ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজ ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২১ মে ২০১৫

সমাজ ভাবনা

মন পবনের গাঁ শারমিন সুলতানা মিম ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’ শহরের কোলাহল আর তীব্র কার্বন ডাই অক্সাইডের দূষণ ছেড়ে ফ্রেশ অক্সিজেন যদি নিতে হয় তবে গ্রাম ছাড়া উপায় মেলা ভার। গ্রামের নাম আশকুরপুর। গ্রামতো বলছি- কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে স্বপ্নের বেড়াজাল। স্বপ্নের ভুবন বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। সবুজ ক্ষেতের আড়ে পানির পাম্প, মোড়ে চায়ের দোকানের আড্ডা, দিন শেষে জ্যোৎস্না রাতে গ্রামের সবাই গল্প করে আপন মনে। গাঁয়ের মাঠের লাল নরম মাটির মতো আশকুরপুরের মানুষের মনটা খুব নরম। মানুষকে কত সহজে হৃদয়ে জায়গা দিতে পারে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এতই দৃঢ় যে একজনের দুঃখে অন্যজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাঁ বলতে মা বোঝায়। মায়ের মমতার আঁচলে যেমন শান্তির পরশ থাকে, ঠিক তেমনি গাঁয়ের মাটির আলাদা গন্ধ থাকে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ মাঠের কাজ করলেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে এক তৃতীয়াংশের মতো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গাঁয়ের সকালের পর্দা ওঠে মক্তবে ছোট ছেলেমেয়েদের কচি কণ্ঠের আরবি ধ্বনিতে। নির্মল বাতাস, মোরগের ডাক, মেঠো পথ এক বিশুদ্ধ গাঁয়ের পরিচয় মেলায়। গাঁয়ের মানুষের চোখের পানি মুক্তার মতো; খুব আবেগী। রোদের অবহেলিত রশ্মি তাদের সঙ্গী। খুব বেশি শিক্ষিত হতে না পারলেও তাদের ব্যবহার রুচি বুঝিয়ে দেয় পাঠ্য শিক্ষা না পেলেও মনুষত্বের শিক্ষা হৃদয় ভরা। গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি কৃষ্টি ধরে রেখেছে হৃদয় মাঝে। যে কোন উৎসবে লাঠিখেলা, মোরগ লড়াই, গামছা বাঁধা খেলার আয়োজন হয়। সমাজের নিয়ম মেনে চললেও গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করে নিজের মতামত দেবে না তা কি হয়? গ্রামের রাস্তাটা পাকা হয়েছে অনেক আগেই আর তাই বিদ্যুতের আলোর ঝলমল করতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। শিক্ষার আলো জ্বলছে গাঁয়ের প্রায় প্রত্যেক ঘরে। তাই কুসংস্কারের ছায়া একেবারে পাত্তা পায় না। মাদকের প্রেমে না পড়ে এই গ্রামের তরুণরা নানা রকম সামাজিক কর্মকা-ে মন দিয়েছে। তাই গাঁয়ের উন্নতিতে বাধা দেয়ার কেউ নেই। সব মিলিয়ে আশকুরপুর না বলে স্বপ্নপুর যদি বলি তবে ভুল বলা হবে না। মন পবনের গাঁয় আশকুরপুর একটি দৃশ্যপট যেখানে মনের মতো ছবি আঁকা যায়। রঙতুলি দিয়ে রাঙ্গানো যায়। রানী বাজার, বোয়ালিয়া, রাজশাহী থেকে জয়ন্তীকে খুঁজি জান্নাতুল ফেরদৌস এনা উপজেলাকে একটা শহর বলা যায় কিনা আমি জানি না। তবে বর্তমানে এই উপজেলাটি দেখলে যে কেউ শহর ভেবে বসবে অনায়াসে। মাত্র ক’বছর আগেও গ্রামের আবেশে গড়ে ওঠা এই উপজেলায় আজ সারিবদ্ধ ভবন, শপিংসেন্টার, দামী দামী সব খাবারের দোকান। ভাবতেই কেমন যেন লাগে! খুব দ্রুত বদলে গেছে আমার সেই ছোট্ট শহরমুখী গ্রামটি। চারদিকে যেভাবে নগরায়ন হচ্ছে তার বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা যদি এই শহরে না পড়ত তখন মন খারাপ হওয়াটাও অস্বাভাবিক ছিল না। আবার এমন পরিবর্তনটাও মন মেনে নিতে পারছে না আজ। মনটা কি গ্রামের প্রেমে সঙ্কীর্ণ হয়ে গেল? বরিশালের একটি থানা, উপজেলা-পৌরসভা মুলাদী। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে জয়ন্তী নদী। এত সুন্দর যে একটা নদী হতে পারে তা না দেখলে বোঝা যেত না। একেক ঋতুতে হরেক রূপ ধারণ করত জয়ন্তী। বসন্তের বাতাসে জয়ন্তীর পাড়ে বসলে মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা বিষণœতা কোথায় হারিয়ে যেত আর শীতের কুয়াশা মোড়ানো জয়ন্তী যেন হয়ে উঠত কোন অপ্সরী। হেমন্তের সবুজ ধানক্ষেত আর ফসলের মাঠের পাশে এই জয়ন্তীকে মনে হতো ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’। বর্ষার থই থই পানি দেখলেই মনটা বিশাল হয়ে যেত। মুলাদীর ছোট্ট শহরে ছোট ছোট টিন কাঠের ঘর, ছোট্ট দোকান, ছোট্ট বাজার। মুলাদীর আশপাশের এলাকা থেকে আসত তাজা সবজি, আর নদী থেকে আসত জেলেদের জালে ধরা মাছ। বাজারের ফলও আসত কোন গৃহস্থের গাছ বা বাগান থেকে। বিদেশী কোন ফলের স্থান ছিল না এখানে। বাড়ির বউরা সবজি চাষ করত, পশুপাখি পালন করত, কাঁথা সেলাই করত, কাপড়ে ফুল তুলত, পাটি বুনত। প্রবাদ আর শ্লোক ছিল তাদের আড্ডার বিষয়বস্তু। বিটিভিতে সপ্তাহে একটা সিনেমা দেখা আর রাতে কয়েকটা নাটক দেখেই তারা সন্তুষ্ট থাকত। বিকেলের নাস্তায় থাকত খই, মুড়ি, পিঠা, নাড়ু, পায়েশ। এসবই আজ পর্দার ওপারের (অতীত) গল্প। এপারের (বর্তমান) গল্পটা এরকম। জয়ন্তীর এখন আর সেই রূপ-লাবণ্য নেই। তার তীর ভরাট হয়ে আজ ঘরের পর ঘর উঠেছে। ছোটখাটো একটা নালা হিসেবেই সে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। শহরের টিন কাঠের ভবনগুলো ইট, সিমেন্টের বিল্ডিং হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধানের ক্ষেত, ফসলের মাঠ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। চাষ করার কেউ নেই। সবাই শহরমুখী, বিদেশমুখী। আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। মরা নদীগুলোয় এখন আর মাছ থাকে না। মাছ আসে শহর থেকে; ফল, সবজিও তাই। দেশী-বিদেশী কত ফল। বাড়ির বউরা এখন আর সবজি চাষ করে না, করে না পশু-পাখি পালন। তারা এখন ভারতীয় চ্যানেল নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। আড্ডার বিষয়বস্তু পাখি, ঝিলিক, আকশারা, গোপী। বিকেলের নাস্তায় বার্গার, স্যান্ডউইচ, কিমা পরোটা। আগে যেমন বাড়িতে মেহমান এলে খোপের বড় মোরগটা ধরে জবাই করা হতো এখন ছুটে দোকানে গিয়ে ব্রয়লার মুরগি নিয়ে আসা হয়। অথবা ফ্রিজে জমানো মুরগি দিয়েই চলে আপ্যায়ন! অর্থ, প্রযুক্তি-ভাবনা এই শহরটাকে যতটা আধুনিক করেছে ঠিক ততটা কেড়ে নিয়েছে তার ঐতিহ্য, ইতিহাস। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে মুলাদীর এই বিশাল পরিবর্তন প্রায়ই পুরনো শহরতলিটাকে মনে করিয়ে দেয়। যে রাস্তাগুলোয় বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে সমস্ত গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম সেই রাস্তা এখন বিভিন্ন রকম যানবাহনে আটকে থাকে। গার্লস স্কুলের গাছগাছালি ঘেরা রাস্তাটা দোকান আর মানুষের ভিড়ে সরব হয়ে উঠেছে ঠিকই কিন্তু প্রকৃতির সেই আবেশটা আর পাওয়া যায় না। দূর থেকে কখনও ভেসে আসত বাংলা সিনেমার মিষ্টি গান অথবা কোন আধুনিক গান। এখন চোখ বন্ধ করলে স্বদেশে না অন্য কোথায় আছি তা উপলব্ধি করাটা একটু কষ্টসাধ্য হয়। ধিরিম-ধারিম মিউজিকে বেজে ওঠে, শিলা! শিলা কি জাওয়ানি, ধুমমা চালে ধুমমা চালে ধুম ইত্যাদি। পাশাপাশি কল কারখানা, যানবাহনের বিদঘুটে আওয়াজ তো আছেই। এসবের মাঝে আমি হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরি আমার সেই তন্বি অপ্সরা জয়ন্তী নদীর ধারে আমার শ্যামলাবরণ, পাখি ডাকা সেই শহরতলিটাকে। মুলাদী বন্দর, বরিশাল থেকে সেসব রূপকথার গল্প! আহমেদ উল্লাহ্ গ্রামটি আর সেই আগের মতো নেই। অনেকটাই বদলে গেছে। যুগের হাওয়ায় পুরনো জয়পুর এখন রূপ ধরেছে ডিজিটাল গ্রামে। গ্রামের সামনে দিয়ে বয়ে চলা তিতাস নদীটি আজ মরণাপন্ন। গ্রামের বৃক্ষতরুলতায় যখন বসন্তের মুকুলজাগা নব পল্লবী দুলে দুলে নৃত্য করে, তখন নদীটি শুকিয়ে তৃষ্ণার্ত হাহাকার করে কাঁদে! বসন্তের কোকিল আগের মতো কুহু কুহু কূজনে মাতিয়ে রাখলেও, আগের সেই প্রাণচঞ্চলতা নেই। বর্ষায় যে তিতাসের বুক বেয়ে নিত্য বয়ে বেড়াত পালতোলা নৌকা, তরঙ্গে হেলে-দুলে মাঝির কণ্ঠে বেজে উঠত বাউলের সুরধ্বনি! আজ সবই কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। নদীতে নেই তরঙ্গের রুনুঝুনু গুঞ্জন, নেই পালতোলা নৌকার সারি। আধুনিক যন্ত্রদানবের চোয়ালে সবই গিলে নিয়েছে। আগের মতো গাঁয়ের কুলবধূরা সাঁঝের বেলায় জল আনতে নদীতে তেমন যায় না। সব বাড়িতেই রয়েছে নলকূপ, পানির ট্যাঙ্ক। একসময় জয়পুর গ্রামের লোকজন উপজেলায় যেতে চাইলে, আগের দিনই প্রস্তুত থাকতে হতো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হতো। কিন্তু আজ সেসব ঘটনা কেবল রূপকথার গল্প। গ্রাম থেকে সুদূর ঢাকা ও কুমিল্লা গিয়ে অফিস করে বাড়ি ফেরা নিত্য ব্যাপার। গ্রামের রাস্তায় ঘটেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। উপজেলা শহর থেকে সুবিশাল পিচঢালা পথ গাঁয়ের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে একদিকে জেলা শহরে, অন্যদিকে রাজধানীর দিকে। নিত্য ছুটে চলে বিচিত্র স্থলযান। আগেকার দিনের সহজ, সরল মানুষগুলোও প্রায় বিদায়গামী। নবীনদের চাকচিক্যময় হুঙ্কারে গ্রাম আজ তটস্থ। শিক্ষার উন্নতি হলেও, মান্যতায় রয়েছে যথেষ্ট ঘাটতি। কবেকার কেরোসিনের প্রদীপ, লণ্ঠন হারিয়ে গেছে বৈদ্যুতিক আলোর প্রভাবে। গ্রামে এখন আর সেই আগের মতো রায়জনপুরের কিচ্ছা, সয়ফলমুল্লুক বদিউজ্জামানের গল্প, গাজীর গান, গ্রাম্য নাটক এবং বাউলের আসর বসে না। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে টেলিভিশন, স্যাটেলাইট চ্যানেল। যেখানে গ্রামের মানুষ দূরে থাকা প্রিয়জনদের চিঠির অপেক্ষায় থাকতে হতো, সেখানে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে মোবাইল এবং ইন্টারনেট সংযোগ। সবচেয়ে বিষাদময় পরিবর্তন হলো, চিরতরে আমাদের এই গ্রাম থেকে মুছে গেছে হিন্দু ললনার উলুধ্বনি! চিরতরে হারিয়ে গেছে পূজার ম-প, শ্মশান মন্দির। জয়পুরে এখন আর কোন হিন্দু সম্প্রদায় নেই। সবাই দেশ ছেড়ে চলে গেছে ভারতে। উন্নতি ও পরিবর্তনের এক অনন্য ধারায় পৌঁছেছে জয়পুর গ্রাম। এখনকার জয়পুর আর আগের জয়পুর নেই, এ যেন আধুনিক এক অন্যরকম জয়পুর। জয়পুর, হোমনা, কুমিল্লা থেকে আত্মার বসতবাড়ি আদনান সৈয়দ আমার অফিসের জানালা খুললেই চোখে ভেসে আসে ছবির মতো একটি গ্রাম। নিউইয়র্ক সিটি থেকে একটু দূরে ইয়ংকার্সে আমার অফিস। মনে হলো শহুরে বদ হাওয়া এই শহরতলিতে খুব একটা যেন লাগেনি। কোথায় যেন একটা গ্রাম গ্রাম পরিবেশ সর্বত্র বিরাজমান। আমি যখনই আমার অফিসের খোলা জানালার সামনে তন্ময় হয়ে দাঁড়াই তখনই রাজ্যের যত ভাবনা-কল্পনা পেয়ে বসে। সত্যি, এখানকার মানুষরা কত ব্যস্ত। মনে হয় সময়কে বুঝি তারা জয় করতে চায়। তারা যা করছে তা নিয়ে কি সত্যি সুখী? মাঝে মাঝে মনে হয় তারা কী জানে, তারা কী চায়? সবাই ঘুরছে প্রতিষ্ঠার পেছনে, টাকার পেছনে, খ্যাতির পেছনে। বাংলাদেশের কথা খুব মনে পড়ে। সেদিন বন্ধু নাজমুল বলল, বাংলাদেশও নাকি এমন হয়ে গেছে। মানুুষের আবেগ আর ভালবাসা হারিয়ে যাচ্ছে। তাও কি সম্ভব? বাংলাদেশে নাকি এখন গ্রাম নেই। সব জায়গা শহরের দখলে। লোহা লক্কড়ে ভরে গেছে চারদিক। মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা। আমাদের গ্রামের নাম তরগাঁও। ছোট্ট একটা গ্রাম। তার পাশ দিয়েই বইছে শীতলক্ষ্যা নদী। ছবির মতো আঁকা-বাঁকা নদী। সেই নদীর দুই কোলজুড়ে চোখজুড়ানো সুন্দর ছিমছাম দুটো গ্রাম। নদীর এপারের মানুষের সঙ্গে ওপারের মানুষের সখ্য, কখনও ঝগড়া আবার ভালবাসাবাসি। এপারের মানুষের নিশ্বাসের শব্দ ওপারের মানুষ শুনতে পায়। গলায় গলায়, কাঁধে কাঁধে পথ চলতেই এই দু’গ্রামের মানুষ অভ্যস্ত। নদীর পাড়ে বড় একটা বটগাছ। সেই বটগাছে টিয়া পাখির বাসা। বটের নিচে মানুষের আনাগোনা। আনোয়ার কাকার পান-বিড়ির ছোট্ট একটা দোকান। গাছের কোটরে টিয়া পাখির সারাক্ষণ চিঁ চিঁ চিৎকার আর গাছের নিচে বিভিন্ন মানুষের গুঞ্জরণ! বট গাছটাকে পেছনে ফেলে দশ মিনিট এগোলেই ঋষিপাড়া। সেখানে সুন্দর একটা বকুল গাছ। সেই গাছের নিচে পড়ে থাকে অজস্র বকুল ফুল। যত পারা যায় তাজা ফুল বুক পকেটে ভরে এর স্বর্গীয় ঘ্রাণ নেয়ার আকুলতা। তারপর ধীরে ধীরে নীরব সন্ধ্যা নামে। পাখির কিচিরমিচির থেমে যায়। গ্রামের ছোট ছোট বাড়িতে হারিকেন আর কুপি বাতি জ্বলতে শুরু করে। মানুষের পথ চলার পথটা নিমিষেই যেন ফাঁকা হয়ে যায়। তারপর সুনসান নীরবতা। মাগরিবের আজানের পরপরই দূরে কোথায় যেন উলুধ্বনি শোনা যায়। মন্দিরে কাঁসার ঘণ্টাটা তখনও যেন বাজতে থাকে। এই তো আমার গ্রাম। আমার শৈশবে ফেলে আসা স্মৃতিঘেরা সেই ছোট্ট প্রিয় গ্রাম! সেদিন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আমার সেই ছোট্ট গ্রাম থেকে আসা একটি ছেলের সঙ্গে দেখা। আহা, আমার নিজের গ্রামের ছেলে বলে কথা!! এক নিশ্বাসে কত প্রশ্নই না তাকে করেছিলাম! কেমন আছে আমার সেই ফেলে আসা গ্রামটি? সেই বটগাছটা আছে তো? সেই ছোট্ট শীতলক্ষ্যা নদী? আর ঐ যে বকুল ফুল গাছটা? আনোয়ার কাকার ছোট্ট দোকানটার কী খবর? ঋষিবাড়ি থেকে সেই কীর্তনের সুর এখনও কি ভেসে আসে? আমার গ্রাম নিয়ে এত হাজারটা প্রশ্ন শুনে বেচারা নতুন আসা এই ছেলেটা একটু যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেল। কিন্তু আমার আগ্রহ ভরা দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে সেও যেন কিছুক্ষণের জন্য সেই গ্রামে চলে গেল। ছেলেটি গ্রামের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিতে শুরু করল। আমি আরেক প্রস্থ চায়ের অর্ডার দিয়ে নড়েচড়ে বসি। একসময় ছেলেটির কথা শেষ হলো। ততক্ষণে আমার চোখের সামনেই দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ছে আমার প্রিয় স্মৃতিঘেরা গ্রামটি। সেই ঠা-া শীতল ছিমছাম ছবির মতো আঁকা গ্রাম। শীতলক্ষ্যা নদীটিতে নাকি এখন চৈত্রের সময় চড় পড়ে যায়। লঞ্চ তো দূরের কথা অনেক সময় নৌকা পর্যন্ত আটকে যায়। নদীর দু’কূল ছাপিয়ে অজস্র দোকানপাট, মনু মিঞার চকচকে ঝকঝকে সাইবার ক্যাফে। না, এপারের মানুষের সঙ্গে ওপারের মানুষের হৃদয়ের কোন লেনদেন নেই। চারদিকে শুধু ব্যবসাপাতির লেনদেন, টাকার ঘ্রাণ আর উঁচু দালানের সরব প্রতিযোগিতা। গ্রামের ছেলেপেলেরা সবাই বাইরে। দুবাই, আমোরিকা, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর নানান প্রান্তে। ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন। ছোট্ট টিনের বাড়ি ফুঁড়ে এখন সেখানে লম্বা দালান। বটগাছটা নাকি অনেক আগেই কাটা পড়েছে। এখন সেখানে মস্ত বড় ইটের ভাটা। বকুল গাছটার ওখানে মতিলাল ডাক্তারের চেম্বার। না, না। আমার সেই গ্রামটি আর নেই। শহরের এই যান্ত্রিকতা, তথাকথিত সভ্যতা আমার গ্রামকে অজগরের মতো ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে। এই খেদ থেকেই হয়ত বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন ‘সভ্যতার চ-ালবৃত্তি’। মানুষ এখন যন্ত্র হয়ে গেছে। আনোয়ার কাকার ছোট্ট দোকানে মুড়ির-মোয়াটি আর কেউ তার মতো করে ডেকে হাত বাড়িয়ে আদর করে খাওয়ায় না। এবাড়ি ওবাড়ির সখ্য নেই। মানুষ মানুষকে চেনে না, আগের মতো সেই ভালবাসাবাসি নেই। আমাদের চিরচেনা ভালবাসার গ্রামটি ধীরে ধীরে কোথায় যেন হারিয়ে গেল? সেই গ্রামে আর সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে না, হারিকেনের বাতি জ্বালিয়ে আমাদের রফিজ মোল্লা আর ফজরের আজান দিতে সেই পশ্চিম পাড়ার মসজিদে যান না। আমার সেই শৈশবের গ্রামটি চিরতরেই হারিয়ে গেছে। আমাদের গ্রাম থেকে মাইল দুয়েক দূরে পানাশকুড়ি নামে একটা বিল। সেই বিলে আমি আব্বার সঙ্গে প্রায়ই মাছ ধরতে যেতাম। আব্বার ছিল বড়শিতে মাছ ধরার নেশা। একদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল। গায়ের ছোট আঁকা-বাঁকা পথ ধীরে ধীরে দুর্গম আর কালো আঁধারে ছেয়ে গেল। আব্বা পড়লেন বিপদে আর আমি তো কেঁদে ফেলি আর কী। এমন সময় রাস্তার পাশের একটা ছোট্ট বাড়ি থেকে একজন বৃদ্ধ হারিকেন বাতি জ্বালিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। আব্বা বললেন, আমাদের বিপদের কথা। ভদ্রলোক সব শুনে শুধু বললেন, ‘এই আন্ধারে ছোট্ট পুলাপাইন লইয়া যাইবেন কই? আপনারা আইজকা আমার বাড়ির মেজবান। চলেন ঘরে যাই। একটু আরাম করবেন হের পরে এই গরিবের গরে খাওয়া-দাওয়া কইরা হক্কাল বেলায় বাড়িত যাইবেন।’ আব্বা, অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ভদ্রলোককে নিরস্ত করে একটা হারিকেন যোগাড় করে বাড়ি এসেছিলেন। খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার গ্রামে সেই লোকগুলো এখনও ঠিক আগের মতোই আছে তো? নাকি শহরের নগ্ন সভ্যতার বন্যায় সব ভেসে গেছে। হঠাৎ করেই যেন ভালবাসাহীন একটা গ্রামের কংকালের ছবিটা আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। আমি আবারও শিউরে উঠলাম। আমার কাঁধে আমার কলিগ ফ্রেড ডিভিটোর হাত পড়তেই আমি যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। নিউইয়র্ক থেকে স্মৃতির গ্রাম জাহাঙ্গীর আলম ঘর থেকে ১৭৫ পা ফেললেই নদী। নদীর জলে মাছ। অজগরের মতো এঁকেবেঁকে চলছে শত গ্রামের বুক চিরে। দু’ধারে অসংখ্য বাঁশঝাড়, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার গাছ। ভরা নদীর অনন্তকালের প্রহরী। প্রচ- রৌদ্রে নদীর জল শুকিয়ে যায়। গভীর থাকায় নৌকা চলে আষাঢ় মাসের মতোই। নদীর ওপারে দাঁড়ালে দেখা যায় চোখ জুড়ানো বিল। সবুজ-সোনালি রঙের সাজিয়ে রাখে ছয় ঋতুকেই। আমাদের গাঁয়ে একটিই মাত্র বাজার। ঘাটপাড়। সময়ের স্রোতে সাঁতার কেটে আজ আমি বড় ক্লাসের ছাত্র। পল্লীর বিন্দুতে বিন্দুতে পরিবর্তন। নৌকার পরিবর্তে নদীর ওপর একটা বিশাল সেতু। নদী নীরব ভাষায় আর্তনাদ করেছে, এবার আমি সহ্য করতে পারব না। চর জেগে ফুলে উঠেছে। চৈত্রে এক হাঁটুর বেশি জল তার বুকে জোটে না। অল্পসময়ে হয়ত ওটুকুও শুকিয়ে যাবে। শ্রাবণ ভেঙ্গে নিয়ে যায় দু’ধারের বৃক্ষরাজি। প্রকৃতির কান্না কি আর কেউ শোনে? গোবিন্দপুর, খানসামা, দিনাজপুর থেকে প্রাপ্তি স্বীকার
×