ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সঞ্চয়পত্রে সুদ হ্র্রাস ॥ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপেষু

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৫ মে ২০১৫

সঞ্চয়পত্রে সুদ হ্র্রাস ॥ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপেষু

এবারের বাজেট আলোচনার একটা বড় ইস্যু সুদের হার (ইন্টারেস্ট রেট)। সুদের হার মানে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এবং ঋণের ওপর সুদের হার। এই ইস্যুতে সোচ্চার আমাদের এক শ্রেণীর ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ী বন্ধু ও ভাইয়েরা। সঞ্চয়পত্রের সুদের ইস্যু পরে, আগে দেখা যাক ঋণের ওপর সুদের ইস্যুটি যাকে বলা হয় লেন্ডিং রেট। ‘লেন্ডিং রেট’ নিয়ে যারা কথা বলছেন তার প্রধানতমদের একজন হচ্ছেন ‘এফবিসিসিআই’-এর প্রেসিডেন্ট সাহেব। তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি এবং যুক্তিবাদী লোক। আমরা অবাক হই যখন তিনি এই দাবি সরকারের কাছে করেন। তিনি একটা ব্যাংকের মালিক এবং প্রভাবশালী মালিক। তাঁর ব্যাংকটিও বড় এবং ভাল বেসরকারী ব্যাংক বলেই জানি। এমতাবস্থায় তিনি কেন সরকারের কাছে দাবি করছেন ‘লেন্ডিং রেট’ কমানোর জন্য- এ কথা বুঝতে আমি অক্ষম। কারণ সুদের হার কমানো বা বাড়ানোর দায়িত্ব সরকারের নয়। এমনকি এই কাজটি করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও নয়। ১৯৯৩ সালের আগ পর্যন্ত সুদের হার ঠিক করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হার, এমনকি বিভিন্ন রকম ‘চার্জের’ হার, ‘কমিশনের’ হারও ঠিক করত বাংলাদেশ ব্যাংক। সকল ব্যাংককে সেই হার বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হতো। এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না। এর জন্যই তখনকার আমলে ব্যাংকে ব্যাংকে কোন প্রতিযোগিতা ছিল না। ১৯৯১ সালে ‘ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্ট’ প্রবর্তিত হওয়ার পাশাপাশি শুরু হয় ব্যাংকের সংস্কার এবং ‘ ডিরেগুলেশন’ ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বস্তুত সকল নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়েছে। সুদের হার নির্ধারণের সর্বময় ক্ষমতা এখন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ডের হাতে। বোর্ড ইচ্ছা করলে প্রতি সপ্তাহে, প্রতিমাসে সুদের হার কমাতে বা বাড়াতে পারে। এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বা সরকারের কোন অনুমোদন লাগে না। বস্তুত সরকার অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ক্ষেত্রে কোন করণীয় নেই। এ প্রেক্ষাপটে ‘এফবিসিসিআই’ প্রেসিডেন্ট সাহেবকে প্রশ্ন- তিনি অহেতুক এই দাবি কেন করছেন। এই দাবি না করে তিনি তো সোজা একটা ‘বোর্ড সভা’ ডাকতে পারেন তার নিজের ব্যাংকে এবং এক মিনিটের মধ্যে ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়ে দিতে পারেন ইচ্ছামতো। এই কাজটি না করে তিনি প্রতিদিন সরকারের কাছে সুদের হার কমানোর জন্য দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন। যদি এমন হতো যে, তিনি তার ব্যাংকে ‘লেন্ডিং রেট’ কমিয়েছেন, আর সরকার তাতে বাধা দিচ্ছে তখন তিনি দেশবাসীর কাছে বিচার চাইতে পারতেন। এমনটা তো হচ্ছে না। এটা কি দ্বিচারিতা নয়, এটা কি উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানো নয়? শুধু ‘এফবিসিসিআই’ প্রেসিডেন্ট নন, আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আরও কয়েকজন বড় বড় ও বিখ্যাত ব্যবসায়ীকে যারা একই দাবি করে যাচ্ছেন। টেলিভিশন খুললেই তাদের ছবি। তা হতেই পারে। তারা বড় ব্যবসায়ী,। দেশটা তাদেরই, যে দাবি তারা করেন। অথচ দেখতে পাচ্ছি তারাও ব্যাংকের মালিক। নাম বললে সুবিধা হতো। তা আমি করছি না। তাদের একজন দেশের পুরনো ও নামজাদা চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি একটা ব্যাংকের মালিক। আরেকজন আছেন সম্মানিত সংসদ সদস্য। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য। আরেকজন বিদেশী কোম্পানির পণ্য আমদানি করে এখন বিশাল বড় ব্যবসায়ী। এরা সবাই আবার ব্যাংকের মালিক। তাদের মুখেও একই কথা ‘লেন্ডিং রেট’ কমাতে হবে। সকলের কাছে বিনীতভাবে আমার নিবেদন, আপনারা দয়া করে যার যার ব্যাংকের বোর্ড সভা ডাকুন এবং ‘লেন্ডিং রেট’ কমান। আশার কথা, মাননীয় অর্থমন্ত্রীও তাদের একই কথা শুনিয়েছেন। এখন আমাদের অপেক্ষার পালা- দেখব যুগপৎ ব্যাংকের মালিক ও গার্মেন্টস ইত্যাদি ব্যবসা ও বীমা-লিজিং কোম্পানি মালিকরা কখন ‘লেন্ডিং রেট’ কমান। ‘লেন্ডিং রেট’ কমানোর দাবির সঙ্গে সঙ্গে ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীদের একাংশ আরেকটি দাবি তুলেছেন এবং মনে হচ্ছে, সরকার এই দাবির কাছে নতিস্বীকার করতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দাবিটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদের হার। ব্যবসায়ীদের মতে সঞ্চয়পত্রের সুদ বেশি। এ কারণে ব্যাংকের অসুবিধা হচ্ছে। সঞ্চয়কারীরা বেশি সুদের আশায় সঞ্চয়পত্র কিনছেন, ব্যাংকে আমানত রাখছেন না। ধরে নিই তাদের অভিযোগ সত্য- সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে আমানত রাখছেন না। এখন প্রশ্ন, ব্যাংকের মালিকরা আমানত দিয়ে কী করবেন? এমনিতেই ব্যাংকে ব্যাংকে আমানতের টাকায় সয়লাব। পুরো ব্যাংকিং খাত অতিরিক্ত তারল্যে ডুবে আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে ব্যাংকে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নতুন নতুন উদ্যোগে এগিয়ে আসছেন না। বিপরীতে তাঁরা দুটো কাজ করছেন। বড় বড় ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে ঋণ আনছেন। সেখানে সুদের হার কম। আরও খারাপ খবর আছে। বিদেশী ব্যাংক থেকে ঋণ এনে অনেকে তা দেশে মেয়াদী আমানত হিসাবে রেখেছেন। এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের শাসিয়েছে। কেউ কেউ আবার বিদেশী ঋণে স্বদেশী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছেন। অথচ তাদের করার কথা শিল্পের সম্প্রসারণ। এত অন্যায় ও অনিয়ম করে এখন তারা সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর চড়াও হয়েছেন। তারা দেশে বিনিয়োগের কথা উঠলে বলেন ‘জমি দেন’, আমরা শিল্প করে ভাসিয়ে দেব। জমির কথা বলেন এমন ব্যবসায়ী, যার জমি বাংলাদেশব্যাপী। ভদ্রলোকের কাজই হচ্ছে টাকা কামাই করা আর জমি কেনা। তিনি শিল্প করেছেন এমন উদাহরণ বিরল। বস্তুত ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা বড় তাদের এমন কেউ কি আছেন যাদের বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও শত শত একর জমি নেই? নাম ধরে আলোচনা করতে পারলে আরও ভাল করে বোঝাতে পারতাম। যাদের নেশাই হচ্ছে জমি কেনা, জমি কিনে বেড়া দিয়ে রাখা। এরাই টেলিভিশনে এসে সরকারের কাছে জমি চান এবং বলেন শিল্প করে ফাটিয়ে দেব, জমি দেন। সরকার তাদের দাবির সামনে চুপ থাকে। আবার দেখা যায় অনেক ব্যবসায়ী বিদেশে শিল্প করার অনুমতি চান। বিষয়টিই আমি বুঝি না, দেশে নানা অজুহাতে যারা শিল্প করতে চান না তারা বাইরে শিল্প করার অনুমতি চান আর বলেন, ‘লেন্ডিং রেট’ কমান, সঞ্চয়পত্রের সুদ কমান ইত্যাদি ইত্যাদি। যাই হোক ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার মনে হয় সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমাচ্ছে গড়ে দুই শতাংশ হারে। ঘটনাক্রমে এরমধ্যে পড়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রবর্তিত বিশেষ ধরনের সঞ্চয়পত্র-পরিবার সঞ্চয়পত্র। নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে এবং সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমের আওতায় প্রবর্তিত পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হবে বলে জানা যাচ্ছে। বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র বাজারে চালু আছে। এর সঙ্গে আছে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মেয়াদী হিসাব। ২০১২ সালের একটা সরকারী বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ হচ্ছে ১২ দশমিক ২০ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এক দশমিক ২৫ শতাংশ ‘সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম’ হিসাবে। এর থেকে বাদ দেয়া হয়েছে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ উৎসে কর্তিত আয়কর হিসাবে। অতএব, নিট সুদের হার হচ্ছে ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সরকার যদি এর ওপর দুই শতাংশ সুদ কমায় তাহলে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই ওঠে। সরকার কি ‘সামাজিক নিরাপত্তার’ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবে? সামাজিক নিরাপত্তা খাতে শুনতে পাচ্ছি দিন দিন বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে। এর আওতা বর্তমানের থেকে আরও বড় হবে। তাহলেই প্রশ্ন : সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমানো কেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, নারীর ক্ষমতায়ন। ‘নারীর ক্ষমতায়নের’ কাজটি কি শেষ হয়ে গেছে? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, ‘চিলে কান কেটে দিয়েছে’ এই প্রপ্রাগান্ডার শিকার হচ্ছে সরকার। সরকারকে বলব একটা কাজ করতে। কাজটা গবেষয়ার। দেখা হবে সঞ্চয়পত্রের ক্রেতা কারা। এরা কি ব্যবসায়ী, এরা কি ধনাঢ্য লোক? এরা কি শিল্পপতি? এরা কি গার্মেন্টসের মালিক? দেখা যাবে এরা অবসরপ্রাপ্ত লোকজন- সরকারী ও বেসরকারী খাত থেকে। দেখা যাবে এরা বিশাল সংখ্যায় নারী। মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা নারী, প্রবাসী বাঙালীর স্ত্রী, মাতা বা ছেলেমেয়ে সঞ্চয়পত্রের ক্রেতা। যারা চাকরি করেন তারাও সঞ্চয়পত্র কেনেন ‘কর রেয়াত’ পাওয়ার জন্য। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এরাই সঞ্চয়পত্রের ক্রেতা। আমি বার বার বলছি এই শ্রেণীর লোক হাত পাততে পারে না। ‘ট্রাক সেলে’র ক্রেতা এরা নন। অথচ এরা সংখ্যায় বিশাল। এরাই আবার বাংলাদেশের বাজার (মার্কেট)। যে ‘বাজার অর্থনীতি’, ‘বাজার অর্থনীতি’ আমরা করি তার প্রধানতম স্তম্ভ হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। যারা কেনে তারা ওই শ্রেণীর লোক। এদের আয় কমিয়ে অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রে সুদ হ্রাস করে পরিণামে সরকারের কোন লাভ হবে না। দৃশ্যত মনে হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ইস্যুটি ‘এ্যাকাউন্ট্যান্টদের’ হাতে পড়েছে যারা ‘দুইয়ে দুইয়ে’ চার করেন। ‘দুইয়ে দুইয়ে’ সমাজবিজ্ঞানে সব সময় চার হবে না। যেখানে লাখ লাখ পরিবারের স্বার্থ জড়িত, যেখানে ‘মার্কেট’কে টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন, যেখানে সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন, সেখানে ‘এ্যাকাউন্ট্যান্সির’ দৃষ্টিকোণ প্রলয় ডেকে আনবে। এমতাবস্থায়, আমি বিষয়টির প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শেষ বিচারে তারই আসবে-যাবে’, আর কারও নয়। অতএব, তিনি সঞ্চয়পত্রের ইস্যুটিকে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে দেখবেন বলে আশা করি। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×