির ভেতরে দেবে যায়। বাড়িটি পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ঝিলের যে জায়গায় বাড়িটি ছিল সেখানে অন্তত ১৫ ফুট পানি ছিল। আর দোতলা বাড়িটির উচ্চতা ছিল সব মিলিয়ে ১৩-১৪ ফুট। ফলে বাড়িটি স্বাভাবিক কারণেই পানির নিচে তলিয়ে যায়। আর বাড়ির নিচে থাকা কাঠ-বাঁশ পচে যাওয়ায় পুরো বাড়িটি নিচের দিকে দেবে গিয়ে চ্যাপ্টা হয়ে চাপা পড়ে। এজন্য বাড়িটি একেবারেই পানির নিচে চলে যায়। শুধুমাত্র যে পাঁচ ফুট কাঠামোর উপর থেকে বাড়িটি নির্মাণ করে হয়েছিল সেই পাঁচ ফুট কাঠামো পানির উপরে দেখা যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সেখানে ছুটে যায়। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী ও ডুবুরি দল সেখানে অভিযান শুরু করে। ঝিলের মাটির মসজিদ প্রান্তে ফায়ার সার্ভিস ক্যাম্প স্থাপন করে কাজ শুরু করে। উদ্ধার তৎপরতা চালাতে ঝিলের উভয় দিকে সার্চলাইট লাগানো হয়েছে। বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত সেখান থেকে উদ্ধার হয় ১২ জনের লাশ। ফায়ার সার্ভিস দেবে যাওয়া বাড়িটির মাটির মসজিদের প্রান্তে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করেছে। সেখানে নিখোঁজসহ অন্য অভিযোগকারীদের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বুধবার বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত রিপন নামের ১২-১৩ বছর বয়সী একটি ছেলে নিখোঁজ রয়েছে বলে মৌখিকভাবে অভিযোগ করা হয়েছে। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিসের পনের সদস্যের একটি উদ্ধারকারী দল সেখানে অভিযান চালায়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা চলছিল। প্রচ- ঝুঁকির মধ্যে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসকে। সঠিকভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভব হলে হতাহতের সংখ্যা কমে আসতে পারত বলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় উদ্ধারকারীদের ধারণা। এদিকে, আদর্শ গলির ঝিলের পাড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। সেখান থেকে খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হচ্ছে। লঙ্গরখানার ভলান্টিয়ার মিজানুর রহমান সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় জনকণ্ঠকে জানান, ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে কোন মরদেহ উদ্ধার হয়নি। রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর ভূঁইয়া জনকণ্ঠকে জানান, বাড়ি দেবে যাওয়ার ঘটনায় দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার একমাত্র আসামি বাড়ির মালিক মনিরুজ্জামান চৌধুরী ওরফে মনি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বাড়ির মালিক গ্রেফতার হয়নি। আসামিকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এদিকে, ঘটনার পর পরই রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক জানিয়েছেন। তাঁরা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। নিহতদের পরিবারকে ঢাকা জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়। পাশাপাশি দোষীদের আইনের আওতায় আনতে কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বাড়ি দেবে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে একাধিক তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জনকণ্ঠকে জানান, শুক্রবারও ভারী ক্রেন দিয়ে পানির নিচে অভিযান চালানো হবে। কী কারণে এবং কোন প্রেক্ষিতে বাড়িটি দেবে গেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। এছাড়া বাড়ির নিচে আরও কোন লাশ আছে কিনা তা জানতেই অভিযান অব্যাহত থাকবে। কবে নাগাদ অভিযান শেষ হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। বরগুনায় নিহতদের পরিবারে শুধুই কান্না ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা বরগুনা থেকে জানান, রাজধানী ঢাকার রামপুরায় দোতলা টিনশেড ঘর ঝিলপাড়ে দেবে গিয়ে প্রাণ হারানোদের মধ্যে বরগুনার খাজুরতলা গ্রামের স্বামী-স্ত্রীসহ একই পরিবারের রয়েছেন চারজন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ভবিষত নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় নিহতদের বরগুনার খাজুরতলা গ্রামে নিয়ে এলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে খাজুরতলা গ্রামের আকাশ-বাতাস। নিহতদের একনজর দেখতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ।
×