ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির অপরাজনীতির শিকার মনজুর আলম

মাঝপথে নির্বাচন বর্জন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার নতুন নীলনক্সা!

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১ মে ২০১৫

মাঝপথে নির্বাচন বর্জন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার নতুন নীলনক্সা!

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন। তিনটিতেই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপি সমর্থিত তিন প্রার্থী। সরকার এ নির্বাচনকে গণতন্ত্রের বিজয় বলে দাবি করেছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ফলকে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যালট জবাব বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে এ নির্বাচনকে নিয়ে নানা মহলের নানা বক্তব্য থাকলেও ছোটখাট বিশৃঙ্খলা ছাড়া বড় ধরনের কোন হাঙ্গামা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে তা সম্পন্ন হওয়ায় জনমনে স্বস্তি বয়ে গেছে। এ নির্বাচন চলাকালে তিন সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া চমক সৃষ্টি করেছেন চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী মনজুর আলম। তার এ ধরনের ঘোষণাকে চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সচেতন মহলে তিনি বিএনপির অপরাজনীতির শিকার বলেও মত ব্যক্ত করা হচ্ছে। ওইদিন সোয়া ১১টায় মনজুর আলম নিজ প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পাশাপাশি রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন। ওইদিন তিনি আরও বলেছেন, এটা তার জীবনের শেষ নির্বাচন। আগামীতে সমাজসেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। বৃহস্পতিবার নিজ বাসভবনে তিনি আবারও সাংবাদিকদের বলেছেন, তার ওই ঘোষণা একান্ত ব্যক্তিগত। তার বয়স হয়েছে, রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার সময় হয়েছে। এখন তারুণ্যের যুগ। তাদের জায়গা করে দিতে হবে। তিনি তাকে সহযোগিতা দানের জন্য সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন, তিনি সদ্য বিদায়ী মেয়র। সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় তার সহযোগিতা কেউ চাইলে তিনি দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। এ নির্বাচনকে নিয়ে বিএনপি যেভাবে কারচুপি, সন্ত্রাস, ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট জালিয়াতি, বহিরাগতদের দিয়ে ভোট প্রদানসহ যেসব এন্তার অভিযোগ আনছেÑ মনজুর আলম ওই ধরনের কোন অভিযোগ নির্বাচনের দিনও আনেননি, সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও বলেননি। তবে তার রাজনীতি থেকে গুটিয়ে ফেলার ঘোষণাটি চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে চমক দিয়েছে। তিনি এখনও তার ঘোষণার পক্ষে অবিচল অবস্থানে রয়েছেন। এদিকে, বিএনপির এ নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত যে পূর্ব পরিকল্পিত তা ইতোমধ্যে কতিপয় বিএনপি নেতার কথোপকথনের রেকর্ড প্রচারের পর তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি এই বলে যে, এ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। কিন্তু মাত্র ১৫ মাসের মাথায় একই সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থাৎ তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে মেয়র প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। প্রার্থীদের পক্ষে টানা নির্বাচনী প্রচার ও গণসংযোগে অংশ নিয়েছেন জোট নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয় ২০ দলীয় জোটনেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন নিজে ঢাকায় দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারও চালিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন বিএনপি নেতারা প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে পুরো দেশবাসীকে যেমন হতবাক করে দিয়েছেন, তেমনি তিন সিটি কর্পোরেশনের তিন মেয়র প্রার্থীকে বলীর পাঠা বানিয়েছেন বলে ব্যাপকভাবে আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবার মাঝপথে বর্জন করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কি নীলনক্সা এঁটেছে তা এখনও পরিষ্কার নয়। কারণ, নির্বাচনে যে অনিয়মের অভিযোগ এনেছে তার বিপরীতে তারা কোন কর্মসূচীও দেয়নি। তবে এটাও সত্য যে, এর আগে লাগাতার অবরোধ ও হরতাল দিয়ে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট দেশজুড়ে যে নাশকতা চালিয়েছে, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে, যানবাহন জ্বালিয়েছে, জনগণকে জিম্মি করে রাখার অপপ্রয়াস চালিয়েছে তা কোন সুফল বয়ে আনেনি। দেশের কোন মহলই ২০ দলীয় জোটের নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক এসব কর্মসূচী সমর্থন করেনি বলেই এবার সিটি নির্বাচনের পর কোন কর্মসূচী দিতে সাহসে কুলায়নি বলে গুঞ্জন চলছে। বিএনপির এসব অপরাজনীতির তৎপরতায় চট্টগ্রামে মনজুর আলম কখনও জড়াননি। বহু চেষ্টার পরও বিএনপি তাকে মাঠে নামাতে পারেনি। এজন্য তাকে নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের খিস্তি খিউড়ের কমতি নেই। আওয়ামী ঘরানার মনজুর আলমকে ২০১০ সালে বিএনপি সমর্থন দিয়ে মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে টেনে নিয়েছিলেন। দলে নিজেদের প্রার্থিতা নিয়ে দৈন্যদশার কারণে এ ঘটনা ঘটেছিল। এবারও একই ঘটনা। যারা চেয়েছিলেন তারা কুলিয়ে উঠতে পারবে না বলেই মনজুর আলমকে আবারও মেয়র প্রার্থী করে সমর্থন দেয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনী প্রচার ও ভোটের দিন বিএনপি নেতা ও কর্মী বাহিনী তার জন্য যথাযথ ভূমিকা রাখেননি। অথচ, তিনি স্রোতের মতো অর্থ ঢেলেছেন এ নির্বাচনের জন্য। তার প্রতি বিএনপি ঘরানার নেতাকর্মীদের অবস্থান এবার পরিষ্কার হওয়ায় তিনি শুধু প্রার্থী থেকে নয়, রাজনীতি থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণাটি দিয়ে ফেললেন। এদিকে, চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মনজুর আলমের বিএনপির রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণাটি বিএনপি মহলকেও বিস্মিত করেছে। মনজুর আলম তার এ ঘোষণার পক্ষে বিস্তারিত কোন ব্যাখ্যা না দিলেও দলসহ বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে যে, বিএনপি তাকে মাঠে নামালেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়নি। এছাড়া চট্টগ্রামে দলের একটি অংশ তার প্রার্থিতা নিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা করে গেছে। এরপরও নির্বাচনী ফলাফলে তিনি ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকায় রাজনৈতিক সচেতন মহল রীতিমতো বিস্মিত হয়েছে। কেননা, ওইদিন ভোট গ্রহণ শুরুর সোয়া তিনঘণ্টার মধ্যে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। যদিও তিনি এ পর্যন্ত খোলাসা করেননি তার এ ঘোষণা তাকে দিতে দলের পক্ষে বাধ্য করা হয়েছে, নাকি নির্বাচনী পরিবেশ তার অনুকূলে ছিল না প্রত্যক্ষ করে তা তিনি বলেন নি। তবে চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নির্বাচনের পর থেকেই এ পর্যন্ত বলে যাচ্ছেন মনজুর আলমের রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা তার ব্যক্তিগত এবং আবেগের বশবর্তী হওয়া থেকে এসেছে। মনজুর আলমের দুটি ঘোষণা অর্থাৎ নির্বাচন বর্জন ও রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার একটির পক্ষে বিএনপি, অপরটির দায়-দায়িত্ব মনজুর আলমের উপরই বর্তিয়েছেন তারা। মনজুর আলম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে টানা তিন দফায় নির্বাচিত কাউন্সিলর ও এক দফায় নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। এছাড়া ৩৩ বার ছিলেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র। ১/১১ সরকার আমলে নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলে ওই সরকার আমলের পুরো সময় তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে তিনি বিএনপির সমর্থনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের নির্বাচনও করেছেন বিএনপির সমর্থনে। এবার শুধু হারেননি, এটা তার শেষ নির্বাচন এবং রাজনীতি থেকে গুটিয়ে ফেলার ঘোষণাটিও দিয়ে ফেলেছেন। এদিকে, বৃহস্পতিবার তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রিটার্নিং অফিসার বরাবরে চট্টগ্রাম নির্বাচন ও ফলাফল বাতিল করে পুনঃনির্বাচন দেয়ার যে দাবি জানিয়েছেন তা প্রার্থী মনজুর আলম জানেন না বলে জানিয়েছেন জনকণ্ঠকে। সন্ধ্যা ৬টায় টেলিফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, প্রথমবারের মতো তিনি জানলেন যে, তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট পুনঃনির্বাচন দাবি করেছেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, প্রার্থী জানার বিষয়টি এখানে প্রধান নয়। ‘আমরা এ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি তাই পুনঃনির্বাচন দাবি করেছি। এখন নির্বাচন কমিশন কোন প্রক্রিয়ায় এ নির্বাচন দেবে কিনা, দিলে কোন প্রক্রিয়ায় দেবে তা তাদের বিষয়। তাকে প্রশ্ন করা হয়, তাদের সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম শুধু নির্বাচন বর্জন করেননি, রাজনীতি থেকেও অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। পুনঃ নির্বাচনে মনজুর আলম প্রার্থী না হলে কি হবেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু জানান, প্রয়োজনে নতুন প্রার্থী দেয়া হবে। অপরদিকে, বেসরকারীভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সমর্থিত নতুন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন এখন শুভেচ্ছার সাগরে ভাসছেন। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তাকে অভিনন্দিত করছেন। অভিনন্দনের জবাবে তিনি মেয়র পদে বসলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১৭ জুন এই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময়ে যারা মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সর্বশেষ সাধারণ সভা হবে আগামী জুলাই মাসে। এ সময় পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত মেয়রের অধীনে আরও দুটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এরপরে নতুন মেয়র ও কাউন্সিলর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং প্রথম সভা থেকে তাদের পাঁচ বছরের মেয়াদের সময় গণনা চলবে। বর্তমানে প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ হোসেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন রুটিন মাফিক। তিনি এবারের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কিন্তু পরাজিত হয়েছেন। এবার মেয়রসহ এক ঝাঁক নতুন মুখ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছেন। যার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ সমর্থিত। ২০১০ সালের নির্বাচনে মেয়রসহ কাউন্সিলর পদগুলোতে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের যে ভরাডুবি ঘটেছিল এবারের নির্বাচনে হয়েছে উল্টো। বিএনপি ও জামায়াতসহ অন্যান্য দল সমর্থিত প্রার্থীদের ধস নামানো পরাজয় ঘটেছে।
×