ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবির ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী ২৫ বৈশাখ প্রধানমন্ত্রী ভিত্তি স্থাপন করবেন দেশের ৩৫তম এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্বভারতীর আদলে শাহজাদপুরে হচ্ছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২২ এপ্রিল ২০১৫

বিশ্বভারতীর আদলে শাহজাদপুরে হচ্ছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর গবেষণা ও তাঁর স্মৃতিকে অম্লান রাখার লক্ষ্যকে সামনে রেখে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর আদলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহু আকাক্সিক্ষত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের ৩৫তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যার মূল ক্যাম্পাস হবে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। কবির স্মৃতিময় কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও নওগাঁর পতিসরে হবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষদ কিংবা শাখা ক্যাম্পাস। শান্তিনিকেতনের আদলে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয় শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে একটি বিশেষায়িত উচ্চ শিক্ষাঙ্গন হলেও এখানে পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য অনুষদের বিভিন্ন বিষয়ও পড়ালেখার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। আগামী ২৫ বৈশাখ শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে কবির ১৫৪তম জন্মবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ। রবীন্দ্র গবেষক, রবীন্দ্রভক্ত, বিশিষ্টজনরা বলছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালী জাতি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি আমাদের কিছুটা হলেও দায়মুক্তি ঘটবে। বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবির নামে আমাদের দেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার দীনতা থেকেও আমরা মুক্তি পাব। এছাড়া উত্তরবঙ্গে শিক্ষার পরিবেশ হবে আরও সম্প্রসারিত। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ৮ মে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার চিন্তার কথা বলেছিলেন। কুষ্টিয়াবাসী তাদের এলাকায় এটি করার দাবি তুললেও সেখানে অন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক বিবেচনায় শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় শিলাইদহে রবীন্দ্র গবেষণা কেন্দ্র কিংবা সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। দাবি ওঠে নওগাঁ থেকেও। তবে সকল দিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরেই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শাহজাদপুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় জায়গাগুলোর একটি। ছিন্নপত্রাবলীর ১৪৯ নম্বর চিঠিতে কবি লিখেছিলেন, ‘এখানে (শাহজাদপুরে) যেমন আমার মনে লেখবার ভাব এবং লেখবার ইচ্ছা আসে এমন আর কোথাও না।’ এই চিঠিতেই তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘আমার এই শাহজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলাÑ মনে আছে ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম। আমিও লিখছিলুম এবং আমার চার দিকের আলো এবং বাতাস এবং তরুশাখার কম্পন তাদের ভাষা যোগ করে দিচ্ছিল। এই রকম চতুর্দিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে গিয়ে নিজের মনের মতো একটা কিছু রচনা করে যাওয়ার যে সুখ তেমন সুখ জগতে খুব অল্পই আছে।’ শাহজাদপুর সম্পর্কে ১৫০ নম্বর চিঠিতে কবি আরও লিখেছিলেন, ‘আমি এর মোহ থেকে কিছুতেই আপনাকে ছাড়াতে পারি নে। এই আলো, এই বাতাস, এই স্তব্ধতা আমার রোমকূপের মধ্যে প্রবেশ করে আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এ আমার প্রতিদিনকার নতুন নেশা, এর ব্যাকুলতা আমি নিঃশেষ করে বলে উঠতে পারি নে।’ এসব লেখাই বলে দেয় শাহজাদপুর বিশ্বকবির প্রাণের জায়গা। বোঝা যায় শাহজাদপুরের আলো-বাতাস-গাছ-পাখি-ঘাস-প্রতিধূলিকণা রবীন্দ্রনাথ অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে জানা গেছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় আইনের খসড়া ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে। গত দেড় বছরে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর শিক্ষা কার্যক্রমসহ প্রতিষ্ঠান দুটি পরিদর্শন করেছেন বেশ কয়েক কর্মকর্তা। খসড়া আইন তৈরিতেও ধারণা নেয়া হচ্ছে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর কার্যক্রম থেকে। সেই আলোকেই অর্গানোগ্রাম ও পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা হবে। ইউজিসির যে কমিটি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নের জন্য কাজ করেছে, একই কমিটি কলকাতার বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ ভবনের বিধিবিধান তৈরি করে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি শাহজাদপুরে সরেজমিনে গিয়ে ইতোমধ্যেই স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য সম্ভাব্য স্থান দেখে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য একটি স্থান শাহজাদপুর উপজেলা শহরের উত্তরে, পারকোলা মৌজার ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের ধার ঘেঁষে। যদিও ফসলী জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, কিন্তু এখানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হলে জমি উন্নয়ন করতে হবে না, কিছু ভৌত সুবিধাও পাওয়া যাবে। অধিকন্তু ক্যাম্পাসটি মহাসড়কের ধারে হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থায় কোন ঝক্কি-ঝামেলায় পড়তে হবে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। কমিটির দেখা সম্ভাব্য অপর স্থানটি শাহজাদপুর উপজেলা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রাউতারা মৌজায়। কবিগুরুর এখানে এক হাজার একরের ওপর জমি রয়েছে, এর সবটাই খাসজমি। তাই জমি অধিগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে কোন বিপত্তি ঘটার আশঙ্কা নেই বলে সকলেই মনে করছেন। ইতোমধ্যেই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণের জন্য ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশনের অন্য দুজন সদস্যসহ মোট পাঁচ সদস্যের একটি দল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িসহ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য স্থানগুলো পরিদর্শন করেন। স্থানগুলো হলো-শাহজাদপুরের পোতাজিয়া ইউনিয়নের বাথান ল্যান্ড হিসেবে পরিচিত বুড়ি পোতাজিয়ার মৌজার রামকান্তপুর, পৌর সদরের দ্বারিয়াপুর মৌজার বিসিক বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন স্থান ও নরিনা ইউনিয়নের টেটিয়ারকান্দাসংলগ্ন স্থান। সদস্যবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করার জন্য প্রাথমিক অবকাঠামোর দিকটিও পর্যবেক্ষণ করেন। প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করার জন্য শাহজাদপুরে কিছু স্থাপনা রয়েছে। কাছারিবাড়িতে যে স্থাপনা রয়েছে তার মাধ্যমে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যের দফতরসহ পাঁচ-ছয়টি বিভাগ শুরু করার মতো অবস্থা আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খসড়া আইন সম্পর্কে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে একাধিক উপ-উপাচার্যের পদও রাখা হচ্ছে। প্রতিটি শাখার দায়িত্বে থাকবেন এক একজন উপ-উপাচার্য। প্রতিষ্ঠানটি শান্তিনিকেতনের আদলে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে একটি বিশেষায়িত শিক্ষাঙ্গন হলেও এখানে পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য অনুষদের বিভিন্ন বিষয়ও পড়ালেখার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। থাকবে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা তার স্বপ্নগুলো নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নওগাঁর পতিসর সম্পূর্ণরূপে কৃষি অনুষদ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথ এখানে গ্রামোন্নয়ন ও কৃষি কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। শিলাইদহ ক্যাম্পাসে হয়ে উঠতে পারে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যয়ন কেন্দ্র। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন তৈরি ও বিশ্বভারতী পরিদর্শন কাজের সঙ্গে ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) বর্তমানে বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী সালাউদ্দিন আকবর বলছিলেন, এটি শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর আদলে প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও দর্শনকে গুরুত্ব দেয়া হবে। তবে একই সঙ্গে এখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য অনুষদের বিভিন্ন বিষয়ও পড়ালেখার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, খসড়া আইন প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোহাব্বত খান। বাকিরা হলেন ইউজিসির অপর সদস্য অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) কাজী সালাহউদ্দিন আকবর এবং ইউজিসির উপসচিব (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) ফেরদৌস জামান। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে সন্তোষ প্রকাশ করে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরীর বলছিলেন, এটি হবে আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত বড় একটি কাজ। যেখানে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন তাঁর দর্শন স্থান পাবে। রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা যেমন থাকবে তেমনি তাঁর মাইক্রোক্রেডিটও স্থান পাবে। শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে একটি বিশেষায়িত শিক্ষাঙ্গন হবে, তবে পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য অনুষদের বিভিন্ন বিষয়ও পড়ালেখার সুযোগ থাকবে। কবে নাগাদ কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলছিলেন, এক বছর এমনকি সাত-আট মাসেও শুরু করা সম্ভব হবে বলে আমি আশাবাদী। এ প্রতিষ্ঠান তৈরিতে ভারত সরকার কিংবা বিশ্বভারতীর সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে বলে একটা কথা উঠে আসছে। এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, না এটা আমাদের দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটা আমরাই করছি। তবে হ্যাঁ প্রতিষ্ঠান হলে আমরা বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতনকে ইনভাইট করতে পারি। তারা যেভাবে বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ ভবন প্রতিষ্ঠায় আমাদের সুযোগ দিয়েছে। দেশে এ ধরনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেন রবীন্দ্র গবেষক, রবীন্দ্রভক্ত, বিশিষ্টজনরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসুলভ জ্ঞানদানে নতুন প্রজন্মকে বিকশিত করার সুযোগ ঘটবে। রবীন্দ্র দর্শনকে স্থায়ীভাবে রূপ দিতে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। তাঁদের অভিমত, রবীন্দ্র অধ্যয়ন, তুলনামূলক ধর্ম, ফোকলোর, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সঙ্গীত, নাটক, চারুকলা, নন্দনতত্ত্ব, পলি উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয় রেখে এটিকে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ববঙ্গের রবীন্দ্রনাথকেই খুঁজে পেতে চান বাংলাদেশের মানুষ।
×