ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অবৈধ অভিবাসী ধরপাকড়ে অভিযানে নামছে মালয়েশিয়া

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৬ মে ২০১৫

অবৈধ অভিবাসী ধরপাকড়ে অভিযানে নামছে মালয়েশিয়া

ফিরোজ মান্না ॥ মালয়েশিয়ার উপকূলে সাগরে ভাসা অভিবাসীদের ভিড়তে না দিয়ে উল্টো দেশটির কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসী আটকের জন্য বিশেষ অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে নামবে বলে খবর মিলেছে। অভিযানে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে সাগর তীরবর্তী এলাকা। দেশটির পুলিশ মনে করছে, সাগর পথে যারা মালয়েশিয়ায় এসেছে- তারা উপকূলবর্তী শহরগুলোতেই রয়েছে। তারা কোন অবৈধ অভিবাসীকে স্থান দেবে না বলে ইমিগ্রেশন পুলিশ এমন ঘোষণা দেয়ার পর দেশটিতে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। একদিকে হাজার হাজার মানুষ সাগরে ভাসছেÑ তাদের কূলে ভিড়তে না দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে গভীর সাগরে। আবার স্থলভাগে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ঘোষণায় দেশটির বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন এ যেন ‘মরার ওপর খড়ার ঘা’। এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘আমরা মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি যাতে জি টু জি পদ্ধতিতে (সরকার টু সরকার) কর্মী নিয়োগ বন্ধ না হয়। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, বৈধ পথে কর্মী নিযোগ বন্ধ করবে না। জি টু জি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে কোন অসুবিধা হবেন। অবৈধ পথে কর্মী যাওয়ার কারণে দেশটিতে শ্রমের বাজার কিছুটা মন্থর হয়েছে এটা ঠিক। তবে সার্বিকভাবে বাজারটি ভালই আছে। আমরা চেষ্টা করছি বৈধ পথে বেশি কর্মী পাঠানোর। যাতে সাগর পথে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে কাউকে না যেতে হয়।’ মালয়েশিয়ায় একজন অভিবাসী কর্মী টেলিফোনে জানান, এবার বিদেশী অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে দেশটির কর্তৃপক্ষ অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। অভিযানে দেশটির কয়েকটি সংস্থা অংশ নেবে বলে জানিয়েছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোন কারণ জানায়নি। তবে দেশটির সরকার বলছে, তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে কোন অবৈধ অভিবাসীকে থাকতে দেয়া হবে না। অবৈধদের বৈধ হওয়ার জন্য পাঁচ দফায় সুযোগ দেয়ার পরও যারা এই সুযোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরত যেতেই হবে। পুলিশের হাতে আটক হলে জেল জরিমানা হতে পারে। এমন কি জেল জরিমানা হওয়ার পর ছাড়া পেয়ে নিজ খরচে দেশে ফিরতে হবে। দেশটির কর্তৃপক্ষ এবারের অভিযান কঠোর হাতে চালাবে। অভিযানের বিষয়টি জানার জন্য মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়টি অফিসিয়ালী জানানো হয়নি। তবে এখানে প্রতিনিয়ত অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলে। এটা তাদের ‘রুটিন ওয়ার্ক’। অবৈধ হলে হাইকমিশনের কিছু করার থাকবে না। তবে কোন বৈধ কর্মী আটক হলে সেক্ষেত্রে হাইকমিশন তাদের পাশে দাঁড়াবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়ার সরকার অবৈধ কর্মীদের পাঁচ দফা সুযোগ দেয়ার পরও যারা বৈধ হতে পারেনি এ দায় তাদেরই নিতে হবে। সরকার এ দায় নেবে না। তবে যদি কোন বৈধ কর্মী পুলিশের হাতে আটক হন সেক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত হাইকমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার। যারা অবৈধ হিসেবে পুলিশের হাতে আটক হবেন তাদের একটা না একটা শাস্তি পেতেই হবে। দেশটির আইনে অবৈধদের জেল জরিমানা হতে পারে। অথবা শুধু জেল হতে পারে। আবার জরিমানা হলে সেই টাকা পরিশোধ করে নিজ খরচে দেশে ফিরতে হবে। এখানে মন্ত্রণালয়ের কোন কিছু করার নেই। সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের আটক করতে পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম করেছে দেশটির সরকার। প্রয়োজনে পুলিশের টিম আরও বাড়ানো হতে পারে। অবৈধ কর্মীদের যেখানে দেখা যাবে সেখান থেকেই তাদের আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার মহাসড়ক, দোকান এবং জনসাধারণের চলাচল আছে এমন সব জায়গায় অভিযান চালানো হবে। পুলিশের বিশেষ টিমগুলো বিদেশী কর্মীদের থাকার জায়াগাগুলোতেও ‘রেইড’ দিয়ে কর্মীদের পারমিট এবং কর্মস্থলের বৈধতা আছে কিনা তাও যাচাই বাছাই করবে। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের পর দেশটি বিদেশী অবৈধ কর্মীদের ‘আউট পাস’ নিতে শুরু করেছেন। এ দফায় পুলিশী অভিযানে পুলিশকে জেল, জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দালাল চক্র দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ পথে হাজার হাজার মানুষকে মালয়েশিয়া নিচ্ছে। তাদের ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার বৈধ পথে বন্ধ থাকার কারণে পাচার চক্র এই সুযোগটি বেছে নেয়। তারা সারাদেশে কয়েক হাজার দালাল তৈরি করে মানুষ পাচার করে যাচ্ছে। এ কারণে মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। পাচার রোধে অনেক আগে থেকেই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিকার হয়নি। এখন থাইল্যান্ডে গণকবর আবিষ্কার আর সাগরে হাজার হাজার মানুষ ভাসার কারণে তারা নড়েচড়ে বসেছে। জানা গেছে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে ৩০টির বেশি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। দেশ থেকে মানুষকে ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে সাগর পথে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে স্থাপিত ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন করে মুক্তিপণের জন্য। মুক্তিপণ পেলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয় অথবা মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেয়। যারা মুক্তিপণ দিতে পারে না তাদের ধুঁকে ধুঁকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে বন্দী শিবিরে কত সংখ্যক মানুষ এভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর ঘটনা সাগর তীরে হলে লাশ ভাসানো হয় সাগরের পানিতে আর জঙ্গলে হলে ফেলা হয় গণকবরে। থাইল্যান্ডের দুর্গম পাহাড়ী বন্দী শিবিরে মুক্তিপণ, নির্যাতন, খাদ্যাভাব আর মৃত্যুর ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে।
×