ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গোটা পৃথিবী আজ বিশ্ববিদ্যালয় মুখী

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৫

গোটা পৃথিবী আজ বিশ্ববিদ্যালয় মুখী

ইতিহাসগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বদাই জ্ঞান ও শিক্ষার পাঠস্থান হিসেবে কাজ করেছে। জ্ঞান তৈরি করে ও ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব যুগে সব সমাজে তাত্ত্বিক ও ভৌত সমস্যার সমাধান দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আজ আমরা এমন যুগে বাস করছি যখন জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তরের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ ঘটে চলেছে এবং যখন সমাজ ও অর্থনীতি অধিক থেকে অধিকতর পরিসরে জ্ঞানের ওপর সমস্ত দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করেছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। সবাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেয়ার জন্য ছুটছে। উচ্চশিক্ষা লাভের এ জোয়ার অপ্রতিরোধ্যভাবে বয়ে চলেছে। উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার এই বিশাল চাহিদা পূরণের মোটামুটিভাবে দুটি পথ আছেÑ একটা হলো আমেরিকান মডেল, অন্যটি ইউরোপীয় মডেল। ইউরোপীয় মডেলে রাষ্ট্রই উচ্চশিক্ষার অর্থায়ন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে। সেখানে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটামুটি সমান সম্পদ ও মর্যাদা থাকে। আর আমেরিকান মডেলটি হলো অধিকতর বাজারভিত্তিক এক ব্যবস্থা। যেখানে সরকারী ও বেসরকারী দুই তরফেরই অর্থায়ন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার এক মিশ্র ব্যবস্থা থাকে এবং যেখানে অত্যুৎকৃষ্ট ও আর্থিক দিক দিয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে শীর্ষভাগে আর অর্থসম্পদ ও শিক্ষাগত সাফল্যের দিক দিয়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে নিচের দিকে। গোটা বিশ্ব এখন মার্কিন মডেলকেই অনুসরণ করে চলেছে। আমেরিকান মডেলের জয়জয়কার উচ্চশিক্ষায় আমেরিকান মডেলটির দুনিয়াজোড়া কদর। বিশ্বব্যাপী এ মডেলের উচ্চশিক্ষার ক্রমাগত প্রসার ঘটে চলেছে। উচ্চশিক্ষায় আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৌর্দ- প্রতাপ বা প্রাধান্য। তবে এ প্রাধান্য শুরু থেকেই হয়েছে তা নয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমেরিকা বিশ্ববাসীকে যা দিয়েছে তা হলো আধুনিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। আমেরিকার উদ্ভাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয় হলো অক্সব্রিজ কলেজ ও জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মিলিত রূপ। সরকারী ও বেসরকারী উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরে এই মডেলটি গ্রহণ করে এবং অচিরেই এ পথ ধরেই ইয়েল, প্রিন্সটন, ক্যালটেক এবং আমেরিকার বাকি শীর্ষসারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। শিক্ষার আরেক দিক দিয়েও আমেরিকা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে সেটা হলো গণউচ্চশিক্ষা সৃষ্টি। অর্থনীতিতে অধিকতর দক্ষতার প্রয়োজন থেকেই এমনটা হয়েছে। উচ্চতর গণশিক্ষা চালুর মধ্য দিয়ে আমেরিকা বিশ্বের প্রথম দেশে পরিণত হয়, যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানরা কলেজে লেখাপড়া করতে গেছে এবং কলেজ পরিণত হয়েছে সমৃদ্ধি অর্জনের ছাড়পত্রে। আগেই বলা হয়েছে যে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্ব আজ মার্কিন মডেল অনুসরণ করছে। এই মডেলের বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এখানে অর্থায়ন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারী খাতের ভূমিকা কম এবং বেসরকারী খাতের ভূমিকা বেশি। তাই দেখা যায় যে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় আজ ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করছে। সরকারী অর্থ গুটিকয়েক সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয়িত হচ্ছে এবং আমেরিকান ধাঁচের গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে। কন্টিনেন্টাল ইউরোপীয় মডেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অর্থায়ন, সুযোগ-সুবিধা ও নিয়ন্ত্রণ সবকিছুই যোগায় রাষ্ট্র। আর আমেরিকান মডেলে শিক্ষার এক বড় অংশ যোগায় বেসরকারী খাত এবং টিউশন ফির বেশির ভাগ যোগায় ছাত্ররা। আজ অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, অর্থসংস্থান সুযোগ সুবিধা ও নিয়ন্ত্রণ সবকিছু ইউরোপীয় মডেল থেকে সরে এসে আমেরিকান মডেলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অথচ আমেরিকারই চিত্র ভাল নয় আমেরিকান মডেল দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উচ্চশিক্ষার পেছনে অধিক থেকে অধিকতর অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু সেই ব্যয় অর্থবহ হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে তেমনকিছু জানা যাচ্ছে না। উন্নত দেশগুলো ২০১৩ সালে উচ্চশিক্ষার পেছনে জিডিপির ১.৬ শতাংশ ব্যয় করেছিল। ২০০০ সালে করেছিল ১.৩ শতাংশ। আমেরিকা উচ্চশিক্ষার পেছনে জিডিপির ২.৭ শতাংশ ব্যয় করে। কিন্তু সেই ব্যয়ের অনুপাতে প্রাপ্তি কতটুকু? গবেষণার দিকটা দেখলে প্রাপ্তিটা যথার্থ এবং যথেষ্ট অর্থবহই বলতে হয়। কারণ ২০১৪ সালে বিশ্বের যে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যবহ গবেষণাপত্র তৈরি করেছে তার ১৯টিই আমেরিকান। তবে শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে চিত্রটা মোটেও উজ্জ্বল নয়। এখানে ব্যয়ের অনুপাতে প্রাপ্তি তেমন একটা নেই। ইদানীং অনেক ছাত্রছাত্রী যথেষ্ট শিখছে না। তারা আগের তুলনায় লেখাপড়ার পেছনে খাটাছেও কম। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছরে ৪৫ শতাংশ আমেরিকান ছাত্র কোন একাডেমির সাফল্য অর্জন করেনি। অথচ টিউশন ফি ২০ বছরে বাস্তব হিসাবে দ্বিগুণ হয়েছে। আর ছাত্রঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ক্রেডিট কার্ডের ঋণ ও গাড়ির ঋণকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রভর্তির হার হ্রাস পাচ্ছে। প্রযুক্তি শিক্ষাকে অধিকতর সস্তাও কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি বহন করলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই প্রযুক্তি অবলম্বনে বাধা দিচ্ছে। গণউচ্চশিক্ষা কখন থেকে শুরু আমেরিকায় উচ্চতর শিক্ষা এলিট শ্রেণী থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে। সরকারের অনুদান দেয়া জমির বিক্রয়লব্ধ অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে প্রক্রিয়াটি জোরদার হয় ১৯৪৪ সালে জিআই বিল পাসের মধ্য দিয়ে। ওই বিলে সৈনিকদের কলেজে পড়ার খরচ বহনের ব্যবস্থা করা হয়। আমেরিকায় যা ঘটেছিল পরবর্তীকালে ১৯৬০ এর দশকে ইউরোপে তা ঘটে। জাপানে ঘটে ১৯৭০ এর দশকে আর দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৮০ এর দশকে। এখন বিশ্বজুড়েই এ ব্যাপারটা ঘটছে। বৈশ্বিক জিডিপির তুলনায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দ্রুততর হারে বাড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কোন কোন দেশে উচ্চশিক্ষার এ গণায়ন সম্পৃক্তিবিন্দুতে পৌঁছেছে। সেখানে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অন্যান্য দেশে এ বৃদ্ধি এখনও লক্ষণীয়ভাবে চলছে। চীনে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সংখ্যা ১৯৯৮ সালের ১০ লাখ থেকে বেড়ে ২০১০ সালে ৭০ লাখে পৌঁছেছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এক দশকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় ৯ লাখ নতুন ফুলটাইম ফ্যাকাল্টি সদস্য ভাড়া করেছে। আমেরিকা ও ভারত মিলে বছরে যত গ্র্যাজুয়েট বেরোচ্ছে চীনে এখন তার চেয়েও বেশি বেরোচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে চীনের তরুণ জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করাই এখন চীনের লক্ষ্য। প্রসার ঘটার কারণ কী সারাবিশ্বে শ্রমবাজারের পরিবর্তন, নগরায়ন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কাজ করছে। অর্থনীতি আজ জ্ঞানভিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে ভাল জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। নগরায়ন মানেই লোকজন শহরবাসী হচ্ছে। ফলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ বাড়ছে এবং সেই সুযোগ তারা কাজে লাগাচ্ছে। বেশিরভাগ দেশে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীর সংখ্যা আগামী অর্ধশতকে কমে আসবে। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষার চাহিদা তাই বলে কমবে না। এক সমীক্ষায় বলা হয়, কোন দেশের জিডিপি মাথাপিছু ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেলেও উচ্চতর শিক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধির প্রবণতার কোন স্বাভাবিক সীমা পরিসীমা থাকবে না। চাহিদা ও সরবরাহ সূত্র অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা বিপুল পরিসরে বৃদ্ধির ফলে একটা ডিগ্রীর পেছনে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয় সে তুলনায় প্রাপ্তি হ্রাস পাওয়ার কথা। কতকাংশে ব্যাপারটা তেমনই ঘটেছে। ধনী দেশগুলোর তুলনায় গরিব দেশগুলোতে উচ্চতর শিক্ষার প্রাপ্তির মাত্রাটা মোটামুটিভাবে বেশি। ধনী দেশগুলোতে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় অর্ধেকই গ্র্যাজুয়েট এবং এই সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছে। তথাপি ডিগ্রীধারী ও ডিগ্রীহীনদের মধ্যে মজুরির পার্থক্য এমন থেকে যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা খুব একটা মূল্য বহন করে না। কিন্তু তারপরও শ্রমবাজারের পরিবর্তন এমনভাবে ঘটছে যে, ডিগ্রী লাভের জন্য ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন আগে নাসিং পেশার জন্য ডিগ্রী না হলেও চলত। এখন ডিগ্রী লাগছে। অটোমেশনের ফলে শিক্ষা ও প্রযুক্তির মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রাপ্তরাই কেবল জয়ী হয়। অটোমেশনের কারণে নিচের দিকের কর্মীদের মজুরি কমে যায়। এতে অসাম্য বাড়ে। আর সমাজে অসাম্য যত বেশি বাড়ে ততই ডিগ্রী না থাকার ঝুঁকিটাও বেশি হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রপ আউটদের সফটওয়্যার জগতের বিলিওনিয়ার বনে যাওয়ার যত চমক লাগানো কাহিনীই থাক না কেন, বাস্তব অবস্থা হলো নন-গ্র্যাজুয়েটদের গুটিকয়েক বিত্তবানের কাতারে সামিল হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা দুটোই অতি ক্ষীণ। সেরাদেরই রাজত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন এক ভাল বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ থেকে ভাল লভ্যাংশ মেলে। সেটা হলো ভাল বেতনের চাকরির আকারে। দেখা গেছে, গ্র্যাজুয়েটরা নন-গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় বেশি আয় করে। চাকরিতে রিক্রুটমেন্টের বেলায় নন-গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় গ্র্যাজুয়েটদের অগ্রাধিকার। আবার সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুডেটদের যে পাইকারিভাবে নেয়া হয় তা নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদেরই সর্বদা অগ্রাধিকার। এর একটা কারণ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভর্তির সময় কঠোর বাছাই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নেয়া হয়। আবার ছাত্ররাও এমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিতে চায়, যার নাম শুনলে নিয়োগকর্তারা খুশি হন। উচ্চশিক্ষা সব দেশে সর্বদাই এক প্রতিযোগিতামূলক ব্যাপার। আমেরিকায় তো বেশ আগে থেকেই এটা এক প্রবল প্রতিযোগিতামূলক কর্মকা- হিসেবে বিদ্যমান। আমেরিকায় এবং আমেরিকার বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলে। সেটা র‌্যাঙ্কিং নিয়ে, ‘সেরা’ পদবিটা লাভ করা নিয়ে। আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠার প্রতিযোগিতা ইদানীং তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তো থাকেই, এমনকি ছাত্রদেরও নজর থাকে এই র‌্যাঙ্কিংয়ের ওপর। কারণ র‌্যাঙ্কিংয়ের ওপরের দিকের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ থাকার গুরুত্বই আলাদা। র‌্যাঙ্কিংয়ের কয়েকটা মানদ- আছে। তার একটা হলো কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি অনুপাতে চাত্র বেরিয়ে আসে। এ থেকেই বাছাইয়ের ব্যাপারটা এসে যায়। আর বাছাই থেকে ঘটে ভাল বিশ্ববিদ্যালয় আর মন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য রচনা। এদিক দিয়ে আমেরিকান মডেল কন্টিনেন্টাল ইউরোপীয় মডেল থেকে যথেষ্ট আলাদা। ইউরোপীয় মডেলে যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপারটা অনেক কম। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরং অধিকতর সমদর্শী। এখন র‌্যাঙ্কিং নিয়ে চলছে দুনিয়াব্যাপী প্রতিযোগিতা। সারাবিশ্বে প্রায় দেড়শ’ ন্যাশনাল র‌্যাঙ্কিং আছে। কিন্তু বিশ্বায়নের কারণে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ছাত্রছাত্রীর প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে জাতীয় র‌্যাঙ্কিং থেকে আজ নজর চলে গেছে আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ের দিকে। আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারগুলো সেরা মানের বিশ্ববিদ্যালয় চায়, যাতে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা মেধাবী লোকজন ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি এবং গুচ্ছ গুচ্ছ হাইটেক কোম্পানি গড়ে তুলতে পারে। অন্যদিকে ছাত্ররাও নিশ্চিত হতে চায় যে তাদের সার্টিফিকেটে এমন ব্রান্ডের ছাপ থাকবে যাতে তা ভবিষ্যত গড়ে তোলার পাসপোর্ট হিসেবে কাজ করে। তবে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় শুধু আমেরিকায় কেন তার বাইরেও গড়ে উঠছে। যেমন ধরুন সাংহাইয়ের জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণাকর্মে অসাধারণ নৈপুণ্য ও সাফল্যের পরিচয় দিয়ে এটি বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। সাংহাইয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে হিসাবে নেয়া হয় এবং বিভিন্ন মানদ-ের বিচারে দেখা যায় যে, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থান সর্বশীর্ষে। এরপর ব্রিটেনের স্থান। র‌্যাঙ্কিং বাড়ানোর কৌশল সব বিশ্ববিদ্যালয়ই নিজের র‌্যাঙ্কিং বাড়াতে চায়। র‌্যাঙ্কিং বাড়ানোর একটা কৌশল হলো সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এক অতি উন্নতমানের গবেষণা ইউনিট খোলা এবং সেটা পরিচালনার জন্য ক্যালটেকের প্রাক্তন প্রধান বা এ জাতীয় কোন ব্যক্তিকে নিয়ে আসা। সৌদি আরব কাউস্টের (কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি) ক্ষেত্রে ঠিক এমনই করেছে। প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২ হাজার কোটি ডলার দান করেছিলেন। তবে এ জাতীয় কিছু করার সঙ্গতি বা সামর্থ্য অনেক দেশেরই হয় না। কাজেই বিকল্প উপায় হলো বিদেশের শীর্ষস্থানীয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজ দেশের মাটিতে নিয়ে আসা। এগুলো থেকে ভিন্নকিছু করছে কাতার। সে দেশের দোহার উপকণ্ঠে গড়ে উঠেছে এডুকেশন সিটি। এটি হলো আসলে সেখানকার দারুণ আকর্ষণীয় নতুন নতুন ভবনে আটটি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এমন বিষয়ের ওপর পাঠ দিয়ে থাকে যেটাকে সরকার দেশের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করে। টেক্সাস এ এ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় প্রকৌশল, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় বৈদেশিক বিষয়ের ওপর গবেষণা ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজাখস্তানের নজরবায়েভ বিশ্ববিদ্যালয় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সংডু বিশ্ববিদ্যালয়ও একই মডেল অবলম্বন করেছে। বেশির ভাগ দেশ তাদের বিশ্ববিদ্যায়গুলোর গুণগতমান ধরে রাখার এবং এদিক দিয়ে অন্যান্য দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। চীন নিয়েছে ‘৯৮৫’ নামক প্রকল্প। জার্মানির এ সংক্রান্ত উদ্যোগের নাম এক্সেলেনজিনিকোয়েটিভ। ফ্রান্স ‘সরবোন লীগ’ নাম দিয়ে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছবদ্ধ করেছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমেরিকার আইভি লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা। রাশিয়া তার ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সেরা এক শ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিকে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। জাপান ও ব্রিটেনও একই চেষ্টা চালাচ্ছে। অত্যুৎকৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দরকার অত্যুৎকৃষ্ট শিক্ষাবিদ। এদের পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। যে যত ভাল পারিশ্রমিক দিতে পারে তার তত জয়। এদিক দিয়ে এগিয়ে আছে আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইদানীং উপসাগরের দেশগুলো দ্বিগুণ বেতন দিয়ে তাদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। শুধু শিক্ষাবিদ নিয়ে নয়, ভাল ছাত্র বাগানো নিয়েও বিশ্ব বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। মরুভূমির বুকে মুক্তো আমেরিকান শিক্ষার এক নুতন সাম্রাজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি আবুধাবি। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। ২০১৪ সালে এটি সাদিয়াত দ্বীপে তার নতুন ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। আমিরাত কর্তৃপক্ষ সাদিয়াত দ্বীপটিকে সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য পরিণত করতে চায়। সে জন্য গড়ে উঠেছে বেশকিছু সুরম্য ভবন। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রতিবেশী হিসেবে অচিরেই এই ভবনগুলোতে ঠাঁই হবে গুগেন হেইম, ল্যুভর ও সরবোনের মত নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাগুলোর। সেখানে ২ হাজার ছাত্রের বিনামূল্যে থাকা খাওয়া ও লেখাপড়া করার ব্যবস্থা আছে। আমেরিকার কোন শীর্ষ বিশ্ববিদালয় হলে এই ২ হাজার ছাত্রের জন্য বার্ষিক খরচ হতো ১০ কোটি ডলারেও বেশি। আবুধাবির মতো সাংহাইয়েও গড়ে উঠেছে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এভাবে শেষ পর্যন্ত এক গ্লোবাল নেটওয়ার্কড বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। খরচটা কার ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচের ৮০ থেকে ১০০ ভাগই দেয় রাষ্ট্র। এই মডেলের প্রধান সুবিধা হচ্ছে অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে আমেরিকার মডেলটা হলো মিশ্র অর্থায়নের। মিশ্র অর্থায়ন ব্যবস্থাটির প্রসার ঘটছে; এর আংশিক কারণ ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে সরকারের বাজেটের ওপর উচ্চশিক্ষার চাপিয়ে দেয়া বোঝার ভার বেড়ে যাওয়া। এ থেকে পরিত্রাণের একটা পথ হচ্ছে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটতে দেয়া। অনেক ইউরোপীয় দেশে ঠিক এমনটাই ঘটছে। ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক দেয়া যাচ্ছে না। ফলে লেকচার হল ছাত্রদের দিয়ে উপচে পড়ছে; অথচ সে অনুপাতে শিক্ষক দেয়া হচ্ছে না। আরেকটা পথ হচ্ছে ছাত্রদের নিজেদেরই টিউশন ফির সিংহভাগ অর্থ পরিশোধ করতে দেয়া। আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় বাজেট কাটছাঁট হওয়ায় টিউশন ফি বেড়ে গেছে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৫ বছরে তিনগুণ বেড়েছে এবং আরও ২৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। আমেরিকার বাইরে বেসরকারী অর্থায়নের দিকে বড় আকারে ঝুঁকে পড়ার ব্যাপারটা প্রথম ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ায়। এরপর নিউজিল্যান্ড, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, কতিপয় প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, ব্রিটেন, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে। চীনে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কোন টিউশন ফি লাগত না। এখন লাগছে- তবে তা সামান্য। ভাল ভাল বিশ্ববিদ্যালয় আছে এমন দেশগুলো আয়ের উৎস হিসেবে ক্রমবর্ধমান হারে বিদেশী ছাত্রদের ওপর নির্ভর করছে। এই ছাত্রদের দেশী ছাত্রদের তুলনায় বেশি টিউশন ফি দিতে হয়। যেমন ধরুন ব্রিটেন; সেখানে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ছাত্র বিদেশী। ব্রিটেনে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের প্রবাহ ২০০০ সালে ছিল ১৮ লাখ। ২০১২ সালে তা বেড়ে ৩৫ লাখে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেসরকারী তহবিলের আরেক উৎস হলো দান সাহায্য। কোন কোন প্রতিষ্ঠান এ্যালামনির আয়োজন করে বিত্তবান প্রাক্তন ছাত্রদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। ২০১২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে ৭৬০ কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে। উচ্চশিক্ষার বৃহত্তম যোগানদার যার নাম কেউ কখনো শোনেনি সেটি হলো মুনাফাভিত্তিক শিক্ষাদানকারী একটি আমেরিকান কোম্পানি- নাম লরিয়েট। সারাবিশ্বে ৮০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এর মালিকাধীনে। এর মোট ছাত্রসংখ্যা ১০ লাখ, স্টাফ ৭০ হাজার এবং রাজস্ব ৪শ’ কোটি ডলার। ভারতের উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থাকে জনৈক আমেরিকান শিক্ষাবিদ মাঝারি মানসম্পন্নদের সাগর বলে আখ্যা দিয়েছেন। যেখানে উৎকর্ষদের কিছু কিছু দ্বীপ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন হলো আইআইটি। তবে গুটিকয়েক ভাগ্যবানই শুধু ওইসব দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। সূত্র : দি ইকনোমিস্ট
×