ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিনন্দন টিউলিপ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১০ মে ২০১৫

অভিনন্দন টিউলিপ

ব্রিটেনের রাজনীতিতে বাঙালীদের অবস্থান দৃঢ় হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। সেই অবস্থান আরও শক্ত করে দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। ব্রিটেনের নির্বাচনে রীতিমতো চমক দেখিয়ে প্রথমবার নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। লেবার পার্টির এমপি হিসেবে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসনের প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি। ১১৩৮ ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছেন তিনি। বাংলার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক পেয়েছেন ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির সাইমন মার্কাস পেয়েছেন ২২ হাজার ৮৩৯ ভোট। নিজেদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবেই ভাবতে যাঁরা ভালবাসেন, গ্লোবাল ভিলেজ মতবাদের পক্ষেই তাঁদের অবস্থান। বিশ্ব নাগরিকত্বের পথে নিজেকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য এখন বিলেতের রাজনীতিতে রীতিমতো প্রভাব বিস্তার করতে আসছিলেন অনেক আগে থেকেই। সদ্যসমাপ্ত ব্রিটিশ জাতীয় নির্বাচনে পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিম-লে বাঙালীর জয়যাত্রায় নতুন সারথি হলেন তিনি। ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত টিউলিপ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করলেন। টিউলিপকে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসনের ভোটাররা তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। একজন প্রবাসী বাঙালী হিসেবে ভাবতে গেলে গর্বে বুক ভরে যায়। টিউলিপ সিদ্দিক হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির হয়ে এবারের নির্বাচনে লড়েছেন। মার্জিনাল আসনে থাকলেও নির্বাচনী প্রচারে তার পক্ষে ভাল সাড়া মিলে। গত বছর মে মাসে কাউন্সিল নির্বাচনে এই আসনে আগের তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছে লেবার পার্টি। পার্লামেন্ট নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটলে টিউলিপ বড় ব্যবধানে লেবার পার্টির এই আসন ধরে রাখবেন বলে নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা আগেই আভাস দিয়েছিলেন। গত পার্লামেন্ট নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী গ্লেন্ডা জ্যাকসন এই আসন থেকে মাত্র ৪২ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। কাজেই আসনটি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু আশাবাদী টিউলিপ এবার নির্বাচনী এলাকা হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নে সমর্থক ও ভোটারদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। কিলবার্ন হাই রোডে স্থানীয় লেবার পার্টির অফিসের ভেতরে নির্বাচনী টিমের সদস্যরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করেছেন। ভোটের ফলে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। এবারের নির্বাচনে টিউলিপের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ছিলেনÑ কনজারভেটিভের সায়মন মার্কাস, লিব ডেমের মাজিদ নওয়াজ ও ইউকেআইপির ম্যাগনাস নিলসেন। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ ভোটের আগে সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে নির্বাচন খুবই চ্যালেঞ্জিং।’ সেই চ্যালেঞ্জ নেয়ার সাহস দেখাতে পেরেছেন তিনি। পেয়েছেন উপহার। এমপি গ্লেন্ডা অনেক বিখ্যাত এবং পরিচিত একজন ব্যক্তি। সেই তুলনায় একেবারেই নতুন টিউলিপ সিদ্দিকের এই বিজয় প্রবাসীদের জন্য তো বটেই সব বাঙালীর জন্যই আনন্দের ও গর্বের। যে আসন থেকে নির্বাচিত হলেন টিউলিপ সিদ্দিক, সেই হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্নে ১৫ বছর বয়স থেকে বসবাস করছেন টিউলিপ। এই এলাকায় স্কুলে পড়েছেন ও কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত এবং সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গবর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী রয়েছে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন অথরিটি এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে কাজ করেন টিউলিপ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন তিনি। ২০১০ সালে তিনি ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালী নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। টিউলিপ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সন্দেহ নেই, বঙ্গবন্ধুও চাইতেন, বাঙালী তার জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা নিয়ে জেগে উঠুক এবং বিশ্ব জাতীয়তার মোহনায় আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে মিলিত হোক। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ছেলেমেয়েরা তাঁর সেই সাধই পূর্ণ করেছে বলে মনে হয়। যদি তা না হতো তাহলে বিলাতে বাস করে, উচ্চশিক্ষা লাভ করে, চারদিকে এত অর্থবিত্তের পেশা থাকতে টিউলিপ রাজনীতিকে তার পেশা হিসেবে গ্রহণ করত না।’ বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং আদর্শই যে তাঁর চরিত্র গঠন করেছে, কিছুদিন আগে টিউলিপ সে কথা অকপটে বলেছেন লন্ডনের সান্ধ্য দৈনিক ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে। তাঁর বক্তব্য, ‘গ্রান্ডফাদারের আদর্শই আমার চরিত্র গঠন করেছে। পারিবারিক ঐতিহ্যই আমাকে একজন স্ট্রং সোস্যালিস্টে পরিণত করেছে।’ টিউলিপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ দিলে হয়ত অনেকে খুশি হতেন। বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর মতো উচ্চশিক্ষিত, সমাজতন্ত্র ও সেকুলারিজমে বিশ্বাসী নেতাকর্মীর বিশেষ প্রয়োজন। রাজনীতি ও সমাজকর্মে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন নানামুখী কাজের ভেতর দিয়ে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সেভ দ্য চিলড্রেন, বেথনাল গ্রিন এ্যান্ড বো আসনের সাবেক লেবার এমপি ওনা কিং, টুটিং এলাকার লেবার এমপি ও সাবেক মন্ত্রী সাদেক খান, লেইটন ওয়ানস্টেড এলাকার সাবেক লেবার এমপি হ্যারি কোহেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। ক্যামডেন ও ইজলিংটন এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের গবর্নর, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন ইউকের সদস্য ও এমপি টিসা জোয়েলের পলিসি এ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। লেবার নেতা এড মিলিব্যান্ডের লিডারশিপ ক্যাম্পেনের ফিল্ড ডেপুটি ডিরেক্টর ছাড়াও লন্ডন লেবার পার্টির প্রেস অফিসার, গ্রেটার লন্ডন অথরিটির রিসার্চার হিসেবে কাজ করার ব্যাপক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তিনি। প্রবাসে থেকেও যে জনকল্যাণে কাজ করা যায়, যুক্ত হওয়া যায় রাজনীতিতে তা প্রমাণ করেছেন টিউলিপ। বলেছেন, মানুষের সেবা করা যায় যে কোন স্থানে থেকেই। অনেকে মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশে এসেও তো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারতেন টিউলিপ। ভূমিকা রাখতে পারতেন দেশের উন্নয়নে। যেমনটি রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। নবনির্বাচিত এমপি টিউলিপ সিদ্দিক যদি ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি পাকা আসন তৈরি করতে পারেন, তাহলে তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও সুদূরপ্রসারী ও শুভ প্রভাব বিস্তার করবে। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক নিষ্ঠার পরিচয় এই বয়সে তাঁর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। সমাজতন্ত্র ও বাম চিন্তা-চেতনার স্পষ্ট বিকাশ তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বিলাতে বিজয় পতাকা উড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাঙালীকে নতুন ইতিহাসের সঙ্গী করলেন টিউলিপ। আবারও অভিনন্দন তাঁকে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী ও মানবাধিকারকর্মী হধুৎঁষ@মসী.ধঃ
×