ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উন্নত জীবনের আশায় সিরাজগঞ্জ ও যশোরের এসব যুবক তাঁত, ভ্যান ছেড়ে ট্রলারে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়

পাঁচ শতাধিক যুবকের অগস্ত্য যাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৯ মে ২০১৫

পাঁচ শতাধিক যুবকের অগস্ত্য যাত্রা

স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ ও যশোর ॥ উন্নত জীবনযাপনের আশায় সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁত, ভ্যান-রিক্সা ও কৃষি শ্রমিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষ অবৈধপথে দালাল চক্রের হাত ধরে ট্রলারে স্বপ্নের মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়ার জন্য বাড়ি ছেড়েছেন। অবৈধপথে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু এ রকম চার শতাধিক যুবকের কোন হদিস নেই। মানব পাচারের ঘটনায় মোট নয়টি মামলাও হয়েছে। এর মধ্যে এনায়েতপুর থানায় পাঁচটি, যার দু’টির তদন্ত শেষে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। আর বেলকুচি থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এদিকে যশোরের মনিরামপুরের ১০ গ্রামের শতাধিক যুবকের হদিস মিলছে না। তারাও অবৈধপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যেতে চেয়েছিল। জীবন বাজি রেখে মালয়েশিয়া যাবার স্বপ্নে বিভোর যুবকদের ট্রলারে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে রেখে নির্যাতন করে দালাল চক্র। তাদের প্রতিজনের কাছ থেকে আদায় করেছে দুই থেকে পৌনে তিন লাখ টাকা। যারা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তাদের হত্যা অথবা জিম্মি করে রাখা হয়েছে। এদের অনেকেই বন্দী থাই জেলখানায়। বেলকুচি উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী এনায়েতপুর থানার এমন প্রায় চার শ’ মানুষের গত কয়েক মাস ধরে হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের কাছে অভিযোগ তো দূরের কথা, প্রভাবশালী এই এলাকার দালাল চক্রের ভয়ে অনেকেই এ বিষয়ে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। পরিবারের অন্যতম কর্মক্ষমদের হারিয়ে শোকে বিহ্বল অসহায় মানুষগুলোর হতাশা ও কান্না শোনার যেন কেউ নেই। খেয়ে না খেয়ে চলছে তাদের সংসার। নিজাম দালাল ও মুন্নাফ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে গত তিন মাসে এ এলাকার ছয় জন খুনের শিকার হয়েছেন। এদিকে ৩৮ দিন আগে অবৈধপথে মালয়েশিয়া যাওয়া এনায়েতপুর থানার আড়কান্দি চরের মুজামের ছেলে ইসমাইল (২৮), রইজের ছেলে ইয়ামিন (১৭), আফসারের ছেলে ইব্রাহিম (২২), হিরা আকন্দের ছেলে সফিকুলের (১৭) হদিস না মেলায় পরিবারে চলছে কান্নার রোল। এছাড়া গোপীনাথপুরের ছালাম বেপারীর ছেলে মণিকে দুই মাস আগে খোকশাবাড়ির দালাল ছাদ্দাম ব্যাপারী ট্রলারে পাচারের পর থেকে তার হদিস নেই। বেলকুচির মাইঝাইল গ্রামের আদম ব্যাপারী শহীদুল ইসলাম প্রতারণা করে ট্রলারে গত কয়েক মাস আগে একই গ্রামের খোকন, আলমগীর, গোলাম এবং বাবুকে পাচার করেছে। এরা সবাই থাইল্যান্ড কারাগারে বন্দী। এ ঘটনায় খোকনের বড় ভাই আবদুল আওয়াল বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ দালাল শহীদুলকে আটক করে। গোপালপুর গ্রামের রমজান আলীর স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন জানান, তাঁর ছেলে মোতালেবকে (১৭) ভাঙ্গাবাড়ির হোসেন দালাল কৌশলে মালয়েশিয়া পাচার করে জিম্মি করে আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে। একইভাবে মজিদ শেখের ছেলে রেজাকেও পাচার করে দালালরা। সে এখন থাই কারাগারে বন্দী অবস্থায় আছে। যশোর ॥ ভাগ্য বদলের আশায় মনিরামপুর উপজেলার চার ইউনিয়নের অন্তত ১০ গ্রামের শতাধিক যুবক পাড়ি জমিয়েছিলেন মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে। প্রায় দু’বছর আগে রওনা দিলেও আজও খোঁজ মেলেনি তাদের। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একাধিক গণকবরের সন্ধান মেলার পর থেকে নিখোঁজ দালাল চক্রের সদস্যরাও। সেই সঙ্গে প্রাণপ্রিয় সন্তানের শেষ সংবাদটুকু পাওয়ার পথও যেন মিলিয়ে গেছে ওই যুবকদের পরিবারের সদস্যদের। এ অঞ্চলের ১০ গ্রাম থেকে নদী পথে যাওয়া অসংখ্য যুবকের কোন সন্ধান নেই এ পর্যন্ত। প্রতিদিন অসহায় বাবা-মা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ মেলে আদরের সন্তানের ছবি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন। কাঁচামালের ব্যবসা করে স্ত্রী আর দু’মেয়েকে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল রাজগঞ্জের চ-ীপুর গ্রামের মাহবুবুর রহমানের সংসার। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর স্বপ্নে বিভোর মাহবুবুর বিদেশে পাড়ি জমানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে উদ্যোগই যে সংসারের সব স্বপ্ন ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেবে তা কেই বা জানত? নদীপথে ঝাঁপা গ্রামের চিহ্নিত মানব পাচারকারী চাঁদ আলী মোড়লের ছেলে সালাম মোড়লের খপ্পরে পড়ে কাউকে না জানিয়েই চলতি বছরে অতি গোপনে সমুদ্রপথে পাড়ি জমান তিনি। এরপর থেকে আর কোন খোঁজ নেই মাহবুবুরের। আর পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে স্ত্রী রিক্তা বেগম এবং পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে নাসরিন ও দুগ্ধপোষ্য শিশুকন্যা বৃষ্টি আজ মানবেতর জীবনযাপন করছে। বগুড়ার ৬ যুবকের সন্ধান স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া থেকে জানান, অবৈধভাবে ট্রলারে করে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সমুদ্র থেকে উদ্ধার হওয়া বগুড়ার ধুনট উপজেলার ৬ যুবক বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছেন। তারা হলেনÑ বগুড়ার ধুনট উপজেলার শৈলমারী গ্রামের জিহাদুল ইসলাম (৩০), আমিনুল ইসলাম (২৮), আলমগীর হোসেন (৩০), পারধুনট গ্রামের আশাদুল ইসলাম (২৮), আজিবর হোসেনে (৩০) ও খোকশাহাটা গ্রামের লিখন মিয়া (২৭)। রবিবার সন্ধ্যায় মালয়েশিয়াগামী ওই যুবকদের স্বজনরা এ তথ্য নিশ্চিত করেন। পরিবারিক সূত্র জানায়, যুবকরা এলাকায় কেউ রিক্সা চালাত, কেউ দিনমজুরি খাটত, কেউ প্রান্তিক চাষী। প্রায় আড়াই মাস আগে কাজের সন্ধানে ওই ৬ যুবক ঢাকায় পাড়ি জমায়। এক মাস আগে আমিনুল ইসলাম মোবাইল ফোনে তার বাবা খোরশেদ আলমকে জানায়, ট্রলারে করে মালয়েশিয়া যাচ্ছে, এখন সমুদ্রের মধ্যে ট্রলারের ভেতর আছে। কিন্তু কোথায় আছে সে জায়গার নাম বলতে পারে না। বলে মালয়েশিয়া যেতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে। এরপর মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
×