ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৩২শ’ থেকে এখন ১৩ হাজার ২৬৫ মে.ও. বিদ্যুত

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৪ মে ২০১৫

৩২শ’ থেকে এখন ১৩ হাজার ২৬৫ মে.ও. বিদ্যুত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জন্য আরও ৩শ’ ১৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন চারটি বিদ্যুত কেন্দ্র এবং দুটি বৃহৎ উপ-কেন্দ্র উদ্বোধন করে বলেছেন, আমরা (বর্তমান সরকার) তেলে মাথায় তেল দিতে আসিনি। শহরে যারা ভাল আছে তাদের আরও ভাল থাকার সুযোগ করে দিতে নয়, বরং গ্রামাঞ্চলে যারা সুবিধা বঞ্চিত তাদের সুযোগ-সুবিধা ও ভালভাবে থাকা নিশ্চিত করতেই বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরা দেশের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছি বলেই আমাদের সমালোচনা করা হয়। টেলিভিশনের এসিরুমে বসে আমাদের নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলতেনÑ যে গাছ ফল দেয় সেই গাছেই ঢিল পড়ে। নিষ্ফলা গাছে কখনও ঢিল পড়ে না। তাই আমরা সমালোচনা বা অপপ্রচারের দিকে না তাকিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে দিনরাত রবিবার বিকেলে গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও ঘোড়াশালের চারটি বিদ্যুত কেন্দ্র একযোগে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এই চারটি নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র উদ্বোধন ছাড়াও রাজধানী ঢাকার লালবাগে ১৩২/৩৩/১১ কেভি বিদ্যুতের বৃহৎ উপ-কেন্দ্রও উদ্বোধন করেন তিনি। উদ্বোধনকৃত নতুন বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে- নাটোরে ৫২ দশমিক ২০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জের গগনগর ১০২ মেগাওয়াট ফার্নেল অয়েল ভিত্তিক আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্র, নরসিংদীর ঘোড়াশাল ১০৮ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র এবং মুন্সীগঞ্জের কাটপট্টিতে নির্মিত ৫২ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র। একইসঙ্গে মেঘনাঘাট-আমিনবাজার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্পেরও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিদ্যুত ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। বিদ্যুত সচিব মনোয়ার ইসলাম বর্তমান সরকারের মেয়াদে গত ৬ বছরে বিদ্যুত খাতের উন্নয়ন ও বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদনের চিত্র এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, ড. তৌফিক-ই-এলাহী, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সচিব সুরাইয়া বেগম, প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরীসহ বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুত বিভাগ এবং বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিদ্যুত উৎপাদন বাড়াতে তাঁর সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রেখে যাওয়া মাত্র ৩২শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত নিয়ে যাত্রা শুরু করে মাত্র ছয় বছরে দেশ আজ ১৩ হাজার ২৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম। অদূর ভবিষ্যতে মোট উৎপাদন ১৯ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যুত ব্যবহারে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেশি থাকলেই বেশি ব্যবহার সঠিক কাজ নয়। কম বিদ্যুত ব্যবহারে বিল কম হয়, অর্থ ব্যয়ও কম হয়। এতে সাধারণ মানুষের সুবিধাই নিশ্চিত হয়। তিনি বলেন, দেশে এখন সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদন ৭ হাজার ১৭১ মেগাওয়াট পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিদ্যুতের হাহাকার এবং দুর্বিষহ লোডশেডিংয়ের কথা কী সবাই ভুলে গেছেন? দিনাজপুর হচ্ছে সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকা। সেখানে আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করার সময় কেউ কোন কথা বলেনি। আবার যখন বসতিহীন এবং সুন্দরবন থেকে অনেক দূরে রামপালে যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন করার কাজ হাতে নিয়েছি, তখনই তা নিয়ে কত কথা? আমি জানি কী তাদের দুঃখ? আমরা কেন সকল সমস্যার সমাধান করছি, দেশের উন্নয়ন করছি- এটাই তাদের দুঃখ। ভারত থেকে আমরা বিদ্যুত আমদানি করছি এটাও তাদের দুঃখ। তিনি বলেন, আমরা এত বেসরকারী টিভির লাইসেন্স দিলাম। আসলে উপকারীদের মনে রাখে কে? এখন সেসব টিভি চ্যানেলে গিয়ে এয়ারকন্ডিশন রুমে বসে আমাদের নিয়ে সমানে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুত না থাকলে কী হতো। এখন বিদ্যুতের কোন সমস্যা নেই বলেই এত কথা। ভবিষ্যতে বাসাবাড়িতে গ্যাসের লাইনের বদলে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা বাসাবাড়ির বদলে বাণিজ্যিক অর্থাৎ কল-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করে উৎপাদন বাড়াতে চাই। সৌর বিদ্যুত নিয়েও তাঁর সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সৌর বিদ্যুতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। আগামীতে সকল সেচ পাম্পগুলো যাতে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে সেই উদ্যোগ নিয়েছি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আমরা কয়লা আমদানি করব। এছাড়াও পরমাণুভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে এই খাতে বিদ্যুত উৎপাদন প্রথমে দুই হাজার এবং পরে ৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বাড়ানো হবে। ভারত থেকে এরই মধ্যে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া আগরতলা থেকে পাওয়া যাবে এক শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত। বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান এই চতুর্দেশীয় উদ্যোগের মাধ্যমে জলবিদ্যুত উৎপাদন এবং আমদানির পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে বিদ্যুত ও গ্যাস আমদানিরও পরিকল্পনা রয়েছে। একটি আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করেই এই বিদ্যুত নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, এই উপমহাদেশে অন্য দেশ থেকে বিদ্যুত আমদানি বাংলাদেশই প্রথম শুরু করেছে। আমরা তা করতে পেরেছি। তিনি বলেন, দেশের এখন ৭০ ভাগ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমাদের গৃহীত অনেক প্রকল্প বিএনপি সরকার বন্ধ করে দেয়। তাদের ৫ বছর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছর এই সাত বছরে এতটুকু বিদ্যুত উৎপাদন হয়নি। বিদ্যুত উৎপাদন না করে বিএনপি খাম্বা লিমিটেড গড়ে তুলে। কারণ বিএনপি নেত্রীর ছেলে খাম্বার ব্যবসা করতেন। তাই ওই সময় মানুষ বিদ্যুত পায়নি, শুধু পেয়েছে খাম্বা। আমরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আবার অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিদ্যুত সমস্যার সমাধান করেছি। দেশে মোট ৬৯টি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এগুলো করতে গিয়ে সরকারকে নানামুখী সমালোচনায় পড়তে হয়েছে। সমালোকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এর একেকটি বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে সঠিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে কত কর্মযজ্ঞ চালাতে হয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই সকলকে দিনরাত শ্রম দিতে হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, আর এ কারণেই দেশবাসী আজ বিদ্যুত পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশের প্রতিটি অঞ্চলকে উন্নত করতে এই বিদ্যুতের কোন বিকল্প নেই। আর সে কারণেই নতুন নতুন কেন্দ্র তৈরি করে উৎপাদনের উদ্যোগ। উন্নয়নকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব স্থানে গ্যাস ও বিদ্যুতের সুবিধা থাকবে সেখানে ভারি শিল্পও গড়ে উঠতে পারে। এতে দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। গ্রামাঞ্চলের মানুষও উন্নত জীবন পাবে। তিনি বলেন, আমরা সারাদেশের উন্নয়ন চাই। গ্রামের মানুষ যাতে ভাল থাকে তাদের জীবনমান ভাল হয় সেটাই আমাদের লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঘোড়াশালবাসীর উদ্দেশে আরও বলেন, আজ সরকার তার প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথে এগিয়ে চলছে। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে চার স্থানের মানুষের সঙ্গে একযোগে কথা বলা যাচ্ছে। এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশ। এ সময় সরকারের ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ আর ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে নাটোরে সংসদ সদস্য অধ্যাপক গোলাম কুদ্দুছ, নারায়ণগঞ্জের শামিম ওসমান এমপি, নরসিংদীতে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, মুন্সীগঞ্জে এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি ও মহিউদ্দিন আহমেদ এবং লালবাগে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে কথা বলেন। মৃণাল কান্তি দাস ও মহিউদ্দিন আহমেদ মুন্সীগঞ্জের পূর্ব নির্ধারিত স্থানেই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে আর হবে না, বিমানবন্দর হবে পদ্মানদীর ওপারেই। শামিম ওসমান নারায়ণগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেসরকারীভাবে কেউ বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করতে চাইলে অনুমতি দেয়া হবে।
×