ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শুধু ভাগ্যই নয়, অন্যান্য উপাদানও জড়িত

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৯ এপ্রিল ২০১৫

শুধু ভাগ্যই নয়, অন্যান্য উপাদানও জড়িত

অধ্যাপক আবদুল মান্নান সম্প্রতি ‘একজন ভাগ্যবতী বেগম জিয়া’ শিরোনামে তার এক কলামে আমাদের চিন্তার উদ্রেক করা অনেক কথা বলেছেন। বিদ্রƒপাত্মক লেখার কারণে প্রকাশ ভঙ্গিই লেখাটিতে প্রাধান্য পেয়েছে। ভাগ্য ছাড়াও কিছু অন্য উপাদান রয়েছে যা বেগম জিয়াকে সাহায্য করেছে বা করে চলেছে। এগুলোর কথা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। এই কারণগুলোর কথা ভাবতে গেলে আমাদের নিজেদের সমালোচনা করতে হয়। এখানে ‘আমাদের’ বলতে হয়ত ‘জাতি হিসেবে আমাদের’ বোঝাতে পারে। এটা একটা বড় সমস্যা। জাতিকে সমালোচনা করা। অনেকেই বলবেন, ‘এতবড় দুঃসাহস’। অনেকেই বলবেন, ‘ছোট মুখে বড় কথা।’ আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে এই যে যাকে উপলক্ষ করে লেখা জন সহানুভূতি হয়ত তাঁর দিকেই চলে গেল ‘ছোট মুখে বড় কথার’ কারণে। আমরা যখন বলি, ‘বাঙালীরা এই রকম’ বা ‘বাঙালীরা সেই রকম’ তখন কিসের ভিত্তিতে সে কথা বলি? আমরা কি সব বাঙালীর সঙ্গে ঐ ব্যাপারে কথা বলেছি? বা নিদেনপক্ষে প্রনিধিত্বমূলক নমুনা হিসেবে একদল মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি? এমনটা কদাচিৎ ঘটে থাকে। আমরা সাধারণত আমাদের পরিচিত মানুষদের কথা শুনে সমস্ত সেটাকে জাতির মনোভাব হিসেবে ধরে নিয়ে ঢালাও মন্তব্য করে থাকি। কোন কোন সময় আমরা বিখ্যাত মানুষদের কথা উদ্ধৃত করি। উদাহরণ হিসেবে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত হাস্যাত্মক মন্তব্যের কথা উল্লেখ করা যাক। একজন এসে বিদ্যাসাগরকে বললেন ‘অমুক লোকটি আপনার নামে যাচ্ছেতাই কুৎসা রটিয়ে বেড়াচ্ছে।’ অবাক হয়ে বিদ্যাসাগর বললেন, ‘ও কেন আমার নামে কুৎসা রটাচ্ছে। আমি তো তার কোন উপকার করিনি।’ এ কথার মর্মার্থ এই নয় যে, বাঙালীরা সাধারণভাবে অকৃতজ্ঞ। বিশেষ অবস্থায় বিশেষ সময়ে কোন বিখ্যাত মানুষ হয়ত বিশেষ কোন মন্তব্য করেছেন। আমরা তখন কলেজের ছাত্র। বুনিয়াদি গণতন্ত্রভিত্তিক নির্বাচনের প্রচার হিসেবে আইয়ুব খান রাজশাহী এলেন। বিডিদের সামনে বক্তৃতা দিলেন। আমাদের গ্রামের বিডি নায়েব চাচা এলেন সেই সভায়। গ্রামে ফিরে গেলে গ্রামের লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “লায়েব চাচা (‘ন’ কে ‘ল’ উচ্চারণ করে আমাদের গ্রামের মানুষ), আইয়ুব খান কী বলল?” বিজ্ঞের মতো লায়েব চাচা উত্তর দিলন, ‘কী লম্বা! আর গায়ের রং? কী ফর্সা। মনে হয় টোকা দিলে রক্ত বেরুবে।’ লায়েব চাচা বেশি লেখাপড়া জানতেন না। আমি উচ্চশিক্ষিত মানুষদের বলতে শুনেছি, ‘খালেদা জিয়ার গায়ের কী রং! প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে মানায়। হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানায় না।’ এমন কথা শুনে আমরা অনেক সময় ক্ষোভে-দুঃখে ভাবি এমনকি মন্তব্য করি যে, ‘এ দেশের কী হবে?’ কিন্তু সবাই যে এমন করে ভাবে না সেটা আমরা মনের দুঃখে ভুলে যাই। সবাই ওভাবে চিন্তা করলে তো খালেদা জিয়া সব নির্বাচনেই জিততেন। তবে এটাও সত্যি যে, আমাদের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের অনেকেই কাকে মানাবে সেটা চিন্তা করেন। কে উপযুক্ত সেটা ভাবেন না। আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে ধর্মকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে অনেকেই। শুধু আমাদের দেশে কেন তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতেও এমনটা হয়েছে। ‘কিংরাও নিজেদের গডের প্রতিনিধি হিসেবে চালিয়েছেন। আর গির্জার কর্তারা বাইরে শান শওকাতের সঙ্গে ‘গডের’ কাছে প্রার্থনা করেছেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিংয়ের কাজ করে দিয়েছেন। ধর্মভীরু সরল মানুষরা দারিদ্র্যকে মেনে নিয়ে জীবন চালিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যারা প্রশ্ন করেছেন ধর্মের নাম করে কিং তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। আমাদের ইতিহাসেও প্রজাবৎসল রাজার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। তারাপদ রায় এমনি এক রাজার সম্বন্ধে কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আর এক রাজার প্রজাবাৎসল্যের কথা পাঠ্যবইয়ে আমরা পড়েছি কিন্তু বুঝতে একটু অসুবিধা হয় না যে তাঁর আমলে দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিল। সে কথা বললে অনেকে ক্ষেপে ওঠেন। বর্তমান যুগে আমাদের দেশের নেত্রীরা রানীর মতো ব্যবহার করলে অনেকের তা পছন্দ হয়। আপা ইত্যাদির মতো ব্যবহার করলে তাঁদের সাধারণ মনে হয়। সাধারণ মানুষকে নেত্রী বানাতে তাঁরা রাজি নন। একদিকে রানীর মতো বাহ্যিক ব্যবহার অন্যদিকে ধর্মীয় দলের সমর্থন। একেবারে সোনায় সোহাগা! মডার্ন রানীকে ম্যাডাম বলাটা রাজকীয়। নিজের জীবনে ধর্মীয় আচরণ না থাকলেও ধর্মীয় দলের সমর্থন রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে ধর্মবিরোধী দল বললে ম্যাডামের ভক্তরা সেটা অবশ্যই মেনে নেবেন। আর ধর্মহীনতা আর অসাম্প্রদায়িকতার মধ্যে কষ্ট করে পার্থক্যকে খুঁজতে যায়? দুটিকে এক করে দিলে সব দিক দিয়েই ভাল। বিপদের দিনে রাজা সাহেব (রানী সাহেবার স্বামী) প্রতিবেশী দেশে গিয়েছিলেন। এখন সময় বুঝে ওই দেশটিকে ধর্মবিরোধী দেশ বললে অনেক সুবিধা। এসব বুঝতে পেরেছিলেন ম্যাডাম অনেক আগেই। তাই তিনি সেখানে যাননি স্বামীর সঙ্গে। তাঁদের ভক্তরা চিকিৎসা, বাজার খরচ ইত্যাদির জন্য সেখানে গেলেও ওই দেশ সব কিছু নিয়ে গেল বলে চিৎকার করে। অনেকে সেটা শোনে। হাসান হক্কানি তাঁর বই ‘পাকিস্তান; বিটউইন মস্ক এ্যান্ড মিলিটারি’ বইয়ে বর্ণনা করেছেন কিভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জামায়াতে ইসলামকে ব্যবহার করেছে। ’৭১ সালে এদের সখ্যের নিদর্শন আমরা দেখেছি। এরা দু’দল মিলে শুধু গণ হত্যাই করেনি, ধর্মীয় কায়দায় ব্যাপক হারে ধর্ষণও করেছে। এদের বিচার যাতে না হয় সেজন্য ম্যাডাম কম চেষ্টা করেননি। বিশেষ ধরনের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা তো ম্যাডামকে এ জন্য সমর্থন করবেনই। ভাগ্যবতী হওয়ার কোন প্রয়োজন তাঁর নেই। তবে হলে ক্ষতি কী? একবার দেশে বেড়াতে এলে একজন অতিশিক্ষিত ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, শেফিল্ডের (যেখানে আমি থাকি) ডিসির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে কিনা। আমি তাঁকে জানালাম যে, বিলাতে ডিসি বলে কিছু নেই। তাঁর কথা শুনে মনে হলো তিনি কেঁদেই ফেলবেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তবে ও দেশ চলছে কী করে?’ একবার বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের শহীদ দিবসে হাইকমিশনার আড়াই ঘণ্টা পরে এলেন। ততক্ষণ অনুষ্ঠান শুরু হলো না। এককথায় আমলাতন্ত্রের প্রতি আমাদের বেশকিছু মানুষের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। এসব আমলা অবসর নেয়ার পর ম্যাডামের দলে যোগ দেন। তিনি সিংহাসনে বসলে তাঁর পায়ের নিচে সামরিক-বেসামরিক কর্তারা বসে থাকেন। তাঁকে তো ভক্তিশ্রদ্ধা করবেই বেশকিছু লোক। এছাড়াও তাঁর পদতলে আশ্রিত আছেন প্রাক্তন উপাচার্য আর অধ্যাপকরা। ইহকালের বিষয়টিকে অবহেলা করেনি জামায়াতে ইসলামী। অর্থের সমাগম হয়, এমন প্রতিষ্ঠান তারা খুলে বসেছে। তাঁদের এক নেতা নাকি কোটি কোটি ডলার খরচ করেছিল তার পক্ষে কাজ করার জন্য। ম্যাডামের নিজ দলও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। ভাঙ্গা বাক্স থেকে কোটি কোটি টাকা বেরিয়ে এসেছে। তিনি এবং তাঁর পরিবারের খরচপত্র দেখলেই সেটা বোঝা যায়। দলের নেতারা খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের মালিক হয়েছে। কাজেই সেখানে এক শ্রেণীর সুধীজনের ভিড় তো হবেই। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, শুধু শুধু ভাগ্য তাঁকে রানী সাহেবাতুল্য ম্যাডামে পরিণত করেনি! লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
×