ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর এম শামসুর রহমান

স্মরণ ॥ বিজ্ঞানসাধক ওয়াজেদ মিয়া

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৯ মে ২০১৫

স্মরণ ॥ বিজ্ঞানসাধক ওয়াজেদ মিয়া

বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ জামাতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ মিয়ার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৯ সালের ৯ মে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি ১৯৫৬-৫৮ সময়কালে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজে আবদুল ওয়াজেদের সহপাঠী। সৃজনশীল মেধাসম্পন্ন এক সহপাঠীর প্রয়াণে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ি। আমরা দু’জনই বিজ্ঞানের ছাত্র। ওয়াজেদ পড়তেন ‘বি’ সেকশনে। আমি ‘এ’ সেকশনে। তিনি থাকতেন কলেজ হোস্টেলের ‘এ’ ব্লকে। আমি ‘ই’ ব্লকে। আমরা উত্তরবাংলার বাসিন্দা। তাঁর বাড়ি রংপুরে। আমার নওগাঁয়। আজও চোখে ভাসছে, ছিপছিপে গড়নের লম্বা শ্যামবর্ণের এক ছেলে। স্বল্পভাষী। শান্ত স্বভাবের মানুষ। ক্লাসে যাচ্ছেন। ক্লাস থেকে হেঁটে হোস্টেলে ফিরছেন। ওই বয়সেই তাঁর মধ্যে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈচৈ করতেও দেখিনি তাঁকে। পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল তাঁর সাদামাটা। পাজামা পরতেন। ফুলপ্যান্টের ধারে কাছেও ঘেঁষেননি। শীতকালে ক্লাসে আসা-যাওয়ার সময় তাঁর পরনে দেখতাম গরম কাপড়ের ফুলহাতা শার্ট। কোট, জ্যাকেট তো দূরের কথা সোয়েটারও পড়তেন না তিনি। হোস্টেলে গায়ে গরম চাদর জড়িয়ে থাকতেন। বলা যেতে পারে, ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন সহজ, সরল এক আদর্শ শিক্ষার্থী। পঞ্চাশের দশকের রাজশাহী কলেজ শিক্ষকদের ক’জনইবা বেঁচে আছেন। মনে পড়ে এ মুহূর্তে, শ্রদ্ধাভাজন নিবেদিতপ্রাণ তিনজন শিক্ষকের কথা। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার ও অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী। কবীর চৌধুরী স্যার আমাদের পড়াতেন ড্রামা ‘আব্রাহাম লিংকন’। সাত্তার স্যার ‘ত্রিকোণমিতি’। ড. আশরাফ সিদ্দিকী স্যার ‘জমিদার দর্পণ’। প্রথম দু’জনই লোকান্তরিত হয়েছেন। ইন্টারমিডিয়েটের পর ওয়াজেদ মিয়া অনার্স পড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। আমি গণিতে অনার্স রাজশাহীতেই থেকে গেলাম। উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা ফের আলাদা হয়ে পড়লাম। ওয়াজেদ বার্মিংহামে এলেন। আমি এলাম লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ যাবত অধ্যাপনা করলাম নাটোর নবাব সিরাজউদৌল্লা কলেজে, রাজশাহী, ইসলামাবাদ (পাকিস্তান), ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ট-ওয়েস্ট ও আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এ। ড. ওয়াজেদ ঢাকার বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগ দেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন। দেখতাম ঘন ঘন রং চা পান করছেন। এক সময় বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির সভাপতি পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। আমি হলাম বাংলাদেশ গণিত সমিতির সভাপতি (২০০৮-২০০৯ কার্যকাল)। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইতালির ত্রিয়েস্তের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্রের সম্মানজনক এসোসিয়েট মেম্বারে ভূষিত হয়েছিলেন ড. ওয়াজেদ। আমারও সৌভাগ্য হয়েছে ওই আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের এসোসিয়েট মেম্বার হওয়ার (১৯৯০-৯৫)। বন্ধুবর সহপাঠী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার ব্যক্তিত্বের আলো ও মাধুর্য আর আদর্শ চরিত্র মুগ্ধতায় ভরে দিত সকলের মনপ্রাণ। তিনি দীর্ঘজীবন লাভ করেন। জীবনযুদ্ধে জয়ী হন। জয়ী হয়েছেন বিজ্ঞানের জন্য উজ্জীবিত কর্মের সাধনায়। আমরা তাঁকে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। তাঁর আত্মার পরলৌকিক শান্তি কামনা করছি। শোকাহত স্বজনদের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা। জীবনমাত্রেরই মৃত্যু বিশ্বশ্রষ্টার এক অমোঘ বিধান। কবির ভাষায়, ‘জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে’। তাই মহৎ কীর্তির উৎকর্ষেই বৈশিষ্ট্যম-িত হয়ে, মরণকে বরণ করে, আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর রইবেন রংপুর পীরগঞ্জের ফতেপুর গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত সর্বজনপ্রিয় ‘সুধা মিয়া’। লেখক : শিক্ষাবিদ
×