ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোন অগ্রগতি নেই

অভিজিত, ওয়াশিকুর ও অনন্ত হত্যার তদন্ত ডিপফ্রিজে!

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৪ মে ২০১৫

অভিজিত, ওয়াশিকুর ও অনন্ত হত্যার তদন্ত ডিপফ্রিজে!

শংকর কুমার দে ॥ মুক্তচিন্তার ব্লগার ও প্রগতিশীল লেখক অভিজিত রায় ও ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও অনন্ত বিজয় দাশ- এই তিন খুনের মামলার তদন্ত ডিপ ফ্রিজে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই তিন ব্লগার ও লেখকের নাম উল্লেখ করে তাদেরসহ অন্যদের হত্যার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আহ্বান জানিয়েছেন ১৭৮ লেখক, সাহিত্যিক। তিন লেখক ও ব্লগার হত্যাকা-ের জড়িত থাকার বিষয়ে দায় স্বীকার করে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের জঙ্গী সংগঠনসহ উগ্র মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী। কিন্তু তিন ব্লগার ও লেখকের খুনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। খুনীরা চলে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঢাকা ঢোল পিটিয়ে তদন্তকারীদের দৌড়ঝাঁপ এখন ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গোরোতে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। খুনীদের গ্রেফতারের বিষয়ে কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্তকারী সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানান, সর্বশেষ সিলেটে খুন হলেন মুক্তমনা ব্লগার ও লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। মুক্তচিন্তার একজন ব্লগার ও লেখক খুন হলেই তৎপর হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারপর কয়েকদিন তোড়জোড় দেখা যাওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যেই আবার তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। অভিজিত, ওয়াশিকুর ও অনন্ত হত্যা মামলার তদন্ত তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্লগার ও লেখক মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায় হত্যা মামলার তদন্তে সহায়তার জন্য ঢাকায় এসে তদন্ত সহায়তা করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই)। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ের কাছে জঙ্গী কায়দায় হামলায় নিহত হন অভিজিত। চাপাতির আঘাতে স্ত্রী বন্যার একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিত প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। হামলার ঘটনার দুদিন পর আহত যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বন্যাকে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর নেতা শফিউর রহমান ফারাবীর তথ্য আনসার বাংলা-৭ আমে টুইট করেছিল হিযবুত তাহরীর। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্যরাই হত্যা করেছে লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিত রায়কে। হিযবুত তাহরীরের উগ্রপন্থী গ্রুপের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে ফলো করে আসছে অভিজিত রায়কে। তাকে ফলো করার বিষয়টি ব্লগ ও ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করতেন শফিউর রহমান ফারাবী। জিজ্ঞাসাবাদে ফারাবী বলেছে, অভিজিত হত্যাকা-ে মোটেই অনুতপ্ত নয় তিনি। এই হত্যাকা-ের তদন্তে নেমে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। হত্যাকা-ের আগে ফেসবুকে হত্যার হুমকিদাতা ১০ জনের কাউকেই গ্রেফতার করা যায়নি এখনও। অভিজিত রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, এই খুনের ক্লু হতে পারে, ‘বইমেলার এশটি স্টল’ ও ‘দুজন লেখকের নাম’। অভিজিত রায়কে হত্যাকা-ের আগে ডেকে নেয়া হয়েছিল বইমেলায়, সেখানে গিয়ে একটি স্টলে আড্ডা দিয়েছিলেন, দুজন লেখক থাকার কথা ছিল। বইমেলার সেই স্টল ও দুজন লেখকের নাম অভিজিত হত্যাকা-ের ক্লু খুঁজে পেতে সাহায্য করবে পুলিশকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ডিবি। তারপরও কেন যেন অভিজিত রায়কে দুই মাস আগে হত্যাকা-ের পর তদন্ত যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, মুক্তচিন্তার ব্লাগার ও লেখকরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের টার্গেট। এসব জঙ্গীরা খুবই উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত। খুনীদের সঙ্গে সাইবার যুদ্ধে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না পুলিশ ও গোয়েন্দারা। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে খুনীরা বেশি সাইবার এক্সপার্ট। ফেসবুকে ও ব্লকে ছদ্মনাম ও ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করছে খুনীরা। ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে খুন করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে দুই দফায়। প্রথম দফায় খুনীদের একজন সাইফুল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। তাই, সেই যাত্রায় বেঁচে যায় ওয়াশিকুর। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় সফল হয় খুনীরা। খুন হন ওয়াশিকুর। খুনের সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে দুই মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফ। দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুনের নির্দেশদাতা ‘বড় ভাইয়ের’ নাম, ঠিকানার খোঁজ মিললেও তাকে পাচ্ছে না পুলিশ। আর অভিজিত রায় হত্যাকা-ের পর দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও ধরা পড়েনি খুনীরা। অভিজিত ও ওয়াশিকুর-এই দুই খুনের তদন্ত যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। থমকে গেছে ব্লগার ও লেখক অভিজিত রায় হত্যাকা-ের তদন্ত। ব্লগার ও লেখক ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকা-ের তদন্তে অগ্রগতি নেই। খুনীরা সাইবার এক্সপার্ট। পাল্লা দিয়ে খুনীদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না পুলিশ। তাই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে খুনীরা। খুনীরা সবাই সাইবার এক্সপার্ট হওয়ায় তাদের তথ্য অন্য কেউ পাচ্ছেন না। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সম্পর্কে জানতে পারছে না। খুনীরা যে ধরনের সাইবার এক্সপার্ট তার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম এক্সপার্ট পুলিশ ও গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছেন, রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার পর অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে (২৬) রাস্তায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে আবু তাহের, জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের তিন তরুণ। পুলিশ তাৎক্ষণিক খুনীদের ধাওয়া দিয়ে ঘটনাস্থলের কিছু দূর থেকে জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে আটক করে। তবে আবু তাহের পালিয়ে যায়। পালিয়ে যায় খুনী চক্রের নির্দেশদাতা মাছুমও। ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার জন্য প্রথম দফায় চেষ্টা করেন গত ২৪ মার্চ। পাঁচজন মিলে যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে তেজগাঁওয়ের উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। কিন্তু যাত্রাবাড়ীর পুলিশ চেকপোস্টে চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র ধরা পড়ে সাইফুল নামের এক সহযোগী। তারপর তারা ফিরে যায় যাত্রাবাড়ী এলাকার কাজলার বাসায়। তারপর ৩০ মার্চে দলনেতা মাসুম (বড় ভাই), আবু তাহের, জিকরুল্লাহ ও আরিফÑ এই চারজনে যায় তেজগাঁও বেগুনবাড়িতে। খুন করে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। এর মধ্যে সরাসরি খুনে অংশগ্রহণকারী দুজন জিকরুল্লাহ ও আরিফ ধরা পড়ে যায়। পালিয়ে যায় আবু তাহের। দলনেতা বড় ভাই মাসুমও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধরা পড়া দুজন জিকরুল্লাহ ও আরিফকে রিমান্ডে এনে তাদের নাম ঠিকানা জানা সত্ত্বেও ধরা সম্ভবপর হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ১২ মে মঙ্গলবার সকালে সিলেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে মুক্তমনার আরেক ব্লগার, লেখক ও ব্যাংকার অনন্ত বিজয় দাশকে। চার যুবক তাকে কুপিয়ে হত্যা করে নির্বিঘেœ পালিয়ে যায়। হত্যাকা-ের পর দায় স্বীকার করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এক টুইট বার্তায় লিখেছে, আলহামদুলিল্লাহ্! আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আল কায়েদা উপমহাদেশ শাখার ভাইরা আরও এক ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্লগার ও লেখক মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অভিজিত রায়কে হত্যার দায় স্বীকার করেছে ভারতীয় উপমহাদেশে তৎপর আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গী গ্রুপ আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট (সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এনটিটিজ) নামের একটি ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এই বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অভিজিত, ওয়াশিকুরসহ এর আগে যারা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে খুন হয়েছেন তারা সবাই ‘সাইবার এক্সপার্ট’। গোপনীয়তার জন্য তারা টেলিফোন, মোবাইল বা পরিচিত কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে না। এজন্য অবশ্য তারা নিজেদের আসল নামও ব্যবহার করে না। ধারণা করা হচ্ছে, খুনীরা জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সিøপার গ্রুপের সদস্য। যারা খুন হচ্ছেন তারা তারা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তচিন্তা ও ‘প্রগতিশীল লেখালেখি করতেন। খুনীদের সঙ্গে খুন হওয়া ব্লগার ও লেখকদের ফেসবুকে, ব্লগে ধর্মীয় বিষয়ে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়ার কারণে খুন করা হচ্ছে। খুনীরা তাদের ব্লগে, ফেসবুকে ছদ্মনাম, ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে কর্মকা- চালানোর কারণে তাদের শনাক্তকরণ, গ্রেফতার, খুন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তদন্তকারী গোয়েন্দারা। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, একের পর এক মুক্তচিন্তার ব্লগার ও লেখক হত্যার ঘটনায় খুনীরা চিহ্নিত হয়ে ধরা না পড়ার ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি দিতে না পারার ফল মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারা খুন হচ্ছেন। খুনীদের খুঁজে বের করে শান্তি না দিলে পুলিশের ওপর গণমানুষের আস্থা ফিরে আসবে না। উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে নির্মূল করা না গেলে মুক্তমনার লেখক ও ব্লগার খুনের ধারাবাহিকতা বন্ধ করা যাবে না। জঙ্গী গোষ্ঠীর উত্থান ও তৎপরতা বন্ধ করার জন্য মুক্তচিন্তার ব্লগার ও লেখক হত্যকারীদের গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এই সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
×