ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলা থেকেও

বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা এখন আর চোখে পড়ে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২০ মে ২০১৫

বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা এখন আর চোখে পড়ে না

কাজী ইসফাক আহমেদ বাবু ॥ ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই’- কবিতাটি আজও মানুষের মুখে মুখে। বাবুই পাখি নিয়ে লেখা কবির ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি উদাহরণ হিসেবে মানুষ ব্যবহার করলেও হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি। বাবুই পাখির বাসাও যেন আজকাল চলে যাচ্ছে স্মৃতির অন্তরালে। মানুষের মানবিক দিক জাগ্রত করার জন্য কবি রজনীকান্ত সেন রচনা করেন এই কালজয়ী কবিতা। গ্রামবাংলার পল্লী অঞ্চলে আগের মতো বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা এখন আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার সেই নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখিও। বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়ে বাতাসে টিকে থাকে তাদের বাসা। খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচি পাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করত বাবুই পাখিরা। বাবুই একাধারে শিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি। বাবুই পাখির শক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কঠিন। এরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায় পছন্দের সঙ্গী খুঁজতে। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য কত কিছুই না করে। পুরুষ বাবুই নিজের প্রতি আকর্ষণ করার জন্য খালবিল ও ডোবায় গোসল সেরে ফুর্তিতে নেচে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। এরপর উঁচু তালগাছ, নারিকেল বা সুপারি গাছের ডালে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই খুবই শিল্পসম্মতভাবে নিপুণ বাসা তৈরি করে। পুরুষ বাবুই পাখি কেবল বাসা তৈরি করে। স্ত্রী বাবুই ডিম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষ বাবুই খুঁজতে থাকে আরেক সঙ্গীকে। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ এরা ঘর-সংসার করতে পারে ছয় সঙ্গীর সঙ্গে; তাতে স্ত্রী বাবুইয়ের বাধা নেই। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায়। বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম হলো ধান ঘরে ওঠার মৌসুম। স্ত্রী বাবুই দুধধান সংগ্রহ করে এনে বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাবুই পাখি তালগাছে বাসা বাঁধে বেশি। ১০-১৫ বছর আগেও গ্রাম-গঞ্জের তাল, নারিকেল ও সুপারি গাছে ব্যাপকভাবে বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়ত। বাবুই পাখির এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক যোগাত এবং স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করত। সময়ের বিবর্তনে ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আজ এ পাখিটি আমরা হারাতে বসেছি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা। খড়, তালগাছের কচিপাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে চমৎকার বাসা তৈরি করত বাবুই পাখি। সেই বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা ভেঙ্গে পড়ে না। বাবুই পাখির শক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া যায় না। একশ্রেণীর মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহ করে শহরে ধনীদের কাছে বিক্রি করছে। এ বাবুই পাখির বাসাগুলো শোভা পাচ্ছে ধনীদের ড্রইং রুমে। সারাবিশ্বে বাবুই পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১১৭। তবে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখির বাসা দেখা যায়। বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্য এরা জোঁনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। প্রজনন সময় ছাড়া অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী পাখির গায়ে কালো কালো দাগসহ পিঠ হয় তামাটে বর্ণের। নিচের দিকে কোন দাগ থাকে না। ঠোঁট পুরো মোছাকার, লেজ চৌকা। তবে প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখির রং হয় গাঢ় বাদামি। বুকের উপরের দিকটা হয় ফ্যাকাশে। অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই পাখির চাঁদি পিঠের পালকের মতোই বাদামি। বুকের কালো দোড়া ততটা স্পষ্ট নয়। প্রকট ভ্রƒরেখা কানের পিছনে একটি ফোঁটা থাকে। বাবুই পাখি সাধারণত তাল, খেজুর, নারিকেল, সুপারি ও আখ ক্ষেতে বাসা বাঁধে। ধান, চাল, গম ও পোকা-মাকড় প্রভৃতি তাদের প্রধান খাবার। বর্তমানে যেমন তাল জাতীয় গাছ হারিয়ে যাচ্ছে তেমন হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখিও। বাবুই পাখি ও এর শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন সুশীল সমাজ।
×