ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাগো মানুষ জাগো

আসছে বৈশাখে আমরা দ্বিগুণ হব, দ্রোহের দাউ দাউ আগুন হব

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২২ এপ্রিল ২০১৫

আসছে বৈশাখে আমরা দ্বিগুণ হব, দ্রোহের দাউ দাউ আগুন হব

মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/ দানব কখনো হয় না মানুষ/ যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ/ লজ্জা কি তুমি পাবে না...। হ্যাঁ, ভয়ঙ্কর লজ্জার ঘটনা। মানুষের মতো দেখতে কিছু দানব আক্রমণ করেছে নারীদের। মায়েদের ওপর, বোনেদের ওপর চালিয়েছে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন। কোন অজোপাড়া গাঁয়ের ঘটনা নয়। গোপনে কিছু ঘটেনি। সব প্রকাশ্যে। রাজধানী শহর ঢাকার একেবারে প্রাণকেন্দ্র টিএসসি এলাকা বর্বর এই ঘটনার সাক্ষী। বরাবরের মতোই গত পহেলা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছিলেন হাজার হাজার নারী। বাঙালীর সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, নারীদের অংশগ্রহণ নতুন বছর শুরুর দিনটিকে আরও সুন্দর করে। বর্ণিল করে। ভালবাসাবাসির করে। তার চেয়ে বড় কথা- সবার করে উৎসবটিকে। সকলের করে। বহুকাল ধরে এভাবে চলে আসছে। কখনও কোনদিন অসুন্দর এখানে প্রবেশ করতে পারেনি। সব সময় অসুন্দরকে অসুরকে প্রতিহত করার ঘোষণা এসেছে বাঙালীর মিলনোৎসব থেকে। অথচ সেই উৎসবে নারীরা নিগৃহীত! না, মেনে নেয়ার মতো নয়। বাঙালী মেনে নিতে পারেনি। যার পর নাই ব্যথিত হয়েছে। গুমরে কেঁদেছে। নারীর জন্য নারীর কান্না কান পাতলেই যেন শোনা যায়। পুরুষও লজ্জিত। তাঁদের মাথা নুয়ে যেন পা ছুঁয়েছে। বিশেষ করে সিসিটিভিতে সেদিনের দৃশ্য দেখার পর বহু পুরুষ পুরুষ জন্মকে ধিক্কার দিয়েছে। সুস্থ চিন্তার প্রতিটি মানুষ এই ঘটনার প্রতিবাদ করছে। ঘটনাস্থল টিএসসি এলাকায় সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত চলছে বিক্ষোভ। মানববন্ধন। প্রতিবাদী গান কবিতায় বিচার চাওয়া হচ্ছে। দোষীদের গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবিতে উত্তাল গোটা এলাকা। বর্বর নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে পহেলা বৈশাখ বিকেলে। অব্যাহত ছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত। প্রথম দিন অনেকে ঘটনার খবর জানতেন না। ধীরে ধীরে তা পরিষ্কার হলে স্তম্ভিত হয়ে যান বিবেকবান মানুষ। এর পর থেকে চলছে প্রতিবাদ। প্রায় প্রতিদিনই টিএসসি এলাকায় প্রতিবাদী কর্মসূচী পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিক্ষক সংস্কৃতিকর্মী নাট্যজন সঙ্গীতশিল্পীসহ একেবারে সাধারণ মানুষ। গ্রীষ্মের রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ক্লান্ত হচ্ছেন না তাঁরা। পরের দিন আবারও সেখানে সমবেত হচ্ছেন। অনভ্যস্থ গলায় বক্তৃতা হচ্ছে। গান হচ্ছে। অব্যাহত আছে কবিতায় বলা। চারুকলার সামনের রাস্তায় শিল্পীরা ছবি আঁকছেন। সেই ছবিতে বাঙালী সংস্কৃতির চিরচেনা শত্রুদের মুখ। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখে দেয়ার আহ্বান। নারী লাঞ্ছনার ঘটনার প্রতিবাদে রাজপথে আছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অভিভাবক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। অপরাধীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচী পালন করছেন নেতাকর্মীরা। মঙ্গলবার প্রচ- রোদ মাথায় নিয়ে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। মানববন্ধন কর্মসূচীতে যোগ দেয়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, পহেলা বৈশাখ টিএসসি এলাকায় নারীদের ওপর যে বর্বর হামলা হয়েছে তা এক কথায় অকল্পনীয়। পুরুষ হিসেবে এ ঘটনা আমাকে যেমন লজ্জিত করেছে, তেমনি তা জাতীয় লজ্জার কারণ। পহেলা বৈশাখের ঘটনাটি পরিকল্পিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারা বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধী, যারা নারীদের ঘরে বন্দী করে রাখার ফতোয়া দেয়, এটি তাদের কাজ। এদের প্রতিহত না করতে পারলে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে বলে সকলকে সতর্ক করেন তিনি। জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, যে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তর সালে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল তার ঠিক পাশেই রচিত হয়েছে নারী নির্যাতনের কালো অধ্যায়। সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, এই বাংলাদেশ বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। একই স্থানে গত কয়েকদিন ধরে প্রতিবাদে অনড় নাট্য নির্মাতা অভিনেতা অভিনেত্রী নৃত্যশিল্পী ও গায়ক গায়িকারা। কাজ বন্ধ রেখে মঙ্গলবারও নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করেছেন মঞ্চ ও টেলিভিশনে বার বার দেখা মুখগুলো। এ প্রসঙ্গে পরিচালক চয়নিকা চৌধুরী বলেন, আমরা সকল কাজ ফেলে এখানে প্রতিবাদ করছি। কারণ এই লাঞ্ছনা মেনে নেয়া যায় না। নারীকে মা বোন বন্ধু প্রেমিকা হিসেবে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা লম্পট দেখতে চাই না। কোন হুমকি নারীকে দমিয়ে রাখতে পারবে না জানিয়ে তিনি বলেন, আসছে বৈশাখে আমরা দ্বিগুণ হব। একইরকম মাতব উৎসবে। অভিনেত্রী চিত্রলেখাগুহ বলেন, আমাদেরকে নারী পুরুষ ভেদ ভুলে মানুষ হতে হবে। মানুষকে জাগতে হবে। তা না হলে সমাজ এগোবে না। অনলাইনে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ অনেক বেশি। আর তাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বলা চলে ঝড় বইছে। বিবেকবান সকল মানুষের ফেসবুক স্ট্যাটাসে এখন নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ। নিউজফিডে ঘুরে ফিরে আসছে অপরাধীদের ছবি। গ্রেফতারের দাবি জানানো হচ্ছে। লাঞ্ছনার ঘটনায় নারী এক্টিভিস্টরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসে ব্যথা বেদনার সবটুকু প্রকাশ করে লিখছেন ছোট মেয়েরা। তরুণীরা। কখনও তাঁদের লেখা পড়ে চোখ জলে ভরে উঠছে। কখনও প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন বন্ধুরা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে নুসরাত জাহান লাকী নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন- আমার মায়ের ধারণা ছিল আমি বোরখা পরলে বখাটেদের উৎপাত কমবে। মার সন্তুষ্টির জন্যে কিংবা নিজেকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যে হলেও বোরখা পরা শুরু করি আজ থেকে ১০ বছর আগে। এর পরও আমি কি যৌন হয়রানির শিকার হইনি? বহুবার হয়েছি। কখনও কখনও মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। এখন বুঝি শুধু পর্দা করাটা সমাধান ছিল না। আমি আইনের আশ্রয় নিতে পারতাম। আমি আরও অনেককে সংগঠিত করে বখাটেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতাম। এখানেই শেষ নয়, যোগ হয়েছে ভিডিও বার্তাও। এসব বার্তায় ভুক্তভোগী নারীদের ক্ষোভ ঘৃণা নয় শুধু, প্রতিরোধের ডাক। ইসরাত তন্বী নামের এক প্রতিবাদকারী যৌন হয়রানি থেকে নিজেকে রক্ষায় মেয়েদের এমনকি ছুরি কাঁচি সঙ্গে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এভাবে বহুমাত্রিক প্রতিবাদে উত্তাল এখন ফেসবুক টুইটার। নারীদের ব্যথা বেদনার সঙ্গী হয়ে সেদিনের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অধিকাংশ পুরুষ। রিয়াদ শিমুল নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন- মেয়েটা পাখি হতে চাইল/ আমি বুকের বাঁদিকে আকাশ পেতে দিলাম...। নারী, রুদ্র গোস্বামীর এই উচ্চারণকে তুমি সত্য জেনো। পৃথিবীর বহু পুরুষ তোমার উড়ে বেড়ানোর, ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতার পক্ষে। তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য বুকে আকাশ পেতে রেখেছে তারা। পহেলা বৈশাখে তুমি যাদের দেখেছ, মনে রেখো, ওরা আর কিছু। পুরুষ ছিল না। এভাবে নানা ভাষায় বিচিত্র প্রকাশ ভঙ্গিতে মানুষ নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করছে। মেয়েদেরকে ঘরের চার দেয়ালে বন্দী করে রাখার ফতোয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে। বর্ষবরণ উৎসব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কলঙ্কিত করার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে মানুষ। সব দেখে বেদনা কিছুটা হলেও কমে আসে। মন আশাবাদী হয়ে ওঠে। অন্ধকারের শক্তিকে পরাভূত করে আলোর পথে যাত্রা অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ। আসছে বৈশাখে নারীরা দ্বিগুণ হবেন। দ্রোহের আগুন হয়ে জ্বলে উঠবেনÑ সকলের তাই প্রত্যাশা।
×