ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বদেশ রায়

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গোঁফে তা

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ৭ মে ২০১৫

 রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গোঁফে তা

এক স্পোর্টস এডিটরকে দেখতাম তাঁর লেখায় যে কোন খেলায় তিনি বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের ভুল-ত্রুটি ধরতেন। কোন দোষ নেই তাতে। আমার মতো সাধারণ সাংবাদিক থেকে দেশসেরা বুদ্ধিজীবীরাও রাজনীতিবিদদের কত দাওয়াই না দেন। আর দর্শক, পাঠক এমনকি দেশের এক শ্রেণীর মানুষ সেই সব দাওয়াই শুনে রাজনীতিবিদদের কাউকে পরম শ্রদ্ধা করেন। কারও চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। তাদেরকে যদি কানে কানে জিজ্ঞেস করা হয়, বাপজান রাজনীতির মাঠে অভিজ্ঞতা কি? তিনি যদি ঢাকাইয়া কুট্টি ঘোড়াগাড়ি চালকের মতো বুদ্ধিমান হন তাহলে খুব আস্তে কানের কাছে মুখ এনে বলবেন, আস্তে কই, শুনুন, উত্তর শুনলে ঘোড়ায় হাসব! ওইদিকে আমি কেন, আমার ঘোড়াও কোনদিন যায়নি। যা হোক, তারপরেও একদিন কৌতূহলে ওই স্পোর্টস এডিটরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই আপনি জীবনে কোন কোন খেলায় অংশগ্রহণ করেছেন? তিনি অনেক চেষ্টা করে মনে করলেন, প্রাইমারী স্কুল জীবনে একবার বিস্কিট দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। এরপরে আর সাহস পাইনি প্রশ্ন করতে, জিতেছিলেন কিনা? তবে ওই দিন ওয়াশরুমে ঢুকে নিজের কান নিজে মোচড় দিয়েছিলাম, না, আর খেলা নিয়ে লিখব না। কারণ তাহলে হয়ত ভবিষ্যতে বিশ্বসেরা কোন পত্রিকার স্পোর্টস এডিটর হয়ে যেতে পারি। যেহেতু জীবনে আমি কোন দিন কোন খেলার মাঠে নামিনি। ছোটবেলাও কেটেছে বাড়ির পাঁচিলের ভেতর। সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে দৌড়টি দেবারও সুযোগ পাইনি। তাই সম্ভাবনা আমার উজ্জ্বল। এর আগের সাংবাদিকতা জীবনের কথা মনে করলে দেখতে পাই কাকে না নিয়ে লিখিনি? টাইগার পতৌদি, সুনীল গাভাস্কার, জিওফ বয়কট, মাইকেল ব্রির্য়ালি, আসিফ ইকবাল, জহির আব্বাস, গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথাম, চন্দ্রশেখর । ক্রিকেটের এ ফিরিস্তি লিখতে গেলে অনেক লম্বা হবে। এদের নিয়ে কত না জ্ঞানগর্ভী (!) লেখা লিখেছি নামে-বেনামে। শুধু কি এক ক্রিকেটে থেমে ছিলাম- তাও নয়, লন টেনিসের বিওন বোর্গ, ব্যাডমিন্টনের রুদি হারিহন্ত, প্রকাশ পাড়েকুন, সৈয়দ মোদি সবাইকে নিয়ে লিখেছি। আর এখন যেমন সদাশয় গুগল বাবাজী আছেন, সব বলে দেন। তখনও কিন্তু একেবারে অসহায় ছিলাম না। হাজারটি স্পোর্টস পত্রিকা বের হতো। তার ভেতর একটু বাড়তি সুবিধা ছিল, এক জ্যাঠাতো ভাইয়ের কারণে। বেচারা, কলকাতার বিএনআর-এ চান্স পাবার পরে জ্যাঠামহাশয় মারা যান। যেহেতু তাঁর প্রতিভা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের লাইনের নয়। বেচারা অঙ্কে ভাল নয়। তাই চৌদ্দ বছরে বিএনআর-এ চান্স পেলেও তাকেই পরিবারের সব থেকে অপগ- হিসেবে ধরা হয়। তাঁর শিক্ষা জীবনের ও খেলোয়াড় জীবনের ইতি ঘটিয়ে সংসারের বোঝা ওই কিশোরের ঘাড়ে তুলে দেয়া হয়, পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে। সংসারের বোঝা তাঁর খুব ভারি ছিল না। কারণ, পৈত্রিক ও পিতার পৈত্রিক সূত্রের সম্পত্তি তাকে কেবল অবকাশ দিয়েছিল আর দিয়েছিল মনের গভীরের একটি গভীরতম ব্যথা। হয়ত সকাল-বিকেল তার পা নিশপিশ করত। আর ওই পা ঠা-া রাখার জন্যে তিনি দুনিয়ার সব স্পোর্টস ম্যাগাজিনের গ্রাহক হন। প্রায় প্রতিদিনই ডাকপিয়নকে তাঁর পত্রিকার বোঝা নিয়ে আসতে হতো। চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা জ্ঞানে ওই সব পত্রিকা থেকে মেরে দিয়ে রাতারাতি স্পোর্টস বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতাম। তারপরে জীবনের চলার পথে একদিকে ভাইটি যেমন আত্মহনন করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল- অন্যদিকে, ওই স্পোর্টস এডিটরের কাছ থেকে পেলাম দিব্য দৃষ্টি। শেষ হয়ে গেল খেলা নিয়ে মাতামাতির অধ্যায়। তবে সংবাদ মাধ্যমে থাকলে, সংবাদ থেকে তো আর দূরে থাকা যায় না। এর পরে এই খেলা নিয়ে পেলাম গভীরতম একটি দুঃখ। শুধু দুঃখ বললে ভুল হবে; অপমান। সালটি ঠিক মনে নেই। তবে সম্ভবত তখন বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। দেশের বাইরে কোথায় যেন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একটি খেলা। পাকিস্তান দলের ক্যাপ্টেন তখন ইমরান খান। মাঠের বাইরে পায়ের ওপর পা তুলে বসে ইমরান জানালেন, বাংলাদেশ দলের সঙ্গে তিনি টস করতে রাজি নন। বরং নান্নুকে ডেকে শোনা হোক, তারা কী চায়, বোলিং না ব্যাটিং? নান্নু হাজার হোক বাঙাল পোলা। রক্তে তার পদ্মা-মেঘনার স্রোতের ডাক। সে বলল, না টস করতে হবে। খেলা আমরা যাই খেলি না কেন। ইমরান বললেন, তিনি বাংলাদেশ দলের সঙ্গে টস করতে মাঠে যাবেন না। মাঠের বাইরে টস করতে হবে। ইমরান খান তখন দুনিয়া কাঁপানো খেলোয়াড়। তাই আয়োজক প্রতিষ্ঠান মেনে নেয় তার প্রস্তাব। টস হয় মাঠের বাইরে। এই খবর একজন ক্রীড়া সংগঠকের মাধ্যমে পেয়েছিলাম গাজী ভবনে বসে। চিরকুমার, সকলের বন্ধু সেই ক্রীড়া সংগঠকও পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। সেদিন যেমন অপমানে নিজের চোখের কোনায় পানি নেমে এসেছিল, ক্রীড়া সংগঠক বন্ধু মিন্টুর চোখের কোণও গিয়েছিল ভিজে। তবে সেদিন মিন্টুকে সান্ত¡না দিয়েছিলাম আমার ওই জ্যাঠাতো ভাইয়ের একটি কথা বলে। সে আমাকে ৮০ সালেরও আগে বলেছিল, ‘দেখ স্বদেশ, বাংলাদেশ কিন্তু ফুটবলের অনেক আগে ক্রিকেটে বিশ্বসভায় যাবে।’ ইমরান খান বাংলাদেশকে এভাবে অপমান করার পরে শুধু যে অপমানিত হই তা নয়, পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের সম্পর্কে ধারণাও বদলে যায়। কারণ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নরহত্যা, নারী ধর্ষণের পরেও যেমন আমাদের কবি ফয়েজ আহ্্মদ, ওয়ালি খান, আসমা জাহাঙ্গীর প্রমুখের ওপর একটি শ্রদ্ধা আছে তেমনি অনেক পাকিস্তানী ক্রিকেটারকেও কিন্তু শ্রদ্ধা করতাম। যেমন শ্রদ্ধার একজন ছিলেন, আসিফ ইকবাল। যতদূর জানি ভদ্রলোক পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত, অক্সফোর্ড বা ক্যাম্ব্রিজ কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে খেলেছেন তাঁর ছাত্র জীবনে। তাছাড়া আরও একটি বিষয় ছিল, তখন পাকিস্তান দলের ক্রিকেটাররা প্রায়ই আসতেন বড় বড় ফ্যামিলি থেকে। তাই পারিবারিক একটি ভদ্রতা তাদের ছিল। তারা আর যাই হোক কেউ ইমরান খানের মতো অসংস্কৃত ছিলেন না। যাহোক, এর অনেক পরে বিশ্বকাপে নান্নুর ব্যাটিং যেদিন পাকিস্তানকে পরাজিত করে সেদিন বার বার মনে হয়েছিল, নান্নুর রক্তে আজ কি সেই আশির দশকের অপমানের প্রতিশোধের আগুন লেগেছে? তবে তারপরেও অনেক কাল কেটে গেছে। আজ এ লেখা যখন লিখছি, তখন আমাদের ছেলেরা পাকিস্তানের সঙ্গে খেলছে। এর আগের টেস্টে দাপটে খেলে তারা ড্র করেছে। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে তারা পাকিস্তানকে সব খেলাতে হারিয়েছে। এ মুহূর্তে যে খেলা খেলছে তার শেষ হবে পাঁচ দিন পরে। এ খেলায় হার-জিত যে কোন একটি হতে পারে। কিন্তু এ খেলার ফল যাই ঘটুক না কেন, এখন ইমরান খান কেন, তার থেকে অনেক বড় অল রাউন্ডার ইয়ান বোথাম, এমনকি সর্বকালের সেরা অল রাউন্ডার গ্যারি সোবার্সও যদি ফিরে আসেন কোন দলের ক্যাপ্টেন হয়ে (সোবার্স ও বোথাম আমাকে মাফ করবেন, শুধু বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্যে আপনাদের নাম ব্যবহার করেছি, তাছাড়া আপনাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি জানি) ফিরে আসেন তারাও কিন্তু কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না বাংলাদেশকে মাঠের বাইরে টস বলার কথা। বরং তাদের চিন্তা থাকবে, জিততে পারব কিনা? তাছাড়া ইমরানের দেশের ক্রিকেট দল এখন শুধু একটি বিধ্বস্ত দল নয়, তার দেশও বিধ্বস্ত দেশ। তারা খেলোয়াড়দের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এখন তার দেশের খেলোয়াড়দের সব ধরনের সাপোর্ট দিতে পারে। আর শেখ হাসিনার সরকারের মতো সরকার যদি সব সময় ক্ষমতায় থাকে তাহলে এই সাপোর্ট এ গতিতে বা আরও গতিতে এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে, গত বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেভাবে খেলছে, তাতে এখন সব দেশের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পৃথিবীর সব দেশই বাংলাদেশকে সমীহ করে খেলবে। খেলায় যে দুটি ফল আছে, হার ও জিত। এর যে কোনটা যে কোন সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে যাবে। এখন বিবিসির স্পোর্টস নিউজের নানান খবরে আমরা দেখতে পাই অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিং-এর এক নাম্বারে আছেন সাকিব। গত টেস্টে বিশ্ব রেকর্ড করলেন তামিম এবং ইমরুল কায়েস। এগুলো কেমন যেন শরীরে শিহরণ জাগায়। আর এখন বাংলাদেশের খেলা দেখে আফসোস্ হচ্ছে, যদি সেদিন নিজের কানে নিজে মোচড় না দিতাম বা যদি ওই বয়স থাকত তাহলে আজ কী আনন্দ হতো! আজ আর আমাকে ইয়ান বোথাম, জিওফ বয়কট, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, রডনে হগ, গ্রেগ চ্যাপেল বা রিচার্ড হ্যাডলিকে নিয়ে লিখতে হতো না। মহাআনন্দে সাকিব, তামিম, ইমরুল, মুশফিক, সৌম্যকে নিয়ে লিখতে পারতাম। সেদিক থেকে ভাগ্যবান এখন যারা স্পোর্টস রিপোর্টার তাঁরা। কারণ তাঁরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী যে, তাঁরা কেবল বাংলাদেশের যে সেক্টরটি বিশ্বমানের ওই সেক্টরের নিউজ করেন। শুধু তাই নয়, আগামীতে তাঁরা যখন বিশ্বসভায় নিউজ কাভার করতে যাবেন তখন অন্যরাও তাঁদেরকে সমীহ করবেন, ভাববেন এদের দলটি যে কোন মুহূর্তে বিশ্বসেরা হতে পারে। তবে ওই একটি কথা আছে না, যাদের ভূতের ভয় তারা দিনের বেলাও ভূত দেখেন। নিজের ছায়ার ভেতরও ভূত দেখেন। ঠিক সেই অবস্থা হয়েছে আমাদের মতো মানুষদেরও, যারা আমরা রাজনীতি ও পলিটিক্যাল অর্থনীতি নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করি। সব কিছুর ভেতর ওই রাজনীতি আর অর্থনীতি দেখতে পাই। আর এই ভূতটি কিন্তু একেবারে অমূলক নয়, অশরীরীও নয়। দেশে অন্তত একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আছে যারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ পরিচালনায় ভাল কিছুই দেখতে পায় না। ওই পত্রিকাটি নিউজ করেছে, শহরের বাচ্চারা মুটিয়ে যাচ্ছে। এর একটি কারণ অর্থনৈতিক উন্নতি। প্রচুর প্রোটিন পাচ্ছে তারা। বাস্তবে সব সাফল্যের মূলটি এখানে, রাষ্ট্র যখন সঠিক ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিচালনা করে তখন দেশের বাচ্চাদের মতো অর্থনীতিও মোটা হয়। শুধু বাচ্চারা নয়, সব ক্ষেত্রেই প্রোটিন জোটে। দেশের সব সেক্টরই এগিয়ে যায়। ক্রিকেট এখন শুধু বিশ্বসভায় নয়, বিশ্বসেরার রেসে। কখন বিশ্বসেরা হবে তা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফুটবল সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে। হঠাৎ কখন সেও বিড়াল থেকে বাঘ হয়ে যাবে। সার্বিক বিচারে অর্থনীতি এখনও এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার। আগামী দশ বছর বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতো নেতৃত্ব যদি দেশ পরিচালনা করে তাহলে দশ বছর পরে চীন ও ভারত নামক দুটি এশিয়ান অর্থনৈতিক টাইগারের মাঝখানে দি রয়েল বেঙ্গল টাইগারও গোঁফে তা দেবে। [email protected]
×