ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গাছে গাছে ঝুলছে বেড়ে ওঠা বাহারি আম

সারি সারি আমের বাগানে সুরভিত বরেন্দ্র ভূমি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৯ মে ২০১৫

সারি সারি আমের বাগানে সুরভিত বরেন্দ্র ভূমি

মামুন-অর-রশিদ ॥ রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে এক সময় যে জমিতে চাষ হতো শুধুই ধান, এখন ধানের পাশাপাশি সেই জমিতে গড়ে উঠেছে আমের বাগানও। ধান চাষ আর পাশাপাশি আমের বাগানে এখন সবুজ দৃষ্টিনন্দন উঁচু নিচু বরেন্দ্রভূমি। যতই দিন যাচ্ছে এ অঞ্চলে আমের আবাদী জমির পরিমাণ ও ফলন ততই বাড়ছে। ধান চাষের পাশাপাশি আম নিয়ে এখন নতুন আশায় উদ্বেলিত রাজশাহীর কৃষকদের মন। ইতোমধ্যে ক্ষেতের ধান উঠে গেছে এখন আম নিয়ে ব্যস্ততা। গাছে গাছে থোকায় ঝোলা সবুজ আম ক্রমেই আকার পরিবর্তন হচ্ছে। আর কদিন পরই এসব আম উঠবে বাজারে। আম নিয়ে কর্মযজ্ঞ তাই শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। আসছে আমের মৌসুম। কয়েকদিন পরই পাকা আমের সৌরভে মাতোয়ারা হবে চারদিক। পুষ্টিসমৃদ্ধ আমের রয়েছে চমৎকার স্বাস্থ্য উপকারিতা। একে ফলের রাজাও বলা হয়ে থাকে। স্বাদের দিক থেকে এটি শুধু সুস্বাদু ও তরতাজাই নয়, এই ফলের অনেক ভাল গুণ রয়েছে। রাজশাহীজুড়ে সারি সারি আম গাছে এখন ঝুলছে নানা জাতের আম। পথের পাশে দৃষ্টি দিলেই থোকায় থোকায় সবুজ আম নজর কাড়বে সবার। এমন দৃশ্য এখন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জুড়ে। এ দুই জেলার আমের সুখ্যাতি দেশজুড়ে। অসংখ্য জাতের আম হয় এ দুই জেলায়। সেই আম বাহারি রসালো, মিষ্টি ও সুস্বাদু। আর কদিন পরই এসব জাতের আম বাজারে উঠতে শুরু করবে। এরই মধ্যে গুটি জাতের বিভিন্ন আম বাজারে উঠার অপেক্ষায় রয়েছে। ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, খিরসা, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লকনা মোহনভোগ আর রানীপছন্দ আম শোভা পাচ্ছে গাছে গাছে। দিন যত যাচ্ছে গাছে গাছে বড় হচ্ছে সেগুলো। আমকে ঘিরে এখনই রাজশাহীতে শুরু হয়েছে ‘আম উৎসবের’ প্রস্তুতি। ফলের মাস জ্যৈষ্ঠ চলে এসেছে তাই বছর ঘুরে রসে টইটম্বুর আমের অপেক্ষার প্রহর সত্বরই শেষ হচ্ছে। আমের কারবার শুরু করতে ব্যস্ত এখন সবাই। ধারাবাহিক সিস্টেমে এবার আমের জন্য অফইয়ার হলেও সময়মতো বৃষ্টিপাতে আমের আকার বৃদ্ধির কারণে ভাল ফলন আশা করছেন এ অঞ্চলের চাষীরা। বাহারি জাতের আম এবারও দেশের মানুষের রসনা মেটাবে। গাছভরা আম নিয়ে চাষীদের মনে এখন উঁকি দিচ্ছে ভাল ফলনের আশা। মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ থাকে আমকে ঘিরেই। প্রতিবছর আমের বাগান সম্প্রসারিত হওয়ায় বাড়ছে এ নিয়ে কর্মযজ্ঞের পরিধিও। চাষীরা জানান, বড় গাছের তুলনায় ছোট ছোট গাছে আম এসেছে বেশি। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান মতে, গত ৭ বছরে রাজশাহীতে আমের উৎপাদন বেড়েছে আড়াই গুণেরও বেশি। ফলন ও লাভ উভয়ই বেশি হওয়ায় অনেকেই আম চাষে উৎসাহী হয়েছেন। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৭-০৮ মৌসুমে রাজশাহীতে মোট আম আবাদী জমির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮শ’ ৫৪ হেক্টর এবং আম গাছ ছিল ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৬শ’ ৮৪টি। সাত বছরের ব্যবধানে গত ২০১৩-১৪ মৌসুমে রাজশাহীতে আমের উৎপাদন হয় দুই লাখ ৫৭ হাজার ৫শ’ ৩১ মেট্রিক টন। এই সময়ের ব্যবধানে রাজশাহীতে আমের উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫শ’ ৮১ মেট্রিক টন। আর চলতি ২০১৪-১৫ মৌসুমে রাজশাহীতে আমের আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ৫শ’ ১৯ হেক্টর জমিতে। গত বছরের উৎপাদন সমপরিমাণ ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৩১ মেট্রিক টন এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। কৃষি বিভাগের সূত্রমতে, আমের রাজধানী খ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় অসংখ্য জাতের আম উৎপন্ন হয়। তবে এবার ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপলি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লকনা ও মোহনভোগ জাতের আম বেশি চাষ হয়েছে। গাছে গাছে বাহারি জাতের আম এখন দেশের কোটি মানুষের রসনা মেটাতে প্রস্তুত হচ্ছে। আগামী জুন মাসের শুরু থেকেই আম উঠতে শুরু করবে বাজারে। রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা, পবা ও চাঁপাইনববাগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে মধুমাস জ্যৈষ্ঠের ছাপ বাগানে বাগানে। গাছের নিচে নিচে পাহারার মাচান তৈরি করছের বাগান মালিকরা। আর কদিন পরই বাজারে আসবে আম, তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বড় বড় আম ব্যবসায়ীদের আনাগোনাও বেড়েছে এরই মধ্যে। চারঘাটে আম চাষী সাবের আলী বলেন, সবার আগে বাজারে আসবে গোপালভোগ। পর্যায়ক্রমে ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আম্রপলি, ফজলি প্রভৃতি। সবশেষে বাজারে আসবে আশ্বিনা। রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা গ্রামের আম চাষী আলী হোসেন জানান, তার ছয় বিঘার বাগানে এবার ভাল আম এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিছুটা ক্ষতি হলেও ভাল ফলনের আশা করছেন তিনি। একই উপজেলার মথুরা গ্রামের আম চাষী রুবেল বলেন, প্রতিটি বাগানে প্রত্যাশিত আম এসেছে। যে পরিমাণ আম এসেছে তা থেকে ভাল উৎপাদন পেতে বাগানের পরিচর্যা চলছে এখন। জেলার পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরের আম চাষী লোকমান আলী বলেন, ঝড়ে বেশ কিছু আম ঝরে গেলেও এখন যে পরিমাণ আম রয়েছে তাতে বাম্পার ফলন হবে। রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন জানান, আমের ফলন নির্ভর করে আবহাওয়া ও গাছের যতেœর ওপর। তিনি বলেন, এবার গাছে গাছে যে পরিমাণ আম এসেছে, তা ভাল ফলনের ইঙ্গিত করে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক হযরত আলী জানান, চলতি মৌসুমের শুরুতে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আম গাছগুলোর শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মুকুলিত হয়েছিল। গাছে গাছে পর্যাপ্ত গুটিও এসেছিল। তবে এপ্রিলের শুরুতে কয়েক দফা ঝড়ে কিছুটা ক্ষতি হলেও এখন যে পরিমাণ আম গাছে ঝুলছে তাতে বাম্পার ফলন আশা করা যায়। আমের পুষ্টিগুণ ॥ আম উচ্চ প্রোটিন, ভিটামিন এ, সি, বি-৬, কে, ফলিক এসিড, আঁশ ও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ একটি ফল। এছাড়া আমে কপার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট যেমন বিটা ক্যারোটিন ও জিয়াজেন্থিন রয়েছে। আম খাওয়ার ফলে মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। গবেষকদের মতে আম খাওয়ার ফলে স্থুলতা, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এছাড়া ত্বক ও চুলের রঙের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, দেহের শক্তি বৃদ্ধির জন্য, কোলন ক্যান্সার রোধে, হাড় ও হজম শক্তির উন্নত করার ক্ষেত্রে আমের ভূমিকা রয়েছে।
×