ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সারাজীবন গন্ধবিধুর ধূপ হয়ে জ্বলা দুখু মিয়া

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৫ মে ২০১৫

সারাজীবন গন্ধবিধুর ধূপ হয়ে জ্বলা দুখু মিয়া

মোরসালিন মিজান ॥ জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহন-শীল,/ তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।/ যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত,/ আজ নয় কাল ভাঙবে সে ত,/ যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া...। মানুষ রইবে। আর কিছু নয়। নয় পরোয়া। বহুকাল আগে নিজের রচনায় এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন কবি। মানুষের পক্ষে মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়া বিরল মানুষ ধর্মের নামে অধর্ম, জাতের নামে বজ্জাতির প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বিপ্লবী বীর। ‘বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।’ ‘অপমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ বুকে ধারণ করেছেন। সারা জীবন ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলা ‘দুখু মিয়া’ তিনি। তিনি কবি কা-ারি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের’ ১১৬তম জন্মবার্ষিকী আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ সোমবার। কবির ভাষায়Ñ আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু/ এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু...। বড্ড পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল নজরুলের। সেই কবেকার কথা! অথচ এই এখনও বিস্ময়কর আলো হয়ে পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালীকে। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ সারাদেশে উদ্যাপিত হবে জাতীয় কবির জন্মদিন। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান, পড়ালেখা শুরু করেন মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে রুটির দোকানে কাজ নেন। মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তোলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি বলেনÑ ...আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/ আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/ আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল...। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র। কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’ তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ার তাঁর। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষকেও কাছে টেনে নিয়েছেন। নারীর প্রতি উপেক্ষা মেনে নেননি। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী।’ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন আজকের নজরুল। তবে জীবনের বড় অংশ জুড়ে ছিল নানা লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ ১১৬তম নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, মহান এই কবি ধর্ম-বর্ণের উর্ধে উঠে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি সর্বজনের, সর্বকালের। রাষ্ট্রপতি বলেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কবির গান ও কবিতা অনিঃশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর লেখা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। নজরুল চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের প্রাণের কবি। আধুনিক বাংলা গানের বুলবুল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবোধের মূর্ত প্রতীক। অত্যাচার নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। কর্ম চিন্তা ও মননে কবির অবিনশ্বর উপস্থিতি বাঙালী জাতিকে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও উজ্জীবিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা ॥ এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে সারা দেশে উদ্যাপিত হবে ১১৬তম নজরুল জয়ন্তী। সকালে ঢাকায় কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের কর্মসূচী। এর পর দিনভর চলবে আলোচনা স্মৃতিচারণ উৎসব অনুষ্ঠান। বাংলা একাডেমি ॥ ১১৬তম নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি একদিন আগে রবিবার নজরুল মঞ্চে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ‘নরুলের প্রবন্ধ : রাজনৈতিক ভাবনা’ শীর্ষক একক বক্তৃতা প্রদান করেন অধ্যপক ড. মাহবুবুল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট নজরুল গবেষক এমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। ছায়ানট ॥ আগামী শুক্রবার থেকে ছায়ানটের আয়োজনে শুরু হচ্ছে দুই দিনব্যাপী নজরুল উৎসব। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে উৎসবের উদ্বোধন করবেন শিল্পী এস এম আহসান মুর্শেদ। থাকবে একক গান, আবৃত্তি, পাঠসহ নানা আয়োজন। দ্বিতীয় দিন শনিবার নজরুল স্মারক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ। থাকবে হিন্দোলের সম্মেলক গান আর নৃত্যদল নৃত্যনন্দনের পরিবেশনা। পাশাপাশি থাকবে অতিথি শিল্পী ও ছায়ানটের শিক্ষার্থীদের একক গান, আবৃত্তি ও পাঠ। চ্যানেল আই ॥ প্রতি বছরের ন্যায় এবারও চ্যানেল আই কার্যালয়ের সামনে আয়োজন করা হবে নজরুল মেলার। আজ সোমবার সকাল এগারোটায় মেলা শুরু হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন নজরুল গবেষক, কবি সাহিত্যিক শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। উন্মুক্ত মঞ্চ থেকে গান কবিতা নৃত্যনাট্যের ভাষায় স্মরণ করা হবে কাজী নজরুল ইসলামকে। থাকবে নজরুল রচনাবলী থেকে পাঠ। ছবি আঁকবেন শিল্পীরা। এসবের বাইরে মেলায় থাকবে ২৫টির মতো স্টল। এসব স্টলে নজরুলের রচনা, নজরুলকে নিয়ে রচনা, নজরুল চিত্রকলা, নজরুল সঙ্গীতের পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ডের কাভার ইত্যাদি প্রদর্শিত হবে। ঢাকার বাইরেও থাকছে বর্ণাঢ্য আয়োজন। জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপনে ময়মনসিংহের ত্রিশালে বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে নজরুলের স্মৃতিধন্য দরিরামপুরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। সোমবার সকালে শুরু হবে অনুষ্ঠান। এসবের বাইরে সারা দেশের অসংখ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয় কবিকে শ্রদ্ধা ভালবাসায় স্মরণ করবে। দ্রোহ প্রেম সাম্যের কবিকে অঞ্জলি জানাবে অগণিত ভক্ত।
×