ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারায়ণগঞ্জে বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা ॥ পরিদর্শন করলেন বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর

ছাদে সৌর বিদ্যুত প্যানেল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৬ এপ্রিল ২০১৫

ছাদে সৌর বিদ্যুত প্যানেল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা

রহিম শেখ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে ॥ ভবনের ছাদে আছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। যেখান থেকে চাহিদার ১৩ শতাংশ বিদ্যুত আসবে। আরেকটি ভবনের ছাদ থেকে সংরক্ষণ করা হবে বৃষ্টির পানি। বাথরুমে বসানো হয়েছে এমন ধরনের সরঞ্জাম, যা সাশ্রয় করবে পানি। সব মিলিয়ে এখানে বিদ্যুত ও পানি অর্ধেক কম লাগবে। শুধু পানি ও বিদ্যুত নয়, ২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ছিমছাম পরিবেশে কাজ করবেন ১ হাজার ২০০ শ্রমিক। ওপরের তলায় কাজ চলবে সূর্যের আলোতে। আকাশ মেঘলা থাকলে আপনা আপনি জ্বলে উঠবে বাতি। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংপুর প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড নামের এই পোশাক কারখানাটিতে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। ৫ দশমিক ৫০ একর জমির ওপরে গড়ে ওঠা কারখানাটি হতে যাচ্ছে দেশের তো বটেই, বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব ‘প্লাটিনাম’ নিট পোশাক কারখানা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে এই কারখানাটিতে অর্থায়ন করেছে বেসরকারী খাতের আইএফআইসি ব্যাংক। শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল ও গ্রীন ব্যাংকিং এ্যান্ড সিএসআর ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাসহ কারখানাটি পরিদর্শনে গেলে এটি ঘুরিয়ে দেখান প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মোঃ ফজলুল হক। দুই তলা মূল কারখানা ভবনটি ইস্পাতের (প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং) তৈরি। তিন পাশেই আছে লম্বা বারান্দা। ওঠা-নামার জন্য পাঁচটি সিঁড়ি থাকলেও বের হওয়ার দরজার সংখ্যা ১১টি। শ্রমিকরা যাতে স্বস্তিতে কাজ করতে পারেন সে জন্য পুরো কারখানাটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। সব সময় সেখানে ২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকবে। ভবনের ওপরের তলার পুরোটাই সূর্যের আলোয় চলবে। এতে ৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুত সাশ্রয় হবে। আবার কোন কারণে আলোর স্বল্পতা দেখা দিলে আপনা আপনি জ্বলে উঠবে এলইডি বাতি। এ ছাড়া পুরো ভবনে পাইপ লাগানো হয়েছে, যা দিয়ে বৃষ্টির পানি নিচের ট্যাঙ্কে জমা করা হবে। এ জন্য দুই লাখ লিটার ধারণক্ষমতার একাধিক ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। আর এই পানি বাথরুমের পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত হবে। ফজলুল হক বলেন, লিড প্লাটিনামের শর্ত হচ্ছে এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে, যাতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। একই সঙ্গে সব উপকরণ কারখানার সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করেছি। এতে পরিবহনের জন্য জ্বালানি কম খরচ হয়। এটিও একটি শর্ত। সব মিলিয়ে নির্মাণ উপকরণের ৯০ শতাংশই দেশীয়। ফজলুল হক আরও বলেন, লিড প্লাটিনাম অনেক শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে যেখানে কারখানা হবে তার ৫০০ বর্গমিটারের মধ্যে শ্রমিকদের বাসস্থান, স্কুল, বাজার, বাস বা টেম্পোস্ট্যান্ড থাকতে হবে। কারণ দূরে হলেই শ্রমিকদের কারখানায় আসতে গাড়ির প্রয়োজন হবে। এতে জ্বালানি খরচের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ হবে। সেই বিচারে এই কারখানার আশপাশে সবই আছে। এদিকে কারখানায় বসানো হয়েছে সর্বশেষ প্রযুক্তির সেলাই মেশিন, যা বিদ্যুত সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি ধুলাবালি শোষণ করে নেবে আপনা আপনি। উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি এমনভাবে আয়োজন করা হয়েছে যে, পোশাক তৈরি থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়া শেষ করে সেখানেই মোড়কজাত হয়ে যাবে। কারখানার বাইরে বিশাল জায়গা নিয়ে শ্রমিকদের জন্য লাইফস্টাইল সেন্টার করা হয়েছে। দুই তলা এই ভবনের নিচ তলায় শিশুদের জন্য দিবাযতœ কেন্দ্র ও খাবারের জন্য ডাইনিং কক্ষ থাকছে। ওপরের তলায় আছে নামাজঘর ও একটি প্রশিক্ষণ কক্ষ। এখানে একসঙ্গে ২০০ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়া যাবে। ভবনের ছাদে সৌরদি্যুতের প্যানেল লাগানো হয়েছে। আর লাইফস্টাইল সেন্টারের সামনে আছে ছোট লেক ও ফোয়ারা। ফোয়ারার আরেক পাশে আলাদা ভবনে পণ্যের গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। ৩৩ হাজার বর্গফুটের এই আধুনিক গুদাম তিন তলাবিশিষ্ট। পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য থাকবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। গুদামের সামনেই কর্মকর্তাদের কার্যালয় ও নিটিং কারখানা। কারখানার পেছনের অংশে করা হয়েছে ডায়িং কারখানা। পাশেই আছে বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি। এ ছাড়া আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম। সব ভবন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে কোনটিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে, অন্যটিতে তা ছড়াবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রীন ব্যাংকিং নামে এমন একটি তহবিল রয়েছে। যা কি-না সবুজ ব্যাংকিং হিসেবে পরিচিত। এই তহবিল থেকে সবুজ শিল্প-কারখানা বিনির্মাণে অর্থায়ন করা হচ্ছে। বিশ্বের একমাত্র এই সবুজ কারখানাটিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বেশি বেশি পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানায় অর্থায়ন করতে চাই। সবাই এ মহতি উদ্যোগে এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। জানা যায়, গত বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়ার পর সব অবকাঠামো নির্মাণ শেষ। বর্তমানে চলছে সাজসজ্জার কাজ। মূল কারখানা ভবনের সামনে রোপণ করা হয়েছে দেশীয় গাছ। সব মিলিয়ে কারখানার চত্বরে আছে ৫২ শতাংশ খোলা জায়গা। প্লামি ফ্যাশনসে কর্মসংস্থান হবে দুই হাজার লোকের। মাসিক উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ৯ লাখ ২০ হাজার পিস পোশাক। চলতি মাসের শেষের দিকে কারখানার উৎপাদন শুরু করবে কর্তৃপক্ষ। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ফজলুল হক বলেন, এ মাসের শেষের দিকে কারখানাটি দেখতে আসবেন একাধিক ক্রেতা। পোশাকের মূল্য কম দেয়ার বিষয়ে ক্রেতাদের একটা খারাপ উদাহরণ আছে। আমরা তাঁদের বলব, দাম একটু বাড়িয়ে এ ধরনের কারখানাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য। না হলে দেশে তো এসব হবে না। প্রসঙ্গত, আমেরিকার ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ দিয়ে থাকে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে লিডারশিপ ইন এনার্জি এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। এ সনদ পেতে একটি প্রকল্পকে নির্মাণ থেকে শুরু করে উৎপাদন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল করা কারখানাকে দেয়া হয় প্লাটিনাম মর্যাদা। জানা গেছে, বিশ্বের পোশাক শিল্পে এখন পর্যন্ত তিনটি কারখানা লিড সনদের প্লাটিনাম মর্যাদা পেয়েছে। এর দুটি শ্রীলঙ্কায়, অপরটি ভিনটেজ ডেনিম। নতুন যোগ হচ্ছে প্লামি ফ্যাশনস।
×