ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

এই অপশক্তিকে বার বার ‘না’ বলুন

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২০ এপ্রিল ২০১৫

এই অপশক্তিকে বার বার ‘না’ বলুন

বাংলাদেশকে একটি অদ্ভুত দেশে পরিণত করতে আদাজল খেয়ে নেমেছে এ দেশের কিছু অর্থলোভী মিডিয়া ও গণমাধ্যমের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান- এটি আজ সম্ভবত দেশবাসী বুঝতে সক্ষম হয়েছে। এই তথাকথিত মিডিয়া-ব্যক্তিত্বরাও কিন্তু প্রথমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং তারপর ঢাকা জেলে বাঙালীর মহান মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাকে হত্যার পর নিন্দা জানান এবং দ্বিতীয়বার পঁচাত্তর পরবর্তীতে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানকে যে উচ্চতায় তুলে ধরেছিলেন সেটিও ছিল পরিকল্পিত। এটি স্পষ্ট হয় যখন জিয়া একের পর এক মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছিল। কারণ, আজ মিডিয়া যত বাক-স্বাধীনতার দাবি করছে, যত সরকারবিরোধী মন্তব্য, ধারাভাষ্য, খবর বিশ্লেষণ, সেমিনার-সভা অনুষ্ঠান করছে তার শতভাগের ১ ভাগও জিয়ার সামরিক সরকার এবং এর ধারাবাহিকতায় এরশাদ, খালেদা সরকার অনুমোদন করেনি। মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে মিডিয়াই তো একজন খলনায়ককে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধানকে, কর্নেল তাহেরসহ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সর্বোচ্চ পুরস্কারে পুরস্কৃত করা এবং বিচার থেকে দায়মুক্তির বিল পাস করার পরও সেই বাঙালীর স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি মিডিয়ার দ্বারাই হয়ে উঠল ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘জনপ্রিয়’ শাসক! মিডিয়ার দ্বারা চরিত্র হননের শিকার বঙ্গবন্ধু, তাঁর দেশপ্রেমিক স্ত্রী-সন্তানরা, তাজউদ্দীনসহ চার নেতা ও তাঁদের সন্তানরা, শেখ মনি ও তাঁর সন্তানরা কি অবর্ণনীয় কষ্ট, যন্ত্রণা ও রাষ্ট্রীয় বাধার সম্মুখীন হয়ে প্রাণে বেঁচে থেকেছে, লেখাপড়া শিখেছেÑ তার সত্য কাহিনী এখনও জনগণ জানে না। কেউ কি জানে শেখ মনির ছোট্ট শিশুসন্তান তাপসকে রাষ্ট্রীয় রোষের ভয়ে ঢাকা শহরের কোন স্কুল ভর্তি করেনি? তারপর সাহসে ভর করে উদয়ন স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ, চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরের বোন মমতাজ হোসেন ঐ শিশুকে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। মা শেখ হাসিনার স্নেহ-সঙ্গ বঞ্চিত তাঁর সন্তান জয় ও পুতুলকে শিশু বয়সে ভারতের বোর্ডিং স্কুলে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়নি? মানুষ কি ঐ শিশুদের, ঐ মায়েদের কষ্ট-যন্ত্রণা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছে? ঐ শিশুদের জন্য তখনও ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহচ্ছায়া ছিল। কিন্তু তার কয়েক বছর পর তিনিও নিহত হলেন। ঐ শিশুরা তো মাতৃভূমিতেও মা-বাবার কাছে প্রাণাশঙ্কায় আসতে পারেনি! কই, মিডিয়া এদের কষ্টের কথা, এদের কঠিন জীবন সংগ্রামের কথা কখনও প্রচার করা দূরে থাকুক, প্রকাশও তো করেনি। প্রশ্ন জাগে, কেন? কারণ, তাদের প্রধান কাজ ছিল একজন ছদ্মবেশী খলনায়ককে জোরজবস্তি করে, মিথ্যা তথ্যকে সত্যের মতো উপস্থাপন করে সত্যিকারের (!) ‘নায়কে’ পরিণত করা আর প্রকৃত ‘নায়ককে’ খলনায়কে পরিণত করা। পাঠক, এতক্ষণে আপনার মনে হচ্ছে না কি, বাংলার রূপকথায় রাক্ষসপুত্র ও রাক্ষসীরা রাজপুত্র ও রানী সেজে ক্ষমতা দখল করে আর আসল রাজপুত্র ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সাহায্যে অনেক দুঃখ-কষ্টের পর রাক্ষস-রাক্ষসীদের বধ করে একদিন প্রকৃত রাজপুত্র ও রানীই তো প্রজাপালক রাজা-রানী হয়Ñ আমাদের রূপকথা সে কথাই শিক্ষা দেয়। জিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, বাংলাদেশের শত্রুরা প্রমাদ গোনে। পাঠক, স্মরণ করুন, জিয়ার কথিত মৃতদেহহীন ‘কফিন’ নিয়ে সারাদেশে, বিশেষত ঢাকায় সেকি উচ্ছ্বাস, ক্রন্দন, শোক! তার মধ্যেই কিন্তু দেখেছেন বিটিভিতে সদ্যবিধবা শোকহীন খালেদার ওপর একটি ডকুমেন্টারি বার বার প্রচারিত হচ্ছিল। আজ মনে হয়, কারা, কেন ঐ গৃহিণী, সদ্যবিধবাকে জনসম্মুখে বার বার তুলে ধরছিল? ডকুমেন্টারিটি কি একটি বড় ধরনের উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করছে না? যদি এটিকে খালেদাকে জনগণের কাছে বিএনপির নেপথ্যের পরিচালক পাকিস্তান ও ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের নেতা হিসেবে উপস্থাপনের সূচনা গণ্য করা হয় তাহলে কি তা খুব ভুল হবে? এভাবেই কিন্তু মিডিয়ার কারসাজিতে একজন গৃহিণী খালেদা জিয়ার জন্য ক্ষমতায় আসার পটভূমি তৈরি করা হয়েছিল। তবে তাকে একেবারে অরাজনীতিক বলা যাবে না। কারণ ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পর তার দুই শিশুপুত্রকে মা-বোনদের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে তার বসবাস, পাঞ্জাবী সেনাদের সঙ্গে জিয়ার প্রেরিত ‘চিরকুট’ বিনিময় কি একেবারেই অরাজনৈতিক কর্মতৎপরতা ছিল? এ কথা কিভাবে বিশ্বাস করা যায়? আসলে খুব দ্রুতই খালেদাকে বিএনপি নেত্রীর পদে বসিয়ে দেয়া, বিশেষ করে সে সময়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা মীর্জা গোলাম হাফিজ, ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ, মান্নান ভূইঞা, শাহ মোয়াজ্জম হোসেনসহ নেতারা দলে বর্তমান থাকা অবস্থায় খুবই উদ্দেশ্যপূর্ণ ছিল বলে বিশ্বাস না করার কোন কারণ নেই। এখানে একটি যৌক্তিক প্রশ্ন উঠতেই পারে। নেপথ্যের শক্তি যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা, চার জাতীয় নেতা হত্যা, কর্নেল তাহের, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল মজিবুল হক, কর্নেল হায়দারসহ প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যার নীলনক্সা জিয়া কর্তৃক বাস্তবায়নের পর, জিয়া হত্যার ক্ষমতাদখলকারী সেনাপ্রধান এরশাদকে ব্যবহার না করে খালেদা জিয়াকে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে তাকেই কেন নির্বাচন করল? এখানেই খালেদার ’৭১-এ পাঞ্জাবী সেনাদের সঙ্গে সেনানিবাসে অবস্থান, ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সম্পর্ক হওয়া এবং আশ্চর্যজনকভাবে আজ পর্যন্ত ’৭১-এ খালেদার নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে দীর্ঘকাল যাবত রহস্যজনক নীরবতা পালন কি প্রমাণ করে না যে, এরশাদের চাইতে খালেদা ঐ নেপথ্য শক্তি এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের জন্য বহু আগে থেকে বিশ্বস্ত মিত্রের প্রমাণ দিয়েছে? যা হোক, নেপথ্য শক্তির নির্দেশে হঠাৎ করে রাজনীতিতে নেমে নেতা হয়ে যাওয়া খালেদা ’৯১ সালে ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়। ’৯২ সালে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও নারী নেত্রী বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ’৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। সময়টি লক্ষণীয়। নির্মূল কমিটিতে দ্রুত যুক্ত হলেন দেশের মুক্তিযুদ্ধপন্থী লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ হাজার হাজার সামরিক-বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। ’৭৬ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষ, দল ও ব্যক্তি দীর্ঘ ষোলো বছর মিডিয়ার চরম মিথ্যা অপপ্রচারে এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে নিষ্পেষিত হবার পর সত্য প্রতিষ্ঠার একটি প্ল্যাটফর্ম পেয়ে সেদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আজ যখন ’৯২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংঘটিত গণআদালতের কথা মনে হয়, তখন যে শিহরণ অনুভব করেছিলাম যেন আরেকবার মুক্তিযুদ্ধের উত্থান দেখছিলাম, ঐ একই রকম শিহরণ জাগিয়েছিল ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের লাখো মানুষের উত্থান দেখে। সে সময় কি জনগণ দেখেনি খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী নেতা গোলাম আযমকে গ্রেফতারের নামে লাখো জনতার রোষ থেকে বাঁচাতে জেলে নিয়ে ভিআইপি মর্যাদায় রেখেছিল? ক’দিন পর আবার তাকে মুক্তি দিয়ে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিল। উল্টোদিকে, গণআদালতের আয়োজক দেশবরেণ্য বিচারপতি, লেখক-কবি-অধ্যাপকদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়ে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে খালেদা, তারেক যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে জোট সরকার গঠন করে একদম জিয়াউর রহমানের অনুসরণে যুদ্ধাপরাধীদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের, মুক্তিযোদ্ধাদের, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভিত ধ্বংস করতে সংখ্যালঘুদের ওপর চরম আঘাত হানে, যা ছিল অদৃষ্টপূর্ব ও অকল্পনীয় এবং ’৭১-এর ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে তুলনীয়। এ সময় প্রায় দুই লাখ সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করে। এরপর ক্ষমতাকে চিরকালের জন্য কুক্ষিগত করতে হত্যাকা-, ধ্বংস, নির্যাতন, জীবিকা বন্ধÑ কি না করেছে খালেদা-নিজামী-তারেকগং যা আজ জনগণের জানা। কিন্তু এরপরও খালেদা-তারেক-যুদ্ধাপরাধীরা ২০১৩-তে সরকার পতনের নামে আবারও যে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থক নিধন শুরু করে তাতে প্রায় ৮০০ নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়, ধ্বংস হয় তাদের শত শত ঘরবাড়ি, ক্ষেত-খামার, পুকুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকা শহরের মতিঝিল এলাকা। এরপর আবারও এই খালেদা-তারেক, এই ২০১৫-তে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাস যাবত পেট্রোলবোমা ছুড়ে প্রায় ২শ’ স্বজাতি নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালীকে আগুনে দগ্ধ করে হত্যা করেছে, আহত ও পঙ্গু করেছে আরও কয়েক শ’ নারী-পুরুষ-শিশুকে। জনগণ দেখেছে ২০১৫-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে পেট্রোলবোমা ছুড়ে চলন্ত ট্রাক, বাসের চালক-হেলপার ও যাত্রী হত্যা ছিল খালেদা এবং তারেকের ঠা-া মাথায় পরিকল্পিত বাঙালী গণহত্যা, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল চৌদ্দদলীয় জোট সরকারের পতন এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা, অসাম্প্রদায়িক বাঙালী সংস্কৃতির সমর্থক শেখ হাসিনার পতন ও তাঁকে হত্যা করে বাংলাদেশকে আবারও যুদ্ধাপরাধীবান্ধব, পাকিস্তানপ্রেমিক খালেদা-তারেককে ক্ষমতায় পুনর্প্রতিষ্ঠিত করা। জনগণকে এবার জোরেশোরে খালেদা-তারেক ও যুদ্ধাপরাধী তাদের এই দুই মিত্রকে ‘না’ বলতে হবে। এই ‘না’ বাঙালীর চিরশত্রুকে চিরকালের জন্য বিনাশ করার জন্যই বলতে হবে। এই নির্বাচনে নয়, দেশের সব নির্বাচনে এই ‘না’ বার বার বলতে বাঙালী যেন ভুলে না যায়! এই শত্রুর বিনাশ ছাড়া অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কিছুতেই নিরাপদ হবে না। লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
×