ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিয়ানমারের জলসীমায় ভাসছে দু’সহস্রাধিক;###;রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের আহ্বান ইইউর ;###;উদ্ধারে যুক্ত হবে যুক্তরাষ্ট্র

অভিবাসী উদ্ধারে ত্রিদেশীয় অভিযান শুরু

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৩ মে ২০১৫

অভিবাসী উদ্ধারে ত্রিদেশীয় অভিযান শুরু

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সাগরপথে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে আটকেপড়াদের উদ্ধারে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড উদ্ধার ও তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে। পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডও একই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমারের নৌবাহিনী শুক্রবার তাদের জলসীমা থেকে অবৈধ অভিবাসী বোঝাই ইঞ্জিনবোটসহ ২০৮ জনকে উদ্ধার করে উপকূলে নিয়ে গেছে। এদেরকে আটক ইঞ্জিন বোটের খোলে গাদাগাদি করে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কয়েকজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে বলা হলেও এর সংখ্যা কত তা জানানো হয়নি। এদিকে, বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশী জলসীমার বাইরে আরও প্রায় আড়াইশ’ পাচার হওয়া লোকজন বোঝাই একটি ইঞ্জিনবোট ভাসমান অবস্থায় রয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছে। এদিকে, মিয়ানমারের গভীর জলসীমায় তিনটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় দু’সহস্রাধিক অবৈধ অভিবাসী এখনও আটকে থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। অপরদিকে, মিয়ানমারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গা মুসলিদের ওপর নির্যাতন বন্ধে সেদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইইউ। পাশাপাশি থাইল্যান্ডে আবিষ্কৃত গণকবর নিয়ে তদন্তেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য থাইল্যান্ডের তৎপরতার প্রশংসা জানিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সে দেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে উদ্ধার ও তল্লাশি তৎপরতায় ত্রিদেশীয় সাগর এলাকায় নৌপেট্রোল সহায়তা দেয়া হবে। এদিকে, জাতিসংঘের রিফিউজি এজেন্সির পক্ষ থেকে আবারও জানানো হয়েছে, তাদের মতে এখনও সাগরে ৪ সহস্রাধিক অভিবাসী আটকা পড়েছে। যদিও এ সংখ্যা অনেকের মতে ৭ হাজার। অভিবাসী সঙ্কট নিয়ে শুক্রবার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী প্রধানের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসীদের জন্য উদ্ধার ও মানবিক সহায়তা দিতে রাজি হলেও তাদের দেশে আশ্রয় দিতে রাজি নয় বলে জানিয়েছে। ইন্দোনেমিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে উদ্ধারকৃত অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক হলেও সে দেশের পক্ষ থেকে একই কথা বলা হচ্ছেÑ এরা বাংলাদেশী। বাংলাদেশ থেকে এরা অবৈধভাবে মিয়নমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছিল। এদিকে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বিবিসি, রয়টার, এপি, এএফপিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে শুক্রবার বলা হয়েছে, আন্দামান সাগর এলাকায় আরও বহু অবৈধ অভিবাসী ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় জেলেদের উদ্ধার তৎপরতা চলছে নিজেদের উদ্যোগে। আর যারা উদ্ধার হয়েছে তাদের অবস্থাও অনেকটা মানবেতর যদিও তাদের খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এসব উদ্ধারকৃতরা সাগরে অনাহারে অর্ধাহারে থাকার পাশাপাশি নির্যাতনে নিপীড়নে এরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছে মাত্র। এদিকে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সারাবিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নির্যাতিত একটি সম্প্রদায়। এরা মিয়ানমার বা বাংলাদেশের কারও নাগরিক নয়। বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের তাবু বলা হয়ে থাকে। পাশাপাশি এরা বাঙালী বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে এবং তারা সেদেশে অবৈধ অভিবাসী। উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা এরা নির্যাতিত। এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা সাগর পথে দেশান্তরী হয়েছে। এদের মধ্যে অজানা শঙ্কা এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে মারা গেছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে এসব উদ্বাস্তুকে সাময়িক আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সাহায্য দরকার। এটা কোন আঞ্চলিক সমস্যা নয়। ইন্দোনেশিয়ার উপরাষ্ট্রপতি জুসুপ খাল্লা বলেছেন, তার সরকার রোহিঙ্গাদের এক বছরের জন্য আশ্রয় দিতে রাজি। কিন্তু উদ্ধারকৃত বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানো হবে। মালয়েশিয়াও এক বছরের জন্য অবৈধ অভিবাসীদের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। ইউএনএইচসিআর-এর তৎপরতা ॥ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে শুক্রবার বলা হয়েছে, সাগরে ভাসমান অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশের উদ্ধারের পর পরই স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে। তবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের এক বছরের জন্য অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়া হবে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বর্তমানে আন্দামান সাগরে ৩ হাজার অবৈধ অভিবাসী মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা বলেছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান যাচাই করে এ সংখ্যা নির্ধারণ করেছে। সংস্থার পক্ষে আরও বলা হয়, এর আগে ৩ হাজারেরও বেশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অভিবাসীরা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের উপকূলে ভিড়েছে। ঐ সব দেশের উপকূলীয় আশ্রয় কেন্দ্রে তাদের রাখা হয়েছে। আন্দামানে মালয়েশিয়ার অভিযান ॥ অবৈধ অভিবাসীদের তল্লাশি এবং উদ্ধারে মালয়েশিয়া সরকার আন্দামান সাগরে চারটি জাহাজ ও তিনটি হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে। সে দেশের নৌবাহিনী প্রধান আবদুল আজিজ জাফর গণামধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ॥ আন্দামান সাগরে অভিবাসী সঙ্কট প্রকট রূপ নেয়ায় মার্কিন সেনাবাহিনী বহুজাতিক উদ্ধার কাজে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পেন্টাগন সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এছাড়া আন্দামান সাগরের অভিবাসী সমস্যা সমাধানে ওবামা প্রশাসনের কাছে একযোগে আবেদন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ২৩ আইন প্রণেতা। এই আইন প্রণেতাদের মধ্যে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট উভয় দলের সদস্য রয়েছে। এরই মধ্যে সে দেশের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনী ব্লিংক্যান মিয়ানমার সফরে রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার থেকে তিনি সেদেশে অবস্থান করে মিয়ানমার সরকারের প্রতি অভিবাসী সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করার জন্য ইতোমধ্যে আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমার উপকূলে উদ্ধার ২০৮ ॥ শুক্রবার মিয়ানমার সাগর উপকূলে ভাসমান অবস্থায় একটি ইঞ্জিনচালিত বোট থেকে ২০৮ অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে সে দেশের নৌবাহিনী। নিজস্ব জলসীমায় টহল দেয়ার সময় সে দেশের নৌবাহিনী সদস্যরা অবৈধ অভিবাসী বোঝাই একটি নৌকা দেখতে পেয়ে এটি থেকে তাদের উদ্ধার করে। তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এদের মধ্য থেকে মৃত ব্যক্তিও পাওয়া গেছে। কিন্তু সংখ্যা কত তা জানানো হয়নি। সে দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশের উর্ধতন কর্মকর্তা তিনমাউন জানিয়েছেন, উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ২শ জনই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান। আর এদের বহনকারী নৌকাটি থাইল্যান্ডের মালিকানাধীন। শুক্রবার সূর্যোদয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ইঞ্জিনচালিত এ নৌকাটিকে মংডু পৌর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রামুতে এক দালাল গ্রেফতার ॥ বৃহস্পতিবার রাতে রামু পুলিশ এক মানবপাচারকারী দালালকে গ্রেফতার করেছে। উপজেলার খুনিয়াপালং, হিমছড়ি, পেচারদ্বীপে অভিযান চালিয়ে সৈয়দ হোসাইন নামের এ দালালকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত সৈয়দ হোসাইন মানবপাচারকারী গডফাদারদের সঙ্গে যুক্ত থেকে এ অবৈধ প্রক্রিয়ায় জড়িত। কোন গডফাদার এখনও গ্রেফতার হয়নি ॥ মানবপাচারকারী দালালদের গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্র ন্ত্রাণালয় ও পুলিশের আইজির পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশ দেয়ার পরও উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর ও মহেশখালীর চিহ্নিত মানবপাচারের গডফাদারদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। মানবপাচারকারী শীর্ষ গডফাদারদের সঙ্গে কতিপয় অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার সখ্য থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যদের মদদে সাগর পথে অবৈধভাবে মালেশিয়ায় মানবপাচার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল মানবপাচারে কোন কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতা জড়িত থাকলে তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেয়ায় উখিয়া-টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া থানার কতিপয় পুলিশ এবং কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, প্রায় দু’সপ্তাহে জেলার শীর্ষ মানবপাচারকারীদের কাউকেও গ্রেফতার করতে না পারায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গডফাদারদের সঙ্গে সখ্য ॥ মানবপাচারের গডফাদার ফয়েজ সিকদার, নুরুল কবির, রেজিয়া আক্তার রেবি, সানাউল্লাহ, বেলাল মেম্বার, শামসুল আলম ও আবুল কালামসহ বহু গডফাদারের সঙ্গে উখিয়া থানার কতিপয় পুলিশের সখ্য থাকার অভিযোগ রয়েছে। উখিয়া পশ্চিম সোনাইছড়ির শীর্ষ গডফাদার ইসলাম মিয়ার পুত্র শামসুল আলম ইতোপূর্বে অনেকের কাছে বলে বেড়াতেন- নগদ ১৫ লাখ টাকা খরচ ও তদ্বির করে উখিয়া থানায় ওসি বদল করে এনেছেন। তার বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। ৩১ জানুয়ারি কুতুবদিয়ায় ঐ শামসুল আলমের মানববোঝাই ট্রলার ডুবে সাগরে মারা গেছে ৯ ব্যক্তি এবং গত ফেব্রুয়ারির দু’সপ্তাহে সেন্টমার্টিন সাগর থেকে ওই শামসুল আলমের ট্রলারভর্তি ৪০ ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। সাগরে ৬০ দিনের জিম্মিদশা ॥ সাগরে দালালদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি হয়ে ৬০ দিন অবস্থান শেষে মুক্তিপণ দিয়ে বুধবার টেকনাফে ফিরে আসা ব্যক্তিদের অনেকে জানিয়েছেন, থাই সীমান্তে কড়াকড়ির খবর পেয়ে টাকার জন্য ট্রলারে থাকা লোকদের মারধর শুরু করে দালাল চক্র। তাদের মোবাইল ফোন থেকে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। গত সোম ও মঙ্গলবার দু’দিনের ভেতর কমপক্ষে ২০-৩০ হাজার টাকা হারে যারা পরিশোধ করবে না, তাদের গুলি করে সাগরে লাশ ফেলে দেয়া হবে বলে আল্টিমেটাম দেয় দালাল চক্র। দালালদের দেয়া বিভিন্ন বিকাশ নম্বরে ১৭ জনের পরিবারে লোকজন ২০-৩০ হাজার টাকা করে প্রদান করেছে। টাকা পেয়ে সাগরে দীর্ঘ ৬০ দিন ট্রলারে নির্যাতনের শিকার ওইসব ব্যক্তিদের একটি ছোট নৌকায় তুলে দেয়া হলে তারা টেকনাফে এসে পৌঁছে। পরবর্তীতে মালয়েশিয়াগামী ওই ১৭ বাংলাদেশী ব্যক্তি বিজিবির সহযোগিতায় উদ্ধার হয়ে আদালতের নির্দেশে স্বজনদের মাধ্যমে বুধ ও বৃহস্পতিবার নিজ নিজ বাড়ি ঘরে ফিরে গেছেন ইতোমধ্যে দেড় মাস অনাহারে অর্ধাহারে ॥ মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা জয়পুর হাটের মোঃ জসিম উদ্দিন (১৯) জানিয়েছেন, দীর্ঘ ৬০ দিন সাগরে পার করে দিলাম কখনও ভাত দেখিনি চোখে। দালাল চক্র কত যে নিষ্ঠুর তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে দালালদের হাতে জিম্মি ব্যক্তিরাই একমাত্র বুঝবেন। বিকাশে টাকা দিয়ে দেশে ফিরেছি এটাই বেশি। টাকার লোভে পাচারকারী চক্র চোখের সামনে কত লোককে মেরে সাগরে নিক্ষেপ করে দিয়েছে তার কোন হিসেব নেই। প্রতিবাদকারীকে কোন কথা ছাড়াই ছুরি চালিয়ে খুন করে ফেলে দেয়া হয় সাগরবক্ষে। তার মতে মিয়ানমারের গভীর সাগর এলাকায় তিনটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় এখনও অন্তত দুই হাজারের বেশি লোক দালাল চক্র মুক্তিপণের জন্য আটকে রেখেছে। প্রসঙ্গত, বুধবার ভোরে টেকনাফ বিজিবি সদস্যরা শাহপরীদ্বীপ এলাকা থেকে মালয়েশিয়াগামী ১৭ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মালেশিয়া মানবপাচারে জড়িত শীর্ষ দালাদের একটি নামের তালিকা কক্সবাজারের সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে প্রেরণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে। গত দু’সপ্তাহ আগে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৫ মানবপাচারকারী নিহত হওয়ার পর টেকনাফ ও উখিয়ায় ৫০ গডফাদারসহ দু’শতাধিক দালালদের গ্রেফতারে পুলিশী অভিযান চলছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে কাউকে তারা পাচ্ছে না বলেও জানানো হচ্ছে। এখনও নিখোঁজ পাঁচ শতাধিক ॥ মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকার পাঁচ শতাধিক যুবক-কিশোর এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে। মহেশখালী মাতারবাড়ীর ৫ যুবক ৭ মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছে। ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর স্থানীয় উত্তর সিকদার পাড়ার দালাল নুরুল আলম প্রকাশ লেডু অল্প টাকায় মালয়েশিয়া নেয়ার কথা বলে ওই ৫ যুবককে বোটে তুলে দেয়। পরবর্তীতে ওই ৫ যুবকের পরিবারের কাজ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা হারে নগদ গ্রহণ করে দালাল লেডু। নিখোঁজ যুবকরা হচ্ছে- উত্তর সিকদারপাড়ার মোঃ কাসেম, মোঃ জোবাইর, সুমন, রাশেল ও আজিজুর রহমান। মহেশখালী থানার ওসি জানান, এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। গণকবরে নিহতের পরিবারে আহাজারি ॥ টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে গত ২ বছর পূর্বে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়েই থাইল্যান্ড উপকূলে দালাল চক্রের হাতে উলুবনিয়ার মনিরুল ইসলামের পুত্র সরওয়ার কামাল মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছে বলে তার পরিবার সূত্রে জানা গেছে। থাইল্যান্ড উপকূলের শঙ্খলা বন্দিশিবিরে মানব পাচারকারীরা মুক্তিপণের টাকার জন্য অনাহার-অর্ধাহারে রেখে নির্যাতন চালিয়ে খুন করে গণকবরে নিক্ষেপ করা হয়েছে তাকে। থাইল্যান্ডে গণকবরের সন্ধান ও গলিত লাশ উদ্ধারের খবরে টেকনাফ, উখিয়া, রামু মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া ও জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার ও পরিজনের মধ্যে করুণ আহাজারী থেমে নেই। নিখোঁজ ও পরে থাইল্যান্ডের গণকবরে মারা গেছে শুনে ছেলে সরওয়ারের (২১) মা দিলদার বেগম সন্তানের শোকে এখন প্রায় পাগল। নিহত ছেলের ছবি বুকে নিয়ে অবিরত কান্নার বিলাপ করে দিন কাটাচ্ছেন এই অসহায় মা দিলদার বেগম। হোয়াইক্যং লম্বাবিলের এজাহার মিয়ার পুত্র নুরুল ইসলামও (২৩) নির্যাতনে বন্দিশালায় নির্মম মৃত্যুবরণ করেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে তার পরিবার-পরিজনের মধ্যে মাতম চলছে। পুত্রশোকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধা মা মরিয়ম খাতুন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। পুত্রশোকে খাওয়া-ধাওয়া ভুলে গেছে দীর্ঘদিন ধরে। পুত্র শোকে বৃদ্ধ মরিয়ম এখন এক মৃত্যুপথের যাত্রী। এদিকে, বাঁশখালী থেকে জনকণ্ঠের সংবাদদাতা জোবাইর চৌধুরী জানান, গ্রেফতার এড়াতে মানবপাচারের সিন্ডিকেটের ৩৪ সদস্য গা ঢাকা দিয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের প্রধান শফিউল আলমসহ ৫ জনকে পুলিশ ইতোপূর্বে গ্রেফতার করলেও বাকিরা আত্মগোপনে চলে গেছে। সম্প্রতি বাঁশখালী পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হওয়া মালয়েশিয়াগামীরা জানান, তারা বাঁশখালীর দালাল জাকের, বাহাদুর, আলী, রবি, আরফান, শাহজাদা এবং নারায়ণগঞ্জের দালাল ইসমাইল, কক্সবাজারের আবুল কালাম ও আবু হানিফের মাধ্যমে মালয়েশিয়া ভাল চাকরির লোভে পাড়ি দিয়েছিল। দালালরা মধুরছড়া পাহাড়ে ॥ উখিয়ার মধুরছড়া পাহাড়কে নিরাপদ আস্তানা ভেবে শীর্ষ মানবপাচারকারীদের অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে বলে সর্বশেষ তথ্য মিলেছে। চিহ্নিত দালাল যারা মানবপাচার কাজ সহজ করতে কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষকতাকারী সরকারদলীয় নেতাদের হাতে নগদ টাকার বান্ডেল তুলে দিত, তারাই গ্রেফতার এড়াতে সেই রহস্য ঘেরা মধুরছড়া পাহাড়ে অবস্থান করছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। মধুরছড়া পাহাড়ে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের শতাধিক সেমিপাকা বাড়ি-ঘরে ইতোপূর্বে সরকারী সংস্থার লোকজন যাতায়াত করতে পারেনি বুঝতে পেরে সোনারপাড়ার কয়েকজন মানবপাচারকারী সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। জানা গেছে, উখিয়া টেকনাফের সরকারদলীয় এমপির নাম ভাঙ্গিয়ে ওইসব সেমিপাকা ঘরগুলোর পাহারায় থাকা ডাকাত সর্দার শাহজাহানের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী মানবপাচারকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে সূত্রে জানা গেছে। মধুরছড়া পাহাড়ের সেমিপাকা স্থাপনা উচ্ছেদ করতে ৯ এপ্রিল জেলা প্রশাসক, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও বনবিভাগসহ যৌথবাহিনীর ৪শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী উখিয়া সদরে অনেক্ষণ অবস্থান করার পর ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে।
×