ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সন্ধ্যার পর রাজধানী যেন ভুতুড়ে নগরী

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২২ মে ২০১৫

সন্ধ্যার পর রাজধানী যেন ভুতুড়ে নগরী

মশিউর রহমান খান ॥ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সজ্জিত করার আলো আর রাস্তায় চলাচলরত গাড়ির আলো দিয়েই অনেকটা চলছে রাতের রাজধানীতে যাতায়াত ও কর্মকা-। জনসংখ্যা ও বসবাসের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম বড় শহর এ ঢাকায় সন্ধ্যার পরই নেমে আসে ভুতুড়ে অন্ধকার। নির্দিষ্ট কিছু এলাকার রাস্তার সড়কবাতি ছাড়া বেশিরভাগ এলাকার রাস্তার বাতিই প্রায় সারা বছরই জ্বলতে দেখা যায় না। আবার কোথাও কোথাও রাতে আলো দেখা না গেলেও দিনের বেলায় রাস্তার বাতিগুলোতে আলো জ্বলতে দেখা যায়। নাগরিকগণ কর্পোরেশনে অভিযোগ দায়েরের পর কর্মচারীরা এসে বাতি নেভায়। অবশ্য কাগজে কলমে অন্ধকার স্থানে নতুন সড়কবাতি লাগানো এমনকি সংস্কার কাজ পুরোদমে চলমান রয়েছে। ভুয়া ভাউচারে বিলও প্রদান করা হচ্ছে নিয়মিত। নিয়মানুযায়ী সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই এসব সড়কবাতি জ্বলে যাওয়ার কথা থাকলেও রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত রাজধানীর এমন অসংখ্য রাস্তা রয়েছে যেগুলোর সড়কবাতিগুলো মাস নয় বছরের পর বছর ধরে জ্বলছে না। নাগরিকদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের জন্য প্রতিনিয়ত ট্যাক্স আদায় করলেও এর বিনিময়ে যে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হবে তা যেন দুই সিটি কর্পোরেশন ভুলেই গেছে। এমন অবস্থা চলছে প্রায় ৩ বছর ধরে। খোদ ২ সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনের সামনের সড়কবাতিগুলোই সবসময় জ্বলতে দেখে না রাজধানীর নাগরিকরা। সাধারণ এলাকার সড়কবাতির কথা সহজেই অনুমেয়। নাগরিকদের অধিক সেবা প্রদানের জন্য সরকার রাজধানীকে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন হিসেবে ২ ভাগে ভাগ করলেও সেবার পরিমাণ অবিভক্তের চেয়ে অনেক কমে গেছে। শুধু রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা সিটিতে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, অপহরণসহ নানা দুর্ঘটনা। অন্ধকারে বাড়ছে সন্ত্রাসীদের রাজত্ব। শুধু তাই নয় বিশেষ নিরাপত্তা এলাকা ডিপ্লোমেটিক জোন বা কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে পরিচিত গুলশান বারিধারা পর্যন্ত পিছিয়ে নেই। আর নাগরিকদের রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত কি পরিমাণ দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে তা বলে শেষ করার নয়। নাগরিকদের রাস্তায় চলাচল নির্বিঘœ করতে এসব সড়কবাতি লাগানো হলেও আলো না জ্বলায় বর্তমানে তা নাগরিকদের সেবার বদলে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। কোথাও স্বল্প আলো আবার কোথাও আঁধার এ নিয়েই বাস করছে মেগা সিটি রাজধানী ঢাকার প্রায় দেড় কোটি বাসিন্দা। সন্ধ্যার পর আলোবিহীন ঢাকা যেন এক ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। নগরীর মহল্লার রাস্তা, ফুটপাথ, অলিগলির ছোট রাস্তা থেকে শুরু করে রাজপথ পর্যন্ত আলোহীন। বর্ষাকাল আসায় তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। রাস্তার এসব বাতির অর্ধেকেরও বেশি নষ্ট থাকলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ দেখার যেন কেউ নেই। নাগরিকদের সেবা প্রদানের জন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি কর্পোরেশন নাগরিকদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় আলো ব্যবস্থার দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশ কর্তৃপক্ষের। দীর্ঘদিন নির্বাচিত কোন প্রতিনিধি না থাকায় তারা যেন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করেছে। সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে সড়কের আলোকায়ন খাতে উত্তর সিটির বরাদ্দ ৪৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা, দক্ষিণ সিটির বরাদ্দ ৬৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। কিন্তু বরাদ্দ পর্যাপ্ত থাকলেও সড়কে নেই আলো। অথচ ভুয়া ভাউচারে ভারি হচ্ছে ফাইল, গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে লোপাট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আর এসব সড়কবাতির নামে কর্মকর্তাদের ভুয়া ভাউচার ছাড়াও অর্থ লোপাটে রয়েছে একটা সিন্ডিকেট। সিটি কর্পোরেশনের ছোটবড় কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মস্তান এবং রাস্তার ছিনতাইকারীরাও পর্যন্ত এ সিন্ডিকেটের সদস্য। এদের প্রত্যেকের পকেটে যাচ্ছে লুটপাটের টাকা ও অন্ধকারের রাস্তার সকল সুবিধা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় হাই এবং লো প্রেসারের হাজার হাজার সোডিয়াম লাইট, টিউব লাইট, মেটাল হে লাইট সমৃদ্ধ ল্যাম্প পোস্টগুলো যেন অনেকটা কর্মক্ষমতাহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার বাতি জ্বালানোর জন্য নির্দিষ্ট লোক নিয়োগ করলেও এমন অনেক রাস্তার বাতি রয়েছে যেগুলো কয়েক সপ্তাহ বা মাস পেরিয়ে গেলেও তা ঠিকমতো আলো দিচ্ছে কিনা তা দেখা হয় না। অনেক নাগরিক নিজের এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে রাস্তার বাতি নিজ খরচেই ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে লাগিয়ে নিচ্ছেন। বাতি নষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, বাতির বৈদ্যুতিক ক্যাবলে কার্বন জমে যাওয়া, জং ধরা, স্টার্টার বা টিউব নষ্ট, বৃষ্টির পানি পড়ে বাতি নষ্ট হয়ে যাওয়া, লো ভোল্টেজ বা ভোল্টেজ আপ ডাউন করা সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে বাতিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কখনও কখনও নাগরিকগণ বাতি নিয়ে অভিযোগ করলে কর্পোরেশনের লোকজন দেখতে আসলেও স্টোরে মালামালের স্বল্পতা রয়েছে বাতি লাগানো সম্ভব নয় বলে চলে আসেন। ফলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও সেই নষ্ট বাতিগুলো কর্পোরেশনের লোকজন মেরামত করতে আসেন না। আর এভাবেই চলছে বর্তমান ঢাকার ২ সিটি কর্পোরেশনের রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। অবশ্য সম্প্রতি নবনির্বাচিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন আগামী ২ জুন শব-ই-বরাতের আগেই কমিশনারদের সহায়তায় রাস্তার সকল বাতি জ্বালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৬টি ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডসহ মোট ৯৩টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকার ২ সিটি কর্পোরেশন এলাকা গঠিত। এর বাইরে ঢাকার আশপাশে রয়েছে আরও এক সিটি কর্পোরেশনের সমপরিমাণ জমিতে নাগরিকগণের বসবাস। যারা সবসময়ই রাস্তার আলো প্রাপ্তি থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। তন্মধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বিভিন্ন কোয়ালিটির মোট ১২ হাজার বাতি স্থাপন রয়েছে। এর মধ্যে লো প্রেসার সোডিয়াম বাতি ও টিউব লাইট ১১ হাজার ৩০৯টি ও অধিক আলো প্রদান ক্ষমতা সম্পন্ন মেটাল হে লাইট ৬৫৯টি। আর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার রাস্তায় ৭৫০টি হাই প্রেসার বাল্ব, ৮ হাজার সোডিয়াম বাতি, ২৫ হাজার টিউব লাইট, ও ৪০০টি মেটাল হে লাইট স্থাপন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট বাতির প্রায় অর্ধেকই নষ্ট। মগবাজার থেকে রমনা থানার দিকে যেতে রাস্তাটির বাতিগুলো বেশিরভাগ সময়ই নষ্ট থাকতে দেখা যায়। লালবাগ থানাধীন নিউ পল্টন এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ বাবু জনকণ্ঠকে জানান, আমাদের এলাকা থেকে নিউমার্কেট এলাকার নীলক্ষেতের মোড় পর্যন্ত রাস্তার কোন বাতি জ্বলে না। পুরান ঢাকার হোসনি দালান, চকবাজার, বেগমবাজার, বকশীবাজার, নাজিমউদ্দীন রোড, চকবাজার, মৌলভীবাজার মিটফোর্ড, ইংলিশ রোড, ভিক্টোরিয়া পার্ক, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সদরঘাটের আশপাশের রাস্তার বাতিগুলোর অর্ধেকের বেশি জ্বলতে দেখা যায় না। সম্প্রতি কিছু বাতি সংস্কার করা হয়েছে। অথচ এসব এলাকায় রাতব্যাপী সারাদেশ থেকে আনা কোটি কোটি টাকার মালামাল ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। এসব এলাকার রাস্তাগুলোতে আলো স্বল্পতায় প্রতিনিয়তই ছিনতাইকারীদের হাতে ব্যবসায়ীদের নিঃস্ব হতে দেখা যায়। রাস্তায় ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার বাতিগুলোর মধ্যে হাই প্রেসার বাল্বগুলো ২৫০ ভোল্ট আলো প্রদান করতে সক্ষম। মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভার, বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও লিংক রোড, গুলশান-বনানী লিংক রোড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের এলাকা থেকে আগারগাঁও লিংক রোডসহ বিভিন্ন ভিআইপি রোডে বা এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক আলো প্রদান করতে সক্ষম ও উক্ত এলাকার রাস্তাগুলোতে নিরাপত্তার স্বার্থে এসব বাল্ব স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন নতুন সব ফ্লাইওভারেও এসব বাতি স্থাপন করা হচ্ছে। তাছাড়া ৯০ ওয়াট থেকে শুরু করে ১৫০ ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন সোডিয়াম ও টিউব লাইট রাস্তায় স্থাপন করা হয়েছে। নাগরিকদের সুবিধা প্রদানের জন্য রাস্তায় এসব বাতি স্থাপন করা হলেও অনেক বাতি লো ভল্টেজ সমস্যা বা বাতি সমস্যার কারণে লাল হয়ে অতি স্বল্প আলোয় জ্বলতে থাকে, যা চোখের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। ঢাকার রাস্তায় এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে সোডিয়াম বাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সে স্থানে স্বল্প আলোর এ্যানার্জি সেভিংস বাল্ব লাগানো রয়েছে। এসব বাতি লাগানোর কারণে বাতি স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সোডিয়াম বাতির হলুদাভ আলোর পরিবর্তে নগর কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতার ফলে মাঝে মাঝে দৃষ্টিকটু সাদা আলো সমৃদ্ধ বাতি লাগানো হয়েছে, যা স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্টের পাশাপাশি রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো না দিতে পারায় নাগরিকগণের প্রতিনিয়ত না দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে যেন কোন মাথাব্যথা নেই। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি পিলার থেকে ৮০ থেকে ৯০ ফুট পরপর সারা ঢাকা সিটিতে স্থাপিত খুঁটিতে আলোর ব্যবস্থা করার কথা কিন্তু এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে পুরো এলাকাতেও কোন আলোর দেখা মেলে না। কোন কোন এলাকায় রাজপথে আলোর ব্যবস্থা করলেও রাজপথের পাশের গলিতেই অন্ধকার চোখে পড়ে। এসব স্থানে নেশাগ্রস্তরা নেশা করা ও আড্ডার মোক্ষম স্থান বানিয়ে নিয়েছে। ফলে এসব গলি বা রাস্তা দিয়ে কোন ব্যক্তি আসা যাওয়া করলেই ছিনতাইয়ের শিকার হতে হচ্ছে।
×