ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ভুলে যাওয়া মুজিববাহিনী

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৩ মে ২০১৫

একুশ শতক ॥ ভুলে যাওয়া মুজিববাহিনী

॥ এক ॥ এর আগে যেমন হয়নি, ২০১৫ সালেও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। মার্চে হয়নি, ডিসেম্বরেও হবে না। সচরাচর যেমনটি হয় সেটি হয়েছে এবং তেমনটিই হবে। প্রতিবছরের ডিসেম্বর-মার্চ মাসে যেমন হয় তেমন করে টিভির পর্দায় বিজয়ের-স্বাধীনতার মাস নামক লগো লাগানো হয়েছে, সব চ্যানেলেই মাসজুড়ে অনেক টকশো হয়েছে, প্রায় সকল পত্রিকার পাতায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং ডিসেম্বর-মার্চ মাস দুটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরের মাসের প্রথম দিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের ইতিহাস যে তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই চলে যায়। জানুয়ারিতে কিছুুটা চুপচাপ থাকার পর যথারীতি মিডিয়ায় ভাষার মাস জন্ম নেয় ফেব্রুয়ারিতে। রীতি মোতাবেক স্বাধীনতার মাস তো মার্চই সেটিও তেমনভাবেই চলতেই থাকে। ১৬ ডিসেম্বর পার হওয়ার যেমনটি হয় ২৬ মার্চ পার হবার পর তেমনই হচ্ছে। এরপর ১ বৈশাখে নতুন বছরের লগো ঝোলে। চমৎকার রুটিনমাফিক মিডিয়া জগত আমাদের। দিনে দিনে আনুষ্ঠানিকতায় আমরা পেশাদারিত্বও দেখাতে পারছি। অন্যদিকে প্রথাগতভাবেই বাঙালীর প্রবণতা হচ্ছে বিস্মৃতপরায়ণতা। যে কারণে আমরা পঁচাত্তরের কথা মনে রাখি না বা যে কারণে আমরা জিয়া-এরশাদের কুকীর্তির কথা ভুলে যাই। যে কারণে বেগম খালেদা জিয়ার দুঃশাসন এবং তারেক রহমানের দুর্নীতি আমাদের স্মরণেই থাকে না অথবা গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাকাদেরকে মর্যাদার আসনে বসাই। কিংবা যে কারণে আমরা ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতের জঘন্য সন্ত্রাস মনে রাখিনি, যে কারণে আমরা হয়ত ২০১৫ সালের আগুনে পোড়া মানুষগুলোকেও মনে রাখব না; সেই একই কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের কথাও ভুলে যাই। বিশেষ করে যদি বিষয়টি আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ব্যাপার হয় তবে দেখব যে তারা প্রথাগতভাবে তাদের সামনে যেসব তথ্য বারবার উপস্থাপিত হয় কেবল সেগুলোই তারা মনে রাখে। এখন তিরিশ বছরের নিচে যাদের বয়স, এমন অনেককেই আমি কেবল গেঞ্জি পরা জিয়াউর রহমানের ছবির কথা মনে করতে পারে বলে দেখে আসছি। এরশাদের কথা তারা একদম ভোলে না। কিন্তু এখন যদি কেউ জয়বাংলার কথা বলে তাহলে ধরে নেয় এটি হলো আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান। এটি যে, একাত্তর সালে পুরো জাতির স্লোগান ছিল এবং বাংলাদেশের মানুষ যে সারা দুনিয়ায় জয় বাংলার লোক হিসেবে পরিচিত হতো সেটি তারা একেবারে জানেই না। খোদ জিয়াউর রহমান যে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেটিও ওরা শোনেনি। কেবল গণজাগরণ মঞ্চের সময় পুরো দেশ আরেকবার শুনেছে যে জয়বাংলা কারও দলীয় সেøাগান নয়, যে কোন দলের যে কোন মানুষ জয়বাংলা সেøাগান দিতে পারে। এমনিভাবে কেউ যদি বলে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিববাহিনী নামক একটি বাহিনী ছিল তবে তারা অবাক হয়ে যায়। ওদের ধারণা কেবল মুক্তিবাহিনী নামক একটি বাহিনীই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর ধারণা হলো মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ-এর নাম শুনেছে এমন লোক হাতে গুণেও পাওয়া যায় না। মুজিববাহিনী বা বিএলএফ যে একই বাহিনী সেটিও তারা জানে না। আমাদের মিডিয়াগুলোও পারতপক্ষে প্রচলিত ধারণা এবং হাতের কাছের ইতিহাসের বাইরে কিছুই তুলে ধরতে চায় না। আমার মনে আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম আমলে আমরা বিএলএফ-এর একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। একটি টিভি চ্যানেলের হয়ে সেই সম্মেলনের বক্তব্য একটি ডকুমেন্টারি আকারে তৈরি করে প্রচার করার জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। কিন্তু সেই চ্যানেল ডকুমেন্টারিটি প্রচার করেনি। তারা আমাদেরকে জানিয়েছিলেন যে এসব বিষয় নাকি স্পর্শকাতর। অথচ যদি কেউ কোন না কোনভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দুয়েকটি পাতারও সন্ধান করে তবে তাকে এটি খুঁজে পেতেই হবে যে, একাত্তরের যুদ্ধটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ এবং সশস্ত্র পর্ব মাত্র। আমরা ঐতিহাসিকভাবে ভাষা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি হিসেবে দেখলেও সেসব আন্দোলনে কোনভাবেই একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রকাশ্য ঘোষণা বা সেইসব আন্দোলনের লক্ষ্য তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল না। সেইসব আন্দোলন এটি প্রমাণ করেছে যে, আমরা পাকিস্তানে যে কারণে থাকতে চেয়েছিলাম সেই কারণগুলোতে পাকিস্তান বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন বা ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন নয়, একেবারে খুব স্পষ্ট করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতৃত্বে রেখে একদল তরুণের হাতে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস নামক একটি অতি ক্ষুদ্র সংগঠন। সেই সংগঠন একটি অতি ক্ষুদ্র কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে এবং কার্যত একটি সশস্ত্র লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মুজিব বাহিনীর জন্ম হয়েছে সেই স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বে এবং সেই বিপ্লবী সংস্থাটি ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, পরিকল্পনা করেছে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সকল কাজই সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে। আমরা যদি একপেশে না হই এবং কেবল নয় মাসের লড়াইতেই বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামকে সীমিত না করি তবে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের কথা আমাদেরকে অবশ্যই জানতে হবে। একই সঙ্গে জানতে হবে, মুজিববাহিনী সম্পর্কে। এটি তেমন একটি বাহিনী যে বাহিনী প্রবাসী বা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে ছিল না এবং জেনারেল ওসমানী এই বাহিনীর সর্বাধিনায়কও ছিলেন না। এই বাহিনী গঠনের বিষয়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সম্মত ছিলেন না। এমনকি এই বাহিনী মুক্তিবাহিনীর মতো সাধারণ বা অতি সহজীকৃত প্রশিক্ষণও নেয়নি। এই বাহিনীর পুরো বিষয়টি ছিল ভিন্ন মাত্রার। এই বাহিনীর প্রশিক্ষক মেজর জেনারেল (অব.) এস এস ওবান মনে করেন, এমন একটি বাহিনীর প্রয়োজন ছিল ভীষণভাবে। তিনি এমন মত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইটা করার জন্য রাজনৈতিক সচেতনতাসম্পন্ন একটি বাহিনীর দরকার ছিল। ২৫ মার্চের পর পুরো দেশে যখন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার নামে যত লোক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় তাদের বাছাই করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ওরা কারা, কেন মুক্তিযুদ্ধে এসেছে এবং তারা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কি করবে সেইসব বিষয়ে কোন তথ্যই ছিল না। অনেক মুক্তিযোদ্ধা দলের বিরুদ্ধে জনগণের সম্পদ আত্মসাতসহ নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে উগ্র ডান বা উগ্র বামপন্থীরা যেন যুদ্ধের সুযোগ না নিতে পারে। বিশেষ করে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে এটি উল্লেখ করা দরকার যে, এই পিকিংপন্থী রাজনীতিকরা আওয়ামী লীগকে আমেরিকা ও ভারতের দালাল হিসেবে গণ্য করে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে ভারত তখন নকশালবাড়ী আন্দোলনে তটস্থ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান চীনের। বাংলাদেশের চীনপন্থীরা তাই পিকিং-এর নীতিতে আস্থা রেখে পাকিস্তান-জামায়াত ও পাক বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওরা মুক্তিযোদ্ধা হলেও ভারত ও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে লড়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল-মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী হাজার হাজার তরুণ আসলেই জানত না কেন তারা এই যুদ্ধে গেছে। ওদের প্রশিক্ষণে রাজনৈতিক মটিভেশনের সুযোগও ছিল না। তখন যদি একটি রাজনৈতিক আদর্শসংবলিত বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মূল স্রোতে অবস্থান না নেয় তবে প্রকৃত লড়াইটা কে করবে-এই ভাবনাটি বেশি ছিল স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস যারা তৈরি করেছিলেন তাদের। তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মীবাহিনীকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার একটি সঠিক পথও খুঁজছিলেন। আরও একটি বিষয় মুজিববাহিনীর উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় ছিল। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি যদি প্রলম্বিত হয় তবে সেই প্রলম্বিত যুদ্ধটি কারা করবে? মুজিববাহিনীর সংগঠকরা নিজেরা মনে করতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে। তারা আরও ভেবেছেন, ২৫ মার্চের পর আকস্মিকভাবে যারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং যারা নীতি ও আদর্শ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না তাদেরকে দিয়ে কি প্রলম্বিত যুদ্ধ করা যাবে? এছাড়াও তারা চিন্তা করেছিলেন, ট্রাডিশনাল ওয়ারফেয়ার কি প্রলম্বিত যুদ্ধের সহায়ক বা যদি ভিয়েতনামের মতো গেরিলা যুদ্ধ করতে হয় তবে তার জন্য কি মুজিব বাহিনীর মতো একটি বাহিনী গড়ে তোলা উচিত নয়? যারা ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা তখন ভারত সরকারের কাছে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেন এবং অনুরোধ করেন যেন এমন একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয়, যে বাহিনী পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শকে আত্মস্থ করে যুদ্ধ করবে। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক (মরহুম) এবং তোফায়েল আহমেদ ছিলেন এই বাহিনী গড়ে তোলার জন্য প্রথম চারজন উদ্যোক্তা। এর পরে ছিল একটি মধ্যপর্যায়ের নেতৃত্ব। এই নেতাদের মাঝে আসম রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ ছিলেন। এরপর ছিল আরও হাজার হাজার নেতা-কর্মী। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ছিল লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মী। প্রধানত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন এই বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে এই বাহিনীর কথা না বলে পারা যাবে না। আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে যে, এটিই ছিল বস্তুত বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিজস্ব একটি বাহিনী। প্রাসঙ্গিকভাবে এই প্রশ্নটিও উঠে আসতে পারে যে, আওয়ামী লীগ নিজেই কেন মুজিববাহিনী নিয়ে কথা বলে না? এমনকি মুজিববাহিনীর নেতারাও কেন প্রসঙ্গটি সামনে আনেন না? স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব না? (চলবে) ঢাকা, ২ মে, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×