ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রামপাল-মাতারবাড়ি নিয়ে টিআইবির রিপোর্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৫ এপ্রিল ২০১৫

রামপাল-মাতারবাড়ি নিয়ে টিআইবির রিপোর্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের বড় দুই বিদ্যুত প্রকল্প রামপাল এবং মাতারবাড়ি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) উপস্থাপিত সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকৃত তথ্যের প্রতিফলন ঘটেনি। কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য এ প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে গণমাধ্যমে প্রেরিত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার এমন দাবি করা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত ১৬ এপ্রিল এক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে। এতে দাবি করা হয় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা হয়েছে। উপস্থাপনায় দাবি করা হয় স্থানীয় জনমত উপেক্ষা করে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এর আগেও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের নেতৃত্বে রামপাল বিদ্যুত প্রকল্পর কল্পিত ক্ষতি নিরুপণের চেষ্টা করা হয়। তবে সরকারের তরফ থেকে প্রথমেই কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রবিরোধী নেতিবাচক প্রচারণার জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। তবে স্টেকহোল্ডার সঙ্গে ওয়ার্কশপ, গণশুনানি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময়ে কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে সরকার পরিবেশের ক্ষতি করে কিছু করবে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বিদ্যুতের প্রয়োজন। একক জ্বালানি গ্যাসের সঙ্কটের জন্য কয়লা ছাড়া বেশি বিদ্যুত উৎপাদনের অন্য বিকল্প নেই। যেখানে একটি বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করতে এক বছরের বেশি সময় প্রয়োজন হয় সেখানে টিআইবি নবেম্বর ২০১৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত মাত্র চারমাস সময়ে পরিচালিত গবেষণায় বিদ্যুত কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপ, পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করা হয়। বিদ্যুত বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, কোন কিছুকে ভুল বলতে হলে তার বিপরীতে সঠিক কোনটি তা দেখাতে হবে। সেক্ষেত্রে টিআইবি কোন সম্ভাব্যতা জরিপ, পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি না করেই কিভাবে এটাকে ভুল বলছে তা বোধগম্য নয়। প্রকল্পের স্থান নির্বাচনে পরিবেশ রক্ষা এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির চেয়ে প্রকল্পের সুবিধার দিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (এনভায়রনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া- ইসিএ) থেকে ১৫ কিমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও রামপাল প্রকল্পে তা মানা হয়নি। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা পরিবহন ও কার্বনের ফলে সৃষ্ট দূষণও এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি। টিআইবির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিদ্যুত বিভাগ বলছে, ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে খুলনা বিভাগের ৩টি সম্ভাব্য স্থান থেকে রামপালকে সর্বোত্তম উপযোগী স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা সুন্দরবনের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকে ৭২ কিলোমিটার এবং সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মাধ্যমে সামাজিক এবং কারিগরি অর্থনৈতিক উপযোগিতা যাচাইয়ের পর পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ইআইএ করা হয়। প্রকল্প দু’টি বাস্তবায়নে সামগ্রিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বিষয়ে তথ্য উন্মুক্ত করা হয়নি। প্রকল্প এলাকায় প্রকৃত দরের থেকে অনেক কম দামে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া অনেককেই ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, প্রকল্প এলাকা হতে মাত্র ১৫০ পরিবারকে পুনর্বাসনের প্রয়োজন হয়। প্রকল্প এলাকায় অধিকাংশ জমিই অকৃষি জমি। প্রকল্প এলাকায় পরিবেশ অধিদফতরের প্রাথমিক ছাড়পত্র পাওয়ার পরই মাটি ভরাটসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকা- হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়ি বিদ্যুত প্রকল্প এলাকা থেকে মাত্র ১৬ পরিবারকে সরিয়ে নিতে হয়েছে। এখানে অধিকাংশই অকৃষি খাস জমি। যা দখল করে রেখেছিল এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু। টিআইবির প্রতিবেদনে চলমান অর্থবছরে বিদ্যুতখাতের উন্নয়নের জন্য ১১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বরাদ্দ ১৭ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদনের সারণি-১ এ রামপাল ও মাতারবাড়ি প্রকল্পের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বাজেট হিসেবে রামপালের ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে ১৪ হাজার ৫১০ কোটি টাকা এবং মাতারবাড়ির ক্ষেত্রে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে মাতারবাড়ির ক্ষেত্রে বিদ্যুত প্রকল্প ছাড়াও বন্দরের চ্যানেল তৈরি, কোল টার্মিনালসহ অন্যান্য স্থাপনার উন্নয়নের জন্য এ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কাজেই দুটি প্রকল্পের ব্যয়ের তুলনা করা সঠিক নয়। বিদ্যুত বিভাগ জানায়, প্রয়োজনীয় পানি পশুর নদী হতে রিসাইকেল পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবহার করা হবে যা পশুর নদীর গড় প্রবাহের দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ উত্তোলিত পানি রিসাইকেল করার পর পরিবেশ অধিদফতরের বিধিবদ্ধ তাপমাত্রা সীমার মধ্যে পুনরায় পশুর নদীতে ছাড়া হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটিকে অত্যাধুনিক স্টেট অব দি আর্ট পদ্ধতি অনুসরণে আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। ফলে অধিক দক্ষতা সম্পন্ন হবে এবং উন্নতমানের ও কম পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হবে। তাছাড়াও ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) নক্স নিঃসরণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে হবে যা পরিবেশের ওপর আদৌ কোন প্রভাব ফেলবে না। তাছাড়াও নক্স নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য লো নক্স বার্ণার ব্যবহার করা হবে। প্রযুক্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর উন্নত দেশেও পরিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নেয়া হয় না। অথচ এক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশগত বিষয়সমূহের ওপর সর্বোচ্চ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। টিআইবি বলছে, জাইকা মাতারবাড়ি বিদ্যুত প্রকল্পে যে অর্থ সহায়তা করছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের তহবিল থেকে ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। জাইকার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতারণার অভিযোগ তুললেও এ সংক্রান্ত কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেনি টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখার বলেন, আমরা রিলায়েবল সোর্স থেকে এটা জানতে পেরেছি। সরকার প্রেরিত প্রতিক্রিয়ায় বলা হচ্ছে জাইকার বৈদেশিক সহায়তা তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তায় মাতারবাড়িতে বিদ্যুত কেন্দ্রসহ, বন্দর, কোল টার্মিনাল ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জাপান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্প এলাকায় মাত্র প্রকল্পটির ইআইএ করার জন্য জাইকা আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে টোকিও ইলেকট্রনিক সার্ভিসেস কোম্পানি লিমিটেডকে নির্বাচন করা হয়। প্রকল্পের জমি সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ নীতিমালা অনুযায়ী অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং ক্ষতিপূরণ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার কোন ভূমিকা নেই। এতে আরও বলা হয় সরকার বিদ্যুতখাতের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিগত ছয় বছরে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ফলে বিদ্যুত সুবিধাপ্রাপ্ত জনসংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মোকাবেলায় সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় বিদ্যুত কেন্দ্রসমূহ বাস্তবায়ন করছে। গ্যাসের মজুদের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছেÑ এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার বিশ্বের অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতোই বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমদানি নির্ভর কয়লাভিত্তিক এসব প্রকল্পের স্থান নির্ধারণে কয়লা পরিবহন, সবচেয়ে কম পুনর্বাসন জমির পরিমাণ এবং সর্বোপরি পরিবেশগত বিষয়সমূহকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ভবিষ্যতে টিআইবি বিদ্যুত বিভাগ নিয়ে সমীক্ষা কোন প্রতিবেদন তৈরি করলে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রণয়নের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে প্রতিক্রিয়ায়। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে এবং টিআইবিরও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বলে সরকার প্রত্যাশা করছে বলে এতে জানানো হয়।
×