ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সোঁদামাটির গন্ধ

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২১ মে ২০১৫

সোঁদামাটির গন্ধ

যেখানে আমার নাড়ি পোঁতা, যার ধুলোমাটি, জলের স্পর্শে শৈশব-কৈশোর কেটেছে। পঁয়ত্রিশ বছর সেই জন্মস্থানের মাটির স্পর্শ পাইনি। আজ এসেছি আমার ছেলে প্রথমকে সঙ্গে নিয়ে। স্কলারশিপ নিয়ে প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছে। প্রথমের ইচ্ছে পূরণ করতেই আজ এখানে আসা। চিরচেনা সেই গ্রামকে আজ অচেনা লাগছে। যে মাঠে খেলাধুলা করে ধুলোমাটি মেখেছি, যে নদীতে সাঁতার কেটে, উল্টোঝাঁপ দিয়ে বড়দের বকুনি খেয়েছি। আমার দুরন্তপনার সেই মাঠ আর নেই। নেই সেই করোতোয়া নদীর আগের রূপ। প্রথমকে আমার জন্মস্থানের যে গল্প শুনিয়ে এসেছি এতদিন তা আজ যেন রূপকথার গল্প হয়ে গেছে। হারিকেনের আলোয় উঠানে ভাইবোন মিলে গোল হয়ে বসে পড়াশোনার দিন আর নেই। ঘরে ঘরে এখন বিজলিবাতির আলো শোভা পাচ্ছে। সেই গ্রাম আছে, গ্রামের সেই নামটিও আছে, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি দখল হতে হতে শ্রী হারিয়ে এখনও আছে কোন রকমে, মানুষও আছে; শুধু নেই আগের আমাদের বাড়ির সেই চেহারা। নেই গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ। পুকুর ভরাট করে তুলেছে ঘর। গরুর বদলে গ্রামে এসেছে কলের লাঙ্গল। ধানের গোলার পরিবর্তে তৈরি হয়েছে গোডাউন। বিল্ডিংটি বিবর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। পলেস্তারা খুলে পড়ে যেন ফোকলা দঁাঁতে দাঁড়িয়ে আছে। আমার স্বপ্নের জন্মভূমিতে ঠিক আছে শুধু আঁতুড়ঘরের সেই জায়গা। যে মাটিতে আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম। আমার মুখে শুনে শুনে প্রথমের আকর্ষণ সেই স্থানটি দেখার। এর অবশ্য অন্য একটি কারণ আছে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের যে অপারেশন থিয়েটার রুমে প্রথমের জন্ম সেখানে জন্মদিনে দেখাতে নিয়ে যাই। প্রথম উঠানের এক কোণে আঁতুড়ঘরের সেই স্থানে গিয়ে কলম দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে আলগা করে হাতে তুলে নেয়। সবাইকে অবাক করে সারা শরীরে মাখতে থাকে সেই মাটি। আমি ওর কাছে গিয়ে বলি- গায়ে মাটি লাগাচ্ছো কেন! অসুখ করবে যে। প্রথম হাতে রাখা মাটি নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকে বলে- ‘বাবা দেখ কী মিষ্টি গন্ধ, মনে হচ্ছে কত আপন এই মাটি, এই মাটিকে স্পর্শ করে মনে হচ্ছে যেন...’ বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে যায় প্রথম। আমার নাকের কাছে ধরতেই গন্ধ নিয়ে দেখি গ্রাম হারিয়েছে রূপ কিন্তু মাটি তার চিরচেনা গন্ধ হারায়নি। আমি এই গ্রামেই ফিরে আসব, মাটির ঘরে, মাটির মানুষের কাছে সোঁদামাটির গন্ধ নিতে। ‘বাবা, আমি বিদেশে লেখাপড়া শেষ করে এখানে তোমার সঙ্গে থাকতে পারব না?’ অমলকান্তি সরকার, রামপুরা, ঢাকা থেকে
×