জাহাঙ্গীর আলম শাহীন ॥ ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ ছাইয়ের মধ্যে আসলেই রতœ লুকিয়ে আছে। সেটা খুঁজে নিতে হয়। লালমনিরহাটে বিসিক শিল্পনগরী সংলগ্ন জিএইচ চারকোল বিডি ডটকম নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই ছাইকেই রতেœ পরিণত করেছে। ছাই হয়েছে তাদের কাছে আশীর্বাদ। পাটকাঠি পুড়িয়ে পাওয়া ছাই তারা রফতানি করছে চীন, তাইওয়ান ও জাপানে। প্রতিমাসে প্রতিষ্ঠানটি ৩০-৪০ টন পাটকাঠি পোড়ানো ছাই রফতানি করে আসছে।
কম্পিউটার প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ সামস জানান, পাটকাঠি পুড়িয়ে পাওয়া ছাই অত্যন্ত মিহি কার্বন পাউডার। ডিজিটাল প্রিন্টারে কার্বন প্রিন্টের কাজে কালি হিসেবে ব্যবহার হয়। এই ছাই বিদেশে নিয়ে সূক্ষ্মভাবে পরিশোধিত করে প্রিন্টারের কালি বানানো হয়। সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে পাটকাঠি পুড়িয়ে পাওয়া ছাঁইয়ের মূল্য। তাই পাটকাঠি পুড়িয়ে পাওয়া ছাই এখন রতœ। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে এনে ছাই থেকে কার্বন পাউডার তৈরি করলে সেটা বিদেশেও রফতানি করা যাবে। এতে আরও অনেক মূল্যে কার্বন পাউডার বিক্রয় করা যেত।
এতদিন শুধু পাটের আঁশই মূল্যবান ছিল, পাটকাঠির তেমন মূল্য ছিল না। গ্রামে রান্নার সময় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কারণ পাটকাঠি দ্রুত পোড়ে এবং সহজে আগুন ধরানো যায়। পাটকাঠি আখের ছোবড়ার সঙ্গে মিশিয়ে পারটেক্স তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হয়। এখন পাটকাঠির ছাইয়ের উন্নতমানের মিহি কার্বনগুণের কারণে ডিজিটাল প্রিন্টারের টোনারের কালি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
জিএইচ চারকোল বিডি ডটকমের মালিক মোঃ হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, দেড় কেজি পাটকাঠি পুড়িয়ে এক কেজি ছাই পাওয়া যায়। বিশেষ ধরনের পরিবেশবান্ধব চুলায় এই পাটকাঠি পোড়ানো হয়। তার প্রতিষ্ঠানে ছয়টি চুলা রয়েছে। ছয়জন নারী শ্রমিক সারাবছর ছাই তৈরি করেন। সর্বমোট ১৬ শ্রমিকের সারাবছর তার কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া পাটকাঠি সংগ্রহ করে শতাধিক মানুষ। তাদের কাছ থেকে পূর্বনির্ধারিত দরে পাটকাঠি কেনা হয়। এই দর সময় ভেদে ওঠানামা করে। ব্যবসায়িক গোপনীয়তার কারণে পাটকাঠি ও ছাইয়ের মূল্য জানানো সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
লালমনিরহাটে তাঁর ব্যবসার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে আরও একটি পাটকাঠি পোড়ানোর চারকোল নির্মাণ করছেন তিনি। ছয় মাসের মধ্যে সেখান হতে ছাই উৎপাদন শুরু হবে। তিনি বলেন, মাসে এক শ’ টন ছাইয়ের চাহিদা রয়েছে বিদেশে। বিপরীতে মাত্র ৩০-৪০ টন ছাই উৎপাদন করা যায়। দেশে ছাই উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান তারটিই প্রথম বলে জানান তিনি।
রংপুর বিভাগের পাট চাষের সুখ্যাতি বহু বছরের। এ অঞ্চলের আবহাওয়া পাটচাষের উপযোগী, তাই কৃষক ব্যাপকহারে পাটচাষ করে আসছিল। তবে মাঝে পাটের উৎপাদন খরচের চেয়ে দাম কম হওয়ায় কৃষক পাটচাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এখন পাট ও পাটকাঠির দাম পাওয়ায় কৃষক পাটচাষে উৎসাহিত হয়ে উঠছেন। পাটের আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার পর জেলায় প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন পাটকাঠি ছিল মূলত অবহেলিত। গ্রামের মানুষ জ্বালানি আর বাগানের বেড়া হিসেবেই বেশি ব্যবহার করতেন।
পাটকাঠি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন (৪৫) ও হোসেন আলী (৩৪) জানান, আগে পাটকাঠি গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করে শহরে বাসাবাড়িতে মুঠি বেঁধে জ্বালানির জন্য ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতাম। এখন সেটা করতে হচ্ছে না। আগের মতোই সংগ্রহ করি। ঘুরে ঘুরে বিক্রি না করে চারকোলে ওজন করে বিক্রি করি।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ সাহাদত হোসেন জানান, ডিজিটাল প্রিন্টারের টোনারে মিহি কার্বন পাউডার কালি হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। পাটকাঠির ছাই এতে ব্যবহার হওয়াটা স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ মিহি কার্বন পাটকাঠি হতে খুব সহজেই পাওয়া যায়। পাটকাঠির ছাই বিদেশে রফতানি হওয়ায় দেশের কৃষি খাত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। মানুষ পাটচাষে আরও আগ্রহী হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: