ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডি ॥ বার্লিনে দেবারতি গুহের ‘সংগস অব টি-শার্ট’

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২৪ মে ২০১৫

রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডি ॥ বার্লিনে দেবারতি গুহের ‘সংগস অব টি-শার্ট’

শিরোনামের কে এই দেবারতি গুহ? সামান্য পরিচয় এই, তিনি আমার-আপনার ঘরের, হেঁসেলের। জন্ম কলকাতায় কিন্তু গাছা-আগাছার শিকড় বাংলাদেশে, এখনও বিস্তারিত, আত্মীয়কুল ছড়ানো। ভারতীয় নাগরিক সত্ত্বেও নিজেকে বাংলাদেশী পরিচয়ে গরিমায় দীপ্ত। দেবারতি গুহর গোটা পরিবারই বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বলীয়ান। ওঁর এক মামাকে চেনেন নিশ্চয়, অধ্যাপক, বহুমান্য পণ্ডিত, বুদ্ধিযোগী, কী সব গুরুগম্ভীর গবেষণামূলক বইটই লেখেন, দেশ-বিদেশের তথা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান, তাঁর বই পড়ে মগজে কিচ্ছু ঢোকে না, উপরন্তু দাঁত ভাঙ্গে, লেখকের নাম রণজিত গুহ। ‘কী আশ্চর্য, রণজিতের বই পড়নি? তুমি একটা মূর্খ ও ছাগল। এই দুইয়ের সন্ধিতে তুমি মুগল।’ তপন রায় চৌধুরীর এই উপাধি শিরোধার্য করে বলি, আজকাল কেউ বই পড়ে না, সব জানে গুগল, যা জানার দরকার, গুগলে টিপ দিলে আপনার নাড়িভুঁড়িও বেরিয়ে আসবে। দেবারতি গুহ সম্পর্কেও জানবেন। বাড়তি কথা এই, দেবারতি গুহ দিল্লীর জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ওঁর মাস্টারকুলের একজন আশিস নন্দী। তিনি কে, অধিক বলা বাতুলতা। দেবারতির ডাকনাম সোনাটা। কেন এই নাম, ইংরেজীতে লেখাই বিধেয়, পাঠক নিশ্চয় বাংলায় অনুবাদ করতে পারবেন : Sonata, form of musical composition for one or more instruments, usually consisting of three or four movements that are contrasted in rhythm and mood but related in tonality. দেবারতি গুহ ওরফে সোনাটার টোনালিটি চমকপ্রদ। ইংরেজী, জার্মান, হিন্দী ভাষায় টনটনে (হিন্দী রপ্ত করেছেন দিল্লী থাকাকালীন)। চমৎকার বাংলা ভাষা বলেন, লেখায় একটু ভুলভাল, এই যা। ইংরেজী শিখেছেন কলকাতায়, দিল্লীতে। জার্মান ভাষা জার্মানিতে। জার্মানির একটি সংবাদ- মিডিয়ায় যুক্ত। এসব অবশ্য বিষয় নয়, বায়োডাটায় উল্লিখিত হতে পারে হয়ত। দেবারতি গুহের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত অতীব সুরেলা, গায়িকা হলে অনেক গায়িকার খবর ছিল। অতিকথা আর বলব না। দেবারতি গুহ ওরফে সোনাটা পোক্ত অভিনেত্রীও। বার্লিনের সোফিয়েন জেল নাট্যপ্রেক্ষাগৃহে অভিনয় করলেন বাংলাদেশের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নারী শ্রমিকের ভূমিকায়। রানা প্লাজার নারী শ্রমিকের কি করুণ ট্র্যাজেডি, সেই সঙ্গে অন্যান্য গার্মেন্টসের নারীদের কাহিল, করুণ দুরবস্থা তুলে ধরেন নানা বচনে, অভিব্যক্তিতে। নাটকের কাহিনীকার তিনিই। রানা প্লাজাসহ বাংলাদেশের গার্মেন্টসের কী দুর্দশা সরেজমিনে তল্লাশি করেন ঢাকায় গিয়ে। নাটকের শুরুতে নারী শ্রমিকদের বিলাপ, আর্তনাদ (এই নান্দীর এডিট জরুরী। দীর্ঘক্ষণ অপ্রয়োজনীয়)। দুর্বল নাট্যআবহ এবং সংলাপ। ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে।’ এই গান নিতান্তই অহেতুক, বেখাপ্পা। গানটি তো পূজার। প্রেমেরও। মৃত্যুদৃশ্যে অচল। রানা প্লাজার মৃত্যুগহ্বরে কেউ কি উদাত্ত কণ্ঠে এই গান গাইতে পারে? — না। হতে পারে, দ্রুত নাট্যালিখনে দেবারতি গুহ ওরফে সোনাটা গানের আবহমেজাজ ভুলে গিয়ে থাকবেন। নাটকে আরও ভুল আছে। যেমন তিন নারী চরিত্রের পোশাকেই। অভিনয়েও। বাংলাদেশের গার্মেন্টসের নারীরা নিশ্চয়ই স্কার্ট পরে না। পরনে শাড়ি, মাথায় ঘোমটা (ধরে নিচ্ছি নাটক জার্মান দর্শকের জন্য, স্কার্ট পরবে। কিন্তু ঘটনা তো বাংলাদেশের। এখানেই নাটকের ঘাটতি)। নেই, শুরুতে ছিল, কিন্তু তারপরেই বেআব্রু। না, হতে পারে না। কেন পারে না, বাংলাদেশের গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকরা বলেছেন। নাটকে, দুই নারী চরিত্রে, লিজা সেট্ফ, লেয়া ভিক্টসার দারুণ অভিনয় করেছেন। একজন সুইজারল্যান্ডের (রাজধানী বার্নের), একজন জার্মানির (মূল বাড়ি কাসেলে। এখন বার্লিনে বাস)। ওঁরা বাংলা সংলাপ উচ্চারণ করেন। বাংলা গানও করেন। বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। উচ্চারণে, খুবই স্বাভাবিক, বঙ্গ-টান নেই, কিন্তু স্বরকণ্ঠে বঙ্গীয়। শিখিয়েছেন দেবারতি। বাংলাদেশের রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির ঘটনাবলী দেখিয়েছেন দেবারতি গুহ। দুই চরিত্র লিজা স্টেফ এবং লেয়া ভিটসারের চরিত্রের মাধ্যমে। দুর্বল নাট্যকলার পরকীয়া সত্ত্বেও দেবারতি গুহর নাটক বার্লিনের দর্শকমহলে তুমুল আলোচিত, প্রশংসিত। ধন্যবাদ দেবারতি গুহকে। তৃতীয় বিশ্ব এবং পশ্চিমাদেশের রাজনীতি ও আর্থিক মুখোশ খোলার জন্য। দেড় ঘণ্টার নাটকে চরিত্রের সংখ্যা তিন, তিনজনই নারী। বাংলাদেশে গার্মেন্টসে নারীই মূলত শ্রমিক এবং এই নারী শ্রমিকদের ওপরেই নির্ভর করে বাংলাদেশের আসল অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা ষাট ভাগ আয়। মঞ্চে তিনটি চরিত্র বটে, কিন্তু অজস্র চরিত্রের (বলা হয় সংখ্যায়) কণ্ঠ ধ্বনিত। বলে যায় নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা, জীবনের করুণ কাহিনী। স্বপ্ন। আশা-আকাক্সক্ষা। স্বামী-সংসার-সমাজ-রাষ্ট্রের কথা, তৈরি হয় সামগ্রিক পরিবেশ। পেয়ে যায় নাটকের মাত্রা। নাটকের নাম, সুই-সুতার গান (ইংরেজী নাম Songs of the T-Shirt)। যদিও জার্মান দর্শকের জন্যে নাটক, তবে, জার্মান নাম নয় নাটকের, অবশ্য দরকারও পড়ে না। নাটকে বাংলা, ইংরেজী, জার্মান বলা হচ্ছে দৃশ্যের পরম্পরায়। বাংলাও অনুবাদিত চরিত্রের সংলাপে। কাহিনী, সংলাপ, মঞ্চ পরিকল্পনা, সবই দেবারতি গুহর। নাটকে তিনি সোনাটা নামেই অভিনয় করেছেন, দেবারতি গুহ নয়। লিজা স্টেফ, লেয়া ভিট্সার ঢাকায় গিয়েছেন, গার্মেন্টস কারখানায় ঘুরেছেন, নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, জানতে চেয়েছেন, বুঝতে চেয়েছেন তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, জীবনাচার, আনন্দবেদনা, রক্তবহা সমাজের যন্ত্রণা। সুই-সুতার গান ফ্লিন থিয়েটারের প্রযোজনা। আর্থিক সাহায্য করেছে বার্লিন সিনেট, কাসেল কুটুরহাউস (টিফ স্টাট থিয়েটার কাসেল) এবং গ্যোয়েটে ইনস্টিটিউট (ঢাকায় তিন চরিত্রের যাতায়াত, থাকা-খাওয়ারও খরচ বহন করেছে গ্যোয়েটে ইনস্টিটিউট)। সুই-সুতার গানের পরিচালক সেফিয়া স্টেফ। মিউজিক আন্ডি ওটো এবং ফ্লোরিয়ান হাকে। মিউজিক বলতে বাংলা গান। রবীন্দ্র-নজরুল-ভাটিয়ালি এমন কি ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড়ও’ বাদ যায় না। ভাবিনি, সুই-সুতার গান দেখতে সোফিয়েন জিলের নাট্যপ্রেক্ষাগৃহে দর্শক উপচে পড়বে। তিনদিন তিনটি শো, টিকেট উধাও। আসলে মানবিক কাহিনীর প্রতি সব মানুষই একাত্ম। রানা প্লাজার মর্মান্তিক ঘটনাবলী পৃথিবীময় আলোড়িত। সুই-সুতার গান কাসেল এবং সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নেও অভিনীত হবে। সবদেশই সুই-সুতার গানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে জড়িত।
×