ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লোকসভায় আজ উঠতে পারে

ভারতের রাজ্যসভায় ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত বিল পাস

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৭ মে ২০১৫

ভারতের রাজ্যসভায় ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত বিল পাস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভারতের রাজ্যসভায় ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত বিল পাস হয়েছে। বুধবার দেশটির রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপনের পরে তা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। রাজ্যসভায় বিলটি পাসের পরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার ভারতের লোকসভার অধিবেশনে বিলটি চূড়ান্তভাবে পাস হবে বলে জানা গেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিলটি পাসের জন্য বুধবার রাজ্যসভায় উত্থাপন করেন। দুপুরে রাজ্যসভায় বিলের ওপর আলোচনা শুরু হয়। এই বিল আলোচনার জন্য তিন ঘণ্টা সময় বরাদ্দ ছিল। তবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা আলোচনার পর বিকেলে বিলটি পাস হয়। রাজ্যসভার ২৪৫ জন সদস্যের মধ্যে ১৮০ জন সদস্য বুধবারের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সদস্যদের সকলেই বিলটির পক্ষে ভোট দেন। বিলটির বিপক্ষে কোনো ভোট পড়েনি। বিলটি পাসের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রাজ্যসভায় বলেন, এই বিল পাসের মাধ্যমে প্রতিবেশী দু’দেশের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হবে। একইসঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন এর মাধ্যমে লাভবান হবে। রাজ্যসভায় পেশকালে বিলটি পাসের বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করেন সুষমা স্বরাজ। এছাড়া অসমকে বাদ দিয়ে বিলটি কেন আনার চেষ্টা করা হয়েছিল সে বিষয়েও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। এদিকে ভারতের রাজ্যসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি পাসের পরে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংসদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্থল সীমান্ত চুক্তি পাসের প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ অভিনন্দন জানান। প্র্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান বাধা কেটে গেছে। আশা করছি বাকি প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত সম্পন্ন হবে। এর মাধ্যমে দু’দেশের ছিটমহলে যেসব নাগরিক আছেন, তারা তাদের নাগরিক অধিকার ফিরে পাবেন। ভারতের রাজ্যসভার চলতি অধিবেশন শেষ হবে আগামী ১৩ মে। আর লোকসভার চলতি অধিবেশন শেষ হবে ৮ মে। সে কারণে লোকসভার চলতি অধিবেশনের মেয়াদ রয়েছে মাত্র দু’দিন। আজ বৃহস্পতিবার লোকসভায় বিলটি পাসের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিলটি লোকসভায় পাসের জন্য এখন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সই নিতে হবে। রাজ্যসভায় বিলটি পাসের পরে বিজেপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বুধবার রাতেই এই বিলে রাষ্ট্রপতির সই নেয়া হবে। আর সেটি সম্ভব হলে আজ বৃহস্পতিবারই বিলটি পাস হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দুই দেশের ছিটমহল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে মঙ্গলবার ভারতের মন্ত্রিসভায় সীমান্ত বিল অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে দিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান হতে চলেছে। ছিটমহলে বসবাসকারী নাগরিকরা তাদের অবরুদ্ধ জীবন থেকে পাবেন মুক্তি। তাদের পরিচয় সঙ্কটও ঘুচবে। সব কিছু ঠিক থাকলে আজ বৃহস্পতিবার লোকসভায় চূড়ান্তভাবে স্থল সীমান্ত বিল পাস হবে। অসমকে বাদ রেখে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। মঙ্গলবার অসমকে রেখেই সীমান্ত বিলের অনুমোদন দেয়া হয় ভারতের মন্ত্রিসভায়। প্রধানমন্ত্রী মোদির সভাপতিত্বে ভারতের মন্ত্রিসভায় সীমান্ত বিল অনুমোদনের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রটোকল ভারতের লোকসভায় বৃহস্পতিবার অনুমোদন দেয়া হবে। ভারতের লোকসভার অধিবেশনে সংবিধান সংশোধনের জন্য ‘দি কন্সটিটিউশন (ওয়ান হান্ড্রেড এ্যান্ড নাইনটিনথ এ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৫’ উত্থাপিত হবে। এই বিল পাস হলে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের দুঃখ ও যন্ত্রণার অবসান ঘটবে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা ও দিল্লী সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ সেই বছরই চুক্তিটি অনুস্বাক্ষর করে। এরপর ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভারত কোনটিতেই অনুস্বাক্ষর করতে পারেনি। বিগত কংগ্রেস আমলে বিরোধীদল বিজেপি ও অসম গণপরিষদ এই বিলের বিরোধিতা করে বলেছিল, ছিটমহল বিনিময় হলে যে পরিমাণ জমি হাতবদল হবে, তাতে ভারত প্রায় দশ হাজার একর বেশি জমি হারাবে। এরপর নানা তৎপরতায় বিজেপি শেষ পর্যন্ত নরম হলেও অসম গণপরিষদের সঙ্গে যোগ দেয় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন। সে হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে ওঠে স্থল সীমান্ত চুক্তি। বিলটি উত্থাপন করতে গিয়ে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ বিরোধিতার মুখে পড়েন। এর আগে সে বছরের মে ও আগস্ট মাসে আরও দুই দফা এই বিলটি উত্থাপনের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন তিনি। সে সময় তিনি বিরোধীদের তোপের মুখেও পড়েন। সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সফরের সময় সেদেশের সরকারী দল বিজেপি এবং বিরোধী দল কংগ্রেসের একাধিক নেতার সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আলোচনা করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদকে জানান, রাজ্যসভায় স্থায়ী কমিটির সাবেক মন্ত্রী শশী থারুরের নেতৃত্বে পুনর্গঠন করা হয়। কমিটিতে তিন মাস ধরে আলোচনার পর সীমান্ত বিল চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, বিলটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম নবী আজাদও জানিয়েছিলেন, তার দল বিলটি পাসের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা বিলটি বিবেচনা করবে। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অসমকে বাদ রেখে বিলটি লোকসভায় অনুমোদনের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। তবে শেষ পর্যন্ত অসমকে রেখেই স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে ভারতের মন্ত্রিসভা। অসম বিজেপির পক্ষ থেকে স্থল সীমান্ত চুক্তির বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতার মুখে চুক্তি থেকে অসমের ছিটমহলগুলো বাদ দেয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিবেচনা করেছিলেন। তবে স্থল সীমান্ত চুক্তি থেকে অসমকে বাদ না দিতে মোদিকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। অসমকে বাদ দিলে রাজ্যসভায় এ বিল পাসে সমর্থন দেয়া হবে না বলে ইঙ্গিত দেয় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। শেষ পর্যন্ত সোমবার রাতে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের বাসভবনে এক বৈঠকে অসমকে রেখেই প্রস্তাবটি পাসের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। অসম বিজেপির সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যসহ দলের সাংসদরাও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী মোদির সভাপতিত্বে মঙ্গলবার ভারতের মন্ত্রিসভা সংবিধান সংশোধনের খসড় প্রস্তাব অনুমোদন করে। পঞ্চগড় থেকে এ রহমান মুকুল জানান, বুধবার বোদা উপজেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত কাজলদিঘী ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। আনন্দে ভাসছে গোটা ছিটমহলের মানুষ। গাঁয়ের বধূরাও ঘর থেকে বের হয়ে দু’হাত তুলে মহান আল্লাহ-রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করছেন। আবেগে উদ্বেলিত হয়ে পঞ্চাশোর্ধ তবিবর রহমান উচ্চস্বরে বলেন, শেখের বেটির আল্লাহ মঙ্গল করুক। শেখের বেটির জন্যই আজ আমরা একটি দেশ পাচ্ছি, একটি পতাকা পাচ্ছি। আমরা এখন সকলেই বাংলাদেশী। কেউ আমাদের আর অন্য দৃষ্টিতে দেখবে না, আমরাও এখন স্বাধীন-স্বার্বভোম বাংলাদেশের নাগরিক। কাজলদীঘি গ্রামের স্বামী পরিত্যক্ত রহিমন বেওয়া বলেন, বেঁচে থাকতে পরিচয়টা পেলাম। এখন মরলেও দুঃখ নেই। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (আমাদের) ছিটমহলের লোকজনদের অনেক উপকার করেছেন। ওনার জন্যই আমরা আজ একটা দেশের নাগরিক হতে পারছি। আল্লাহ ওনার হায়াত দারাজ করুক। উনি যেন আরও অনেকদিন দেশের মানুষের সেবা করতে পারেন এই দোয়াই করছি। ভারত-বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাদের নাগরিক পরিচয় নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নসহ নানাবিধ বঞ্চনার শিকার এসব ছিটমহলবাসীদের নেই কোন দেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম আর সব পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং অপরিবর্তিত আকারেই বিলটি অনুমোদিত হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেছেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় বিলটি লোকসভায় পাস হবে। কেউ বিরোধিতা করবেনা। পৃথিবীর ইতিহাসে স্থল সীমান্ত বিলটি একটি বিরলতম ঘটনা হয়ে থাকবে বলে তিনি আশা করছেন।
×