ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যেন এক জয়ের আনন্দের ভেতর দিয়ে ড্র হলো বাংলাদেশ-পাকিস্তান প্রথম টেস্ট;###;দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেনিং জুটিতে রানের বিশ্ব রেকর্ড তামিম-ইমরুলের

টেস্টের মাঠেও দাপটে বাংলাদেশ ॥ ব্যাটিং ঝলক

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩ মে ২০১৫

টেস্টের মাঠেও দাপটে বাংলাদেশ ॥ ব্যাটিং ঝলক

মিথুন আশরাফ, খুলনা থেকে ॥ ম্যাচ বাঁচাতে পারবে তো বাংলাদেশ? তৃতীয় দিন শেষে সবার ভেতরই এ প্রশ্ন জেগেছে। চতুর্থ দিনেই সব চিত্র পাল্টে গিয়ে বাংলাদেশ ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া কর্তৃত্ব আবার নিজেদের দখলে নিল। সেই নিয়ন্ত্রণ আর হাতছাড়া হলো না। তা করা গেল তামিম-ইমরুলের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে। তামিম ২০৬ রান করলেন। দেশের মাটিতে প্রথম ডাবল শতক করলেন। ইমরুল করলেন ক্যারিয়ার সেরা ১৫০ রান। দুইজনের ৩১২ রানের ইতিহাস গড়া জুটির সঙ্গে সাকিব যে ৭৬ রান করলেন, তাতে পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো টেস্টে জিততে দিল না বাংলাদেশ। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথমটিতে ড্র করল বাংলাদেশ। যাকে ড্র বললে আসলে ভুল হয়। ব্যাটিং ঝলকানিতে দাপটে দুটো দিন মাঠে কাটাল বাংলাদেশ। খেলা ড্র হলেও ব্যাটসম্যানরা দর্শকদের দিল জয়ের আনন্দ। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৩৩২ রান করার পর পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে ৬২৮ রান করল। এরপর বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে তামিমের ডাবল শতক ও ইমরুলের দেড় শ’ রানে ৬ উইকেটে ৫৫৫ রান করতেই ম্যাচ থেকে আর কোন রেজাল্ট বের হবে না বিধায় দুই দলের সমঝোতায় দিনের খেলা শেষ করা হলো। তৃতীয় দিন শেষে যে পাকিস্তান ২০৫ রানে এগিয়ে যায়, তখনই বোঝা গেছেÑ এ ম্যাচ বাঁচাতে হলে যা করার ব্যাটসম্যানদেরই করতে হবে। ব্যাটসম্যানরা তাই করলেন। প্রথম ইনিংসে ৩৩২ রানে বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যায়। এরপর প্রথম ইনিংসে তৃতীয় দিনে হাফিজের ডাবল শতকে ৫ উইকেটে ৫৩৭ রান করে পাকিস্তান। চতুর্থ দিনে যে পাকিস্তান আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে, তা ধরেই নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কী দুর্দান্ত বোলিংই না করলেন স্পিনার তাইজুল ইসলাম। ৬ উইকেট একাই তুলে নিলেন। মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই পাকিস্তানের ইনিংস গুটিয়ে গেল। ৯১ রানেই পাকিস্তানের বাকি ৫ উইকেট তুলে নেয়া গেল। তাতেও বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ স্কোরই গড়ল পাকিস্তান। ৬২৮ রান করল। পাকিস্তান এগিয়ে গেল ২৯৬ রানে। হাতে বাকি থাকল চতুর্থ দিনের দুই সেশন ও পঞ্চম দিনের তিন সেশন। এর মধ্যে বাংলাদেশকে ম্যাচ হারা যাবে না- এমন কিছু করতে হতো। সেই করাটি একমাত্র ব্যাটসম্যানদের ওপরই নির্ভর ছিল, যা কেউ ভাবতেই পারেনি তাই করে দেখালেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। কী আশ্চর্য! কী সুখের দিন গেল। চতুর্থ দিনে দুই সেশনে এত ভাল খেলল বাংলাদেশ, একটি উইকেটও পাকিস্তান বোলাররা তুলে নিতে পারলেন না! তামিম-ইমরুল মিলে তো দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নেমে চতুর্থ দিনেই ২৭৩ রান করে ফেললেন। পাকিস্তান থেকে ২৩ রানে পিছিয়ে থাকল বাংলাদেশ। দুইজনই আবার শতক করে ফেললেন। তামিম ১৩৮ ও ইমরুল ১৩২ রানে অপরাজিতও থাকলেন। কী দুর্দান্ত ব্যাটিং! তামিম শুরু থেকেই মারমুখী হয়ে খেলতে থাকলেন। আর ইমরুল আরেক পাশ আগলে রাখলেন। স্কোর বোর্ডেও রান জমা হতে থাকল। একটা সময় গিয়ে পঞ্চম দিনের প্রথম সেশনে দুইজনই ৩০০ রানের জুটিও গড়ে ফেললেন। ক্রিকেট ইতিহাসে যা এর আগে কখনই হয়নি, সেই রেকর্ডই গড়লেন তামিম-ইমরুল। ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে উদ্বোধনী জুটিতে ৩০০ রান এর আগে কখনই হয়নি। তামিম-ইমরুল মিলে সেই অবিরল রেকর্ড গড়লেন। সেই রেকর্ড গড়তে আবার ১৯৬০ সালে যে প্রথম উইকেট জুটিতে ইংল্যান্ডের কাউড্রে ও পুলার মিলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২৯০ রানের জুটি গড়েছিলেন, সেই রেকর্ডও প্রায় ৫৫ বছর পর ভেঙ্গে ফেলেন তামিম-ইমরুল। ইমরুল অবশেষে ৩১২ রানে গিয়ে আউট হয়ে যান। আউট হওয়ার আগেই ২৪০ বলে ১৬ চার ও ৩ ছক্কায় ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন। সেই সঙ্গে শেষ চার ম্যাচে তুলে নেন তিন শতক! এক হাজার রানের ক্লাবেও নাম লেখান। আবার টানা দুই টেস্টে শতক করেন ইমরুল। এর আগে যা করতে পেরেছেন তামিম ও মুমিনুল। তামিম তো চতুর্থ দিনেই শতক করে টানা তিন টেস্টে শতক করেন। বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আর কেউই টানা তিন ম্যাচে শতক করতে পারেননি। সেই সঙ্গে আশরাফুলের ৬ শতকের পর আবার সবচেয়ে বেশি ৭ শতক এখন তামিমেরই ভা-ারে জমা আছে। ইমরুল আউট হওয়ার আগেই তামিম-ইমরুল মিলে বাংলাদেশের হয়ে ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করা পঞ্চম উইকেটে মুশফিক-আশরাফুলের ২৬৭ রানের জুটিও ভেঙ্গে নতুন জুটির রেকর্ড গড়েন। এখন বাংলাদেশের হয়ে যে কোন উইকেটে সবচেয়ে বড় জুটিটি তামিম-ইমরুলেরই। এ দুই ব্যাটসম্যান তো টানা দুই টেস্টে উদ্বোধনী জুটিতে দুই শতক উপহার দেন। ইমরুল আউট হওয়ার পরও তামিম উইকেট আঁকড়ে থাকেন। এর মধ্যে মুমিনুল (২১) আউট হন। দ্বিতীয় উইকেটের পতনও ঘটে যায়। ব্যাট হাতে নামেন মাহমুদুল্লাহ। তামিম-মাহমুদুল্লাহও এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। ৫৪ রানের জুটি গড়তেই বাংলাদেশ ইনিংসের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম আউট হয়ে যান। কী ব্যাটিংই না করলেন তামিম। একটা সময় গিয়ে ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করা মুশফিকুর রহীমের (২০০ রান) ডাবল শতকের পর বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল শতক করে ফেললেন। বল খেললেন ২৬৪। ছক্কা হাঁকিয়েই দুই শ’ রান পূর্ণ করলেন তামিম। আর ৬ রান যোগ করতেই আউট হয়ে গেলেন। এরপর বাংলাদেশ ৪০০ রানও করে ফেলল। পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বোচ্চ স্কোর করে ফেলল। মাঝখানে বৃষ্টি দুইবার বাঁধাও তৈরি করল। হঠাৎ করেই দুটি উইকেটের পতন ঘটে গেল। ৪৬৩ রানে সৌম্য সরকার (৩৩) আউট হতেই ৪৬৪ রানে রানের খাতা খোলার আগেই মুশফিকও আউট হয়ে গেলেন। হাতের আঙ্গুলে ব্যথা নিয়েই মাঠে নামলেন মুশফিক; কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না। ততক্ষণে অবশ্য বাংলাদেশও ১৬৭ রানে এগিয়ে গেল। লিড খুব নেয়া হয়নি। কিন্তু ততক্ষণে দিনের দুটি সেশনও শেষ হয়ে গেল। ম্যাচ সেখানেই শেষ হয়ে গেল। এরপর যে বাকিটা সময় খেলা হলো, সেটি যেন সাকিবের একটি শতক পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু যেই সাকিব ৭৬ রান করলেন, শুভাগত হোমের ব্যাটে রান জমা ২০; তখন দুই দলই সমঝোতায় গিয়ে খেলা শেষ করে দিল। বাংলাদেশ ৬ উইকেটে ৫৫৫ রান করল। পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশ ৫০০ রানের বেশি করল। এর মধ্যে সর্বশেষ দুই ইনিংসে ৩০০ রানের বেশি করার পর পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টেও তাই করল। পাকিস্তানের বিপক্ষে যে রান করল বাংলাদেশ, তা ২০১৩ সালে মুশফিকের ডাবল শতক ও আশরাফুলের ১৯০ রানের ইনিংসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করা ৬৩৮ ও ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করা ৫৫৬ রানের পরের অবস্থানেই থাকল। তবে ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে ব্যাট করে কিন্তু বাংলাদেশ প্রথমবারের মত ৫০০ রানের বেশি করতে পারল। সবকিছু অর্জনের পেছনে কিন্তু দুটি নামই থাকল। একজন তামিম ইকবাল, যিনি ম্যাচ সেরা। আরেকজন ইমরুল কায়েস, যিনি তামিমকে যোগ্য সঙ্গ দিয়ে যা কোনদিন বাংলাদেশ করতে পারেনিÑ তাই করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন। বাংলাদেশ যা করল তাকে অসাধ্য সাধনই বলা চলে। কেউ ভাবেনি এতটা ভাল করতে পারবে বাংলাদেশ। শেষপর্যন্ত সবকিছুকে ভুল প্রমাণ করে তামিম-ইমরুল মিলে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে দিলেন। শুধু কী বাঁচিয়ে দিলেন; যে পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনদিন টেস্ট হার এড়াতে পারেনি বাংলাদেশ- শুধু হেরেই গেছে; সেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ড্র করল। আর তা সম্ভব হলো তামিম-ইমরুলের ব্যাটিং ঝলকানিতেই। এমনটি কিভাবে সম্ভব হলো? ম্যাচ সেরা তামিম ইকবাল বলেছেন, ‘আসলে ওয়ানডে সিরিজে যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেছি, তাতে জিতেছি; সেই বিশ্বাসই টেস্টেও কাজে দিয়েছে। তাছাড়া ২৯৬ রানে শুরুতেই পিছিয়ে পড়ার পর শুরু থেকেই আক্রমণ করেছি। আমি মেরেছি। ইমরুল (কায়েস) নিয়ন্ত্রিত খেলা খেলেছে। সাকিব, মাহমুদুল্লাহও দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছে। তাইজুল অসাধারণ বোলিং করেছে। সবমিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ নৈপুণ্যেই এমনটি হয়েছে।’ বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিক তো যেন স্বপ্ন দেখছেন। তামিম-ইমরুলের ব্যাটিং তার কাছে ‘আনভিলিভ্যাবল’ মনে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘যখন ৩০০ রানের কাছাকাছি লিড হয়ে যায় তখন যে কোন দলের সামনেই চাপ তৈরি হয়। তামিম-ইমরুলই আসলে কৃতিত্ব পাবে।’ পাকিস্তান অধিনায়ক মিসবাহ-উল হক তো একবাক্যে বলে দিয়েছেন- ‘সব কৃতিত্ব ওপেনিং জুটির। তামিম-ইমরুলের।’ সত্যিই তাই। তামিম-ইমরুল যে খেলা দেখালেন, তাতে বাংলাদেশ যে এত কষ্ট করে, কঠিন পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে ম্যাচ হার এড়াল- তাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে এ ম্যাচ ড্র হলো ঠিক; তবে আনন্দ যেন মিলল জয়েরই। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত টেস্ট খেলল ৮৯টি। ৭টি ম্যাচে জিতেছে। ৭০টিতে হেরেছে। ১২টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। এর মধ্যে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৫টি ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২টি ম্যাচে জয় মিলেছে। ১২টি ম্যাচ যে ড্র করেছে বাংলাদেশ- এই ড্র’টি যেন সবচেয়ে বেশি মনের কুঠোয় স্থান করে রাখবে। এমন রাজসিক ব্যাটিং করে, এত কঠিন পরিস্থিতি জয় করে যে কখনই বাংলাদেশ কোন ম্যাচ ড্র করেনি। তাও আবার প্রতিপক্ষ দলটি পাকিস্তান। যে দলের বিপক্ষে তামিম-ইমরুলের ব্যাটিং ঝলকানিতে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ড্র করল বাংলাদেশ।
×