ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধী বিচার

জামালপুরের আশরাফসহ ৮ রাজাকারের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ আজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৫

জামালপুরের আশরাফসহ ৮ রাজাকারের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ আজ

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরের আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা আশরাফ হোসেনসহ ৮ রাজাকারের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও গুমের ঘটনায় পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সংবলিত ফরমাল চার্জ আজ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হচ্ছে। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল এই ফরমাল চার্র্জ দাখিল করবেন বলে জানা গেছে। এর আগে ২৪ মার্চ তদন্ত সংস্থা ৮ রাজাকারের বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ এনে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এর পরের দিন তা চীফ প্রসিকিউটরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রসিকিউশন পক্ষ ঐ ১০টি অভিযোগে থেকে একটি অভিযোগ বাদ দিয়ে অন্যান্য অভিযোগ সমন্বয় করে মোট পাঁচটি অভিযোগ প্রস্তুত করেছে, যা ট্রাইব্যুনালের বরাবরে দাখিল করা হবে। প্রসিকিউশনের আবেদনে গত ৩ মার্চ আশরাফ হোসেনসহ আটজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। পরোয়ানা জারির পর ঐ দিনই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে অভিযান চালিয়ে জামালপুর শহরের নয়াপাড়ায় নিজ বাড়ি থেকে শামসুল হককে ও ফুলবাড়িয়ার জাহেদা শফির মহিলা কলেজ গেট প্রাঙ্গণ থেকে ইউসুফ আলীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই দুই জনকে তদন্তের স্বার্থে ৬ মার্চ সেফহোমে নিয়ে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন। অন্য আসামিরা হলেন অধ্যাপক শরীফ আহম্মেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মোঃ আবদুল মান্নান, মোঃ আবদুল বারী, মোঃ হারুন, মোঃ আবুল হাশেম। এদিকে প্রসিকিউশন পক্ষ যাচাই বাছাই করে যে পাঁচটি অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেছে তার মধ্যে রয়েছে চার্জ-১: জামালপুরে রাজাকার-আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন, স্থানীয় সাধনা ঔষধালয় দখল করে আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটির কার্যালয় স্থাপন এবং সিংহজানি হাইস্কুলে আলবদরদের প্রশিক্ষণ প্রদান। এছাড়া পিটিআই হোস্টেল ও আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রী হোস্টেল দখল করে নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে সেগুলোতে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও গুম করা। চার্জ-২: একাত্তরের ৭ জুলাই ইয়াদ আলী ম-লকে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা। ৭ জুলাই আবদুল হামিদ মোক্তারকে তার গ্রামের বাড়ি মৈশা ভাদুরীয়া থেকে আটক করা। পরে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা। একই দিন শামসুল আলমকে আটক করে নির্যাতন করা। অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি মোঃ সাহিদুর রহমানকে অপহরণের চেষ্টা এবং মহির শেখকে অপহরণ আটক ও নির্যাতন করা। একাত্তরের ৭ জুলাই জামালপুরের ভাইস চেয়ারম্যান সাইদুর রহমানসহ ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়া। চার্জ-৩: একাত্তরের ৯ জুলাই আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আমিন মল্লিককে অপহরণ করে নির্যাতন করা। পরে তাকে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়া। চার্জ-৪: একাত্তরের মে থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আশেক মাহমুদ কলেজ ডিগ্রী হোস্টেলে আলবদর ক্যাম্পে নির্যাতন কেন্দ্রে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন, হত্যা, ও লাশ গুম করা। চার্জ-৫: একাত্তরের মে থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পিটিআই জামালপুরের নির্যাতন কেন্দ্রে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে আটক নির্যাতন পূর্বক হত্যা ও লাশ গুম করা। অন্যদিকে তদন্ত সংস্থা তৎকালীন আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক মহিদুর রহমানকে অপহরণের চেষ্টার যে অভিযোগ এনেছিল, প্রসিকিউশন তা বাদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জনকণ্ঠকে বলেছেন, চার্জ ২, ৩, ৪, ৫ ও একই দিনের ঘটনা। রাত ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে অপরাধীরা এ সমস্ত ঘটনা ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে তদন্ত সংস্থা চার্জ-৭ এ তৎকালীন আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক মহিদুর রহমানকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগটি বাদ দেয়া হয়েছে। মামলার সুবিধার্থে চার্জ সমন্বয় করে ৫টি করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তদন্ত সংস্থা যে সমস্ত চার্জ এনেছিলেন তা ঠিক করেই নতুন আঙ্গিকে চার্জ প্রস্তুত করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, আসামিগণ সবাই জামালপুরের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। মোঃ আশরাফ হোসেন (৬৪) পিতা-মৃত মোহাম্মদ হোসেন, মাতা-মৃত সৈয়দা আশরাফুন্নেছা, সাং-মিয়াপাড়া, অধ্যাপক শরীফ আহাম্মেদ ওরফে শরীফ হোসেন (৭১) পিতা-মৃত আলহাজ জাফর উদ্দিন আহাম্মদ ওরফে জাফর উদ্দিন, মাতা-মৃত মজিরন নেছা, সাং-কাচারীপাড়া, মোঃ আব্দুল মান্নান (৬৬) পিতা-মৃত মহির উদ্দিন, মাতা-মৃত জায়েদা বেওয়া, সাং-কাচারীপাড়া, মোঃ আব্দুল বারী (৬২) পিতা-মৃত আব্দুর রহমান, মাতা-জোবেদা বেওয়া, সাং-বগাবাইদ, হারুন (৫৮) পিতা-মৃত জসিম উদ্দিন জসি, মাতা-মৃত নজিরন বেগম, সাং-বগাবাইদ, মোঃ আবুল হাশেম (৬৫) পিতা-মৃত আব্দুল লতিফ, সাং-কাচারীপাড়া, এ্যাডভোকেট মোঃ শামসুল হক (৭৫) পিতা-মৃত ছফর উদ্দিন ম-ল, মাতা-মৃত খবিরন্নেসা, সাং-নয়াপাড়া ও এস.এম ইউসুফ আলী (৮৩) পিতা-মৃত এস.এম ইউসুফ আলী (৮৩) পিতা-মৃত এস.এম তোরাব উদ্দিন, মাতা-মৃত ওমুকজান বেওয়া, ফুলবাড়িয়া পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, মধুপুর রোড, সর্ব থানা ও জেলা-জামালপুর। তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান তদন্ত করতে গিয়ে জানাতে পারেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন অভিযুক্ত মোঃ আশরাফ হোসেনসহ অন্যান্য আসামিগণ প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ও দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত থেকে স্থানীয় শান্তি কমিটি ও আল-বদর বাহিনী গঠন করেন এবং তারা পাকিস্থানী সেনাবহিনীর সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন। জামায়াতে ইসলামী ও পিচ কমিটির নেতা এ্যাডভোকেট শামসুল হক, এস.এম ইউসুফ আলীদের তত্ত্বাবধানে তাহাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল জামালপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদার্পণের পর পরই মোমেনশাহী জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি সভাপতি মুহাম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে জামালপুর মহকুমায় আল-বদর বাহিনী গঠিত হয়। ওই আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার মোঃ আশরাফ হোসেন এর নেতৃত্বে অন্যান্য আল-বদর সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রে এবং এককভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। তারা জামালপুর মহকুমায় ১০ হাজার লোক হত্যা, ৭৫ হাজার গৃহ ধ্বংস, ১২ কোটি টাকা ক্ষতি সাধন করেছে। এ ছাড়া আসামিদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে জামালপুর মহকুমায় শহীদ ইয়াদ আলী ম-ল হত্যা, শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও লাশগুম, শামসুল আলমকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন, মোঃ সহিদুর রহমান ভূইয়াকে অপহরণ চেষ্টা ও মহির শেখ ওরফে মধুকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন, সাইদুর রহমান ওরফে সাদু চেয়ারম্যানকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং হত্যা চেষ্টা ও আব্দুল হামিদ খানকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনসহ একত্রে ১৬ জনকে হত্যা ও লাশগুম, শহীদ নুরুল আমিন মল্লিক অপহরণ ও হত্যা, অধ্যাপক শহিদুর রহমান খান অপহরণ চেষ্টা ও অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে আরও জানা গেছে, আসামিগণ জামালপুর মহকুমায় পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে যোগসাজশে একত্রে দলীয় এবং সাংগঠনিকভাবে আল-বদর বাহিনী গঠন করেন। সিংহজানী স্কুলে ট্রেনিং প্রদান, জামালপুরে সাধনা ঔষধালয়, পিটিআই, আশেক মাহমুদ কলেজ ডিগ্রী হোস্টেল দখল করে অফিস, ক্যাম্প, নির্যাতন কেন্দ্র স্থাপন করে সারাদেশের ন্যায় জামালপুর মহকুমায় গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট, নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় অপরাধ সংঘটন করিয়াছে। অভিযুক্ত প্রতিপক্ষগণের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনের পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর আবেদনে উল্লেখ করেছেন। অভিযুক্তগণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থানীয় উর্ধতন নেতা ছিলেন। তারা পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে তাদের সকল অপরাধমূলক কর্মকা-ের সহায়তা করার জন্যে এবং নিজেরাও সরাসরি পারস্পরিক যোগসাজশে ও চক্রান্তে অপরাধ সংঘটিত করেছেন। স্থানীয়ভাবে নিজ নিজ দলীয় ঘনিষ্ঠ সহচরদের নিয়ে শান্তিকমিটি ও আল-বদর বাহিনী গঠন করে নিজেরাই এর নেতৃত্ব যৌথভাবে গ্রহণ করেন। এই মামলাটি তদন্ত করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
×