ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম. নজরুল ইসলাম

নির্বাচন বর্জন বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৬ মে ২০১৫

নির্বাচন বর্জন বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল

তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল মঙ্গলবার। এই নির্বাচন যেমন বহু প্রতীক্ষিত ছিল, তেমনি জনপ্রত্যাশারও সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে নির্বাচনী ফলে। আন্দোলনের নামে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারা, মানুষের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার যে অপরাজনীতি এই সিটি নির্বাচনে ভোটাররা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পক্ষেই তাদের অবস্থান। নির্বাচন শেষে ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাসির উদ্দিনকে বেসরকারীভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এই তিনজনই প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের মাঝখানে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল ও কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে যা ঘটেছে, যেমন এই অভিযোগ পাল্টাঅভিযোগ, বিএনপির এই নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা, সেই সঙ্গে মনজুর আলমের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা- এককথায় এসবই চরম হতাশাব্যঞ্জক। এই নির্বাচন নিয়ে এমনিতেই অনেক সংশয় ছিল। কারণ এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও একে জাতীয় নির্বাচনে রূপ দিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিন সিটি নির্বাচন অনেকটাই যেন জাতীয় নির্বাচনের প্রক্সিতে পরিণত হয়েছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ, অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবর ও দেশের টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার দেখে মনে হয়েছে, যে ফল হয়েছে এটাই কাক্সিক্ষত ছিল। এটাও ঠিক যে, দুই একটি গণমাধ্যম নির্বাচনের এই ফলে একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এসব গণমাধ্যমের গাত্রদাহও অপ্রকাশিত থাকেনি। কিন্তু এই নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না, এ কথা বলা যাবে না। বরং বলা যেতে পারে, কোন সদিচ্ছা নিয়ে নয়, বিএনপি এই নির্বাচনে এসেছিল একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বলির পাঁঠা হয়েছে অন্তত দুজন। একজন তাবিথ আউয়াল, যিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে। অন্যজন চট্টগ্রামের সদ্য সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম। মনজুর আলমের দুর্ভাগ্য. তিনি বিএনপির এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেননি। ফলে অভিমানে ও হতাশায় রাজনীতি থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ঐ ঘোষণার সময় তাঁর অশ্রুসজল চোখই বলে দেয়, দল তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে সবার কাছেই তাঁর এই ঘোষণা বিস্ময়ের। কারণ নির্বাচনের শুরু থেকে ভোটগ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন। তাবিথ আউয়ালের কথা ভিন্ন। তাঁর বাবা আবদুল আউয়াল মিন্টু ঢাকা উত্তরে মেয়র প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল। সেভাবে তিনি মনোনয়নপত্র দাখিলও করেছিলেন। যে ছোট ভুলের কারণে মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়, সে ভুলটি কিন্তু তাবিথ করেননি। মিন্টু পরে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাতে লাভ হয়নি। পুরো ব্যাপারটিকে লোক দেখানো বলে মনে হয়েছে। আর শেষে ভোটের মাঝখানে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণায় বাবার বলির পাঁঠা হতে হয়েছে ছেলেকে। নির্বাচন বর্জন করে হয়ত বিএনপি আন্দোলনের বড়ি আবার নতুন করে জনগণকে গেলানোর চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি নেতাদের কথোপকথন ফাঁস হয়ে যাওয়ায় দলটি বিপদে পড়েছে। ঐ কথোপকথনে স্পষ্টই নির্বাচন বর্জনের বিষয়টি উঠে এসেছে। নির্বাচন নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহের কমতি ছিল না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো থেকে মাঝপথে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সরে দাঁড়ানোর ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। তিনি বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতও বিএনপির সরে দাঁড়ানোকে দুঃখজনক বলেছেন। হোক বিভক্ত, তারপরও একযুগ পর ঢাকায় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। চট্টগ্রামেও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশেই চলে নির্বাচনী প্রচার। আশঙ্কা যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। সব শঙ্কা দূর করে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রথমে চট্টগ্রামে ও পরে ঢাকায় বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দেয়। চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নিজেকে রাজনীতি থেকেও গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি সমর্থিত সব মেয়র প্রার্থীই সকালে নিজ নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে সংবাদ মাধ্যমের কাছে নির্বাচন সম্পর্কে নিজেদের আশা ও আস্থার কথাও তুলে ধরেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসে। তফসিল ঘোষণার পর যে পরিবেশ তিন সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দেখা গেছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। যদিও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সমর্থিত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যাই ছিল বেশি। নিজেদের দলের মধ্যেই সংঘর্ষ ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে কেবল নিজেদের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদেরই প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। কাউন্সিলর প্রার্থীদের নয়। নির্বাচনে গোলযোগ হয়নি, এমন কথা বলা যাবে না। কোন কোন কেন্দ্রে বলপ্রয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি কোন কোন কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে জোর করে সিল মারার অভিযোগ এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। বিষয়টি হতাশাজনক। কিন্তু অন্য যে কোন নির্বাচনের তুলনায় তা খুব একটা বেশি নয়। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। এত তাড়াতাড়ি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে বিএনপির সরে যাওয়ার ঘোষণা পর্যবেক্ষক মহল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখছে বলে মনে হয় না। নির্বাচন বর্জনের প্রস্তুতি আগেভাগেই বিএনপি নিয়ে রেখেছিল, এমন অভিযোগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের। এ অভিযোগ বোধহয় অমূলক নয়। অন্তত টেলিফোন কথোপকথন, সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় এ অভিযোগের সত্যতা অনেকটাই প্রমাণ হয়ে গেছে। ‘কেন্দ্র ২৭০০, হাঙ্গামা ৫৫টিতে’-এই শিরোনামে ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, ‘বিচ্ছিন্ন কিছু গোলযোগের ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। ঢাকার দুই সিটির এক হাজার ৯৮২টি কেন্দ্রের মধ্যে গোলযোগ হয়েছে অর্ধশত কেন্দ্রে। দুই সিটিতে মোট ভোটার ৪২ লাখের বেশি। বিপরীতে হাঙ্গামা হওয়া কেন্দ্রগুলোতে মোট ভোটার এক লাখের বেশি নয়। ঢাকায় তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া ২৫টির মতো কেন্দ্রে সাময়িকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কোন কেন্দ্রেই ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়নি। এখানে মোট ভোটার ১৮ লাখ ১৩ হাজার আর মোট কেন্দ্র ৭১৯টি। বিপরীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটেছে হাতেগোনা কয়েকটি কেন্দ্রে, যেখানে ভোটার সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ হাজার।’ উপরন্তু আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসে বিএনপি অফিস থেকে। ঘোষণা দেন মওদুদ আহমদ। অতীতে এই ধরনের নির্বাচনে কেন্দ্রে বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ছিল নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এবারের সিটি নির্বাচনে সেই পরিবেশ খুব একটা দেখা যায়নি। স্বাভাবিক কারণেই ধরে নেয়া হয়েছিল একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়া যাবে। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট বর্জন দেশের মানুষকে নতুন এক শঙ্কার মধ্যে ঠেলে দিল। এখন দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অপরাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। হতে পারে তিন সিটি নির্বাচন বর্জন বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু এই কৌশল কাজে লাগিয়ে বিএনপি যাতে নতুন করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী [email protected]
×