ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উদ্বেগ জানানোর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে সরকার

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৫ মে ২০১৫

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না

রশিদ মামুন ॥ সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে না জানিয়ে জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি জাতিসংঘের কাছে পাঠানো এক চিঠির সঙ্গে বিদ্যুত বিভাগ রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রর পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনও পাঠিয়েছে। রামপাল কেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতির বিষয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে বিদ্যুত বিভাগ ওই চিঠি দেয়। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, দেশের পরিবেশবাদীরা রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রর বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। এর পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারলেও নানাভাবে বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণ বন্ধ করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করছে। শুধু দেশেই নয় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন জাতিসংঘ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রর বিরোধিতা করে চিঠি পাঠিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সুন্দরবনের উপর বিদ্যুত কেন্দ্রর কি প্রভাব পড়বে তা জানতে চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বনটি ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যর অংশ। বিদ্যুত কেন্দ্র হলে বিশ্বঐতিহ্যর কী ক্ষতি হতে পারে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের এমন উদ্বেগে জাতিসংঘ বিষয়টি জানতে চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি লেখে। বিদ্যুত বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, জাতিসংঘের চিঠিতে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রথমটি বিদ্যুত কেন্দ্রটির পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি (ইআইএ) করা হয়েছে কি না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সুন্দরবনের মধ্যে কয়লা পরিবহনের জন্য ড্রেজিং করা হলে এর কী প্রভাব পড়বে এবং তৃতীয়টি হচ্ছে বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সুন্দরবনের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বলেন, রামপাল কেন্দ্রর জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়েছে। চিঠির সঙ্গে পুরো প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখানেই প্রকল্পর সকল দিক সম্পর্কে বলা রয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি পরিবেশ এবং প্রতিবেশের উপর কী কী প্রভাব ফেলতে পারে তা সমীক্ষাতেই রয়েছে। বিভিন্ন ক্ষতি কী ভাবে কমানো যায়, কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে রয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে নদী খনন করলে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়েও বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি পৃথক সমীক্ষা করেছে। জাতিসংঘের কাছে পাঠানো চিঠির সঙ্গে ওই সমীক্ষাটিও দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে অর্থাৎ ৫০ বা ১০০ বছর পর এতে সুন্দরবনের উপর কি প্রভাব পড়বে তা পরিমাপের ব্যবস্থা বাংলাদেশের নেই। তবে একটি বিদ্যুত কেন্দ্রর মেয়াদ সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর হয়ে থাকে। এই সময়ে সুন্দরবনের উপর কি প্রভাব পড়বে না পড়বে তা পরিবেশগত সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে। জানানো হয়েছে ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) এর মতো খ্যাতনামা কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে। এই এলাকায় বৃহৎ কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ এবং পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও রয়েছে। আর ভারতীয় কোম্পানি সুন্দরবনের ক্ষতি হয় এমন উদ্যোগের সঙ্গে নিশ্চয়ই থাকবে না। বিদ্যুত সচিব মনোয়ার ইসলাম এ প্রসঙ্গে জানান, যে কোন কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রে নির্মাণই পরিবেশের উপর কিছু না কিছু প্রভাব পড়ে। কিন্তু পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সীমিত রাখার জন্য এখন উন্নত প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে। সরকার এখানে উন্নত প্রযুক্তি এবং ভাল মানের কয়লা ব্যবহারের বিষয়ে সর্বোচ্চ সচেতন অবস্থায় রয়েছে। রামপালে অধিকাংশই সরকারী খাস জমি। খুব কম সংখ্যক মানুষকে পুনর্বাসন করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ খুব ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় জমির বিষয়টি সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। কয়লা পরিবহনের জন্য পানির নির্দিষ্ট গভিরতা থাকতে হয়। তা না হলে বড় জাহাজ কয়লা নিয়ে আসতে পারে না। যেখানে তেমন গভিরতা রয়েছে সেখানেই কেবল এ ধরনের কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব। অনেক বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই রামপালকে বিদ্যুত কেন্দ্রর জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ বলছে সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে খুলনা বিভাগের তিনটি সম্ভাব্য স্থান থেকে রামপালকে সর্বোত্তম উপযোগী স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা সুন্দরবনের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকে ৭২ কিলোমিটার এবং সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সামাজিক এবং কারিগরি অর্থনৈতিক উপযোগিতা যাচাইয়ের পর পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ইআইএ করা হয়। আন্তর্জাতিক পেশাদার কোম্পানি দিয়ে ইআইএ করা হয়েছে। সরকার ইআইএ’র উপর কোন হস্তক্ষেপ করেনি। ইআইএ পর্যালোচনা করে পরিবেশ অধিদফতরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। ইআইএ’র উপর ভিত্তি করে বিদ্যুত বিভাগ বলছে প্রয়োজনীয় পানি পশুরনদী হতে রিসাইকেল পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবহার করা হবে। যা পশুরনদীর গড় প্রবাহের দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ। উত্তোলিত পানি রিসাইকেল করার পর পরিবেশ অধিদফতরের বিধিবদ্ধ তাপমাত্রা সীমার মধ্যে পুনরায় পশুরনদীতে ছাড়া হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটিকে অত্যাধুনিক স্টেট অব দি আর্ট পদ্ধতি অনুসরণে আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। ফলে অধিক দক্ষতাসম্পন্ন হবে এবং উন্নত মানের ও কম পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হবে। কেন্দ্রটির জন্য ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) সকস নিঃসরণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে হবে যা পরিবেশের উপর আদৌ কোন প্রভাব ফেলবে না। তাছাড়াও নক্স নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য লো নক্স বার্নার ব্যবহার করা হবে। প্রযুক্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর উন্নত দেশেও পরিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নেয়া হয় না। যা রামপালের ক্ষেত্রে হয় নেয়া হয়েছে। রামপাল কেন্দ্র নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করেছে ইন্ডিয়া বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি। সরকার চাইছে দ্রুত কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করতে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পর তালিকায় রামপাল রয়েছে। সরকারের পরিকল্পনায় থাকা বড় বিদ্যুত কেন্দ্রর মধ্যে সব থেকে আগে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে রামপাল কেন্দ্রটির। এই কেন্দ্রর জন্য ইতোমধ্যে ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে। ইন্ডিয়া বাংলাদেশের যৌথ মালিকানায় বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০১৮ সালে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণে ৩০ ভাগ অর্থ বাংলাদেশ এবং ভারত ব্যয় করবে। বাকি ৭০ ভাগ অর্থ ঋণ নেয়া হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
×