ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওরা জানে না মে দিবসের কথা

সৈয়দপুরে ১০ হাজার শিশু শ্রমিক

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১ মে ২০১৫

সৈয়দপুরে ১০ হাজার শিশু শ্রমিক

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ সৈয়দপুর শহরের মিস্ত্রি পাড়ার একটি বালতি ফ্যাক্টরিতে কাজ করে আসিফ। তার বাড়ি সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়নে। পিতা ইটভাঁটিতে কাজ করেন। আসিফকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিনিময়ে তাকে প্রতিদিন তিনবেলা খাবার এবং সপ্তাহে মজুরি দেয়া হয় ৮৪ টাকা। এই বালতি ফ্যাক্টরির পাশের একটি বাক্স তৈরি কারখানায় কাজ করে গুড্ডু। সারাদিন কাজ করে তিনবেলা খাওয়ার পর তাকে দৈনিক ১০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। সৈয়দপুর শহরের রেলওয়ে বাজারের বিভিন্ন হোটেলে কাজ করে মজিদ, হাবিব, জয়নাল, কাশেম ও মিঠু। এদের গড় বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর। এরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মজুরি পায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এই টাকা তাদের বাবা-মায়ের সংসারে ব্যয় হয়। এদের মধ্যে কারও বাবা, আবার কারও মা নেই। ফলে বাঁচার অবলম্বন হিসেবে এই শিশুরাই হাল ধরেছে সংসারের। এই শহরের নিয়াতমপুরে হালকা প্রকৌশল শিল্পে কাজ করে আরমান। ভোর থেকে রাত অবধি সে লোহা লক্করের কাজ করে। অথচ কাজ শেষে তার মজুরি মেলে মাত্র ৩০ টাকা। বাঁশবাড়ি এলাকার একটি গুল ফ্যাক্টরীতে কাজ করে ওয়াসিম। সকালে মায়ের সঙ্গে সে গুল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে আসে। এখানে সে ডিব্বায় গুল ভরা ও লেবেল লাগানোর কাজ করে। কাজ শেষে তার মায়ের হাতে ৬০ টাকা দেয়া হয়। এ কাজে গুলের গুঁড়া নাকে চোখে লেগে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কষ্ট হলেও সহ্য করেই তাকে কাজ করতে হয়। এদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরা মে দিবস কি জানে না বোঝে না বা শিশু শ্রম কি এ ব্যাপারে কিছুই শোনেনি। তবে তারা বলেছে, পহেলা মে কাজের ছুটি। এ দিন রং খেলা হবে, গান বাজনা হবে, আর ভাল খাওয়া পাওয়া যাবে। শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যের শহর নীলফামারীর সৈয়দপুরে দিন দিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সঠিক মজুরি অধিকার বঞ্চিত এ শহরে এখন প্রায় ১০ হাজার শিশু পানির দামে শ্রম বিক্রি করে। শিশু শ্রম যদিও অবৈধ তারপরও হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা এসব শিশু পরিবারের অভাব মেটাতে পানির দরে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বেসরকারী জরিপে জানা যায়, সৈয়দপুরে বিভিন্ন মিল, শিল্প, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে জড়িত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১০ হাজার। তবে অভাব-অনটনে এর সংখ্যা প্রতিবছর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সৈয়দপুরে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও হালকা শিল্প মিলে ৫ হাজার মিল ফ্যাক্টরি ও কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মিনি গার্মেন্টস, গুল ও আগরবাতি ফ্যাক্টরি, বাক্স-বালতি কারখানা, মোমবাতি ফ্যাক্টরি, লেদার ফ্যাক্টরি, কাঠের ফার্নিচার দোকান, চাতাল, ওয়েলডিং, হোটেল রেস্তরাঁ, মোটরসাইকেল গ্যারেজ, নির্মাণ শ্রমিক, বেকারি শিল্পসহ অসংখ্য মিল, ফ্যাক্টরি, কারখানা ও প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে সৈয়দপুর হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা আব্দুল জলিল বলেন, এ শহরে শিশু শ্রম বেশি পরিলক্ষিত হয়। শিশু শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার হলেও আমাদের সংগঠনের সাথে শিশু শ্রমিকদের কোন সম্পর্ক না থাকায় কিছুই করতে পারি না। তবে তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেছেন। যে সময় শিশুদের হাতে থাকার কথা কলম, বই, খাতা আর সেই সময় অভাবের তাড়নায় তারা হাতে নিয়েছে রিকশার প্যাডেল, বাদামের ঝুড়ি, কিংবা ইট পাথর ভাঙ্গার হাতুরী। কালকিনিতে বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিক নিজস্ব সংবাদদাতা, কালকিনি মাদারীপুর থেকে জানান, মোরা একটানা ১৪ ঘণ্টা কাজ করি কিন্তু লাভ কি মোগো নারীগো মজুরী কম। পুরুষারা কাজ করে মোটামুটি যা পায় মোরা তার তিন ভাগের এক ভাগ ও পাই না। মোরা দৈনিক মজুরী পাই ৭০ থেকে ৮০ টাকা। যা বর্তমান বাজারে কিছুই হয় না। ভাবছি এ কাজ আর করবো না। এ কাজ করলে কপালে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই জোটবে না। কথাগুলো ভীষণ আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার চড়বিভাগদী গ্রামের দীনা রানী-(২৭) নামের এক মৃৎশিল্প নারী শ্রমিক। দীনা রানীর ১ ছেলে ২ মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টের সংসার। তার স্বামী নির্মল পাল একদিন কাজ করলে অন্য দিনগুলো থাকে অসুস্থ। এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার ওপরে দুই মেয়েকে প্রতিদিন স্কুলে পাঠানো খরচ যোগাতে হয়। তিনি কোন কূল-কিনারা না দেখে প্রতিদিন মৃৎশিল্পের কাজে যোগদান করে বিনিময় যে পারিশ্রামিক পান তাতে অর্ধহারে দিন কাটাতে হয়। এ বিষয়ে দীনা রানী বলেন, মোগো যদি কাজের বিনিমিয় ন্যায্য পারিশ্রামিক দেয়া না হয় তাহলে মোগো বাঁচার কোন উপায় থাকবে না।
×