ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বধ্যভূমিতে মিলছে শত শত অভিবাসীর কঙ্কাল

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৭ মে ২০১৫

বধ্যভূমিতে মিলছে শত শত অভিবাসীর কঙ্কাল

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে জীবনবাজি রেখে সাগরপথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের কত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে, এখনও কতজন ভাসছে আর কতজন নিখোঁজ রয়েছে এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। ভবিষ্যতেও এর পরিসংখ্যান সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ ঘনীভূত হয়ে আছে। এ কথা সত্য যে, সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী দালালদের লোভের খপ্পরে পড়ে মিয়ানমারের বহু দেশান্তরি রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী কেউ জেনে-শুনে আর কেউ না জেনে পাড়ি জমিয়েছিল। তবে মাঝপথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে অনেকের জন্য যে বন্দীশিবির ও গণকবর স্থায়ী ঠিকানা হতে যাচ্ছে এ বিষয়টি ভাগ্য বিড়ম্বিতরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। দিনের পর দিন সাগরে ভাসতে ভাসতে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে, তার ওপর রোগে শোকে আক্রান্ত হয়ে এ সব অবৈধ অভিবাসীদের নানা গ্রুপে বিভক্ত দল অজানা উপকূলে পৌঁছেছে ঠিকই। কিন্তু নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি। তাদের ঠাঁই হয়েছে থাইল্যান্ডের শঙ্খলা প্রদেশ ও মালয়েশিয়ার পের্লিস প্রদেশের পেদাং পেসার ও ওয়াংকেলিয়ান এলাকার বন্দীশিবিরে। এ বন্দীশিবিরেই অমানুষিক নির্যাতনে তাদের শেষ ঠিকানা হয়েছে গণকবরে। ওইসব গণকবর থেকে এখন বেরিয়ে আসছে গলিত লাশ ও মনুষ্য কঙ্কাল। যে কঙ্কালের সংখ্যা শ’ শ’ ছাড়িয়ে যাবে বলে মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষে ধারণা করা হচ্ছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী থাইল্যান্ড সরকার দাবি করেছে, শঙ্খলা প্রদেশের জঙ্গলে আর কোন গণকবর বা বন্দীশিবিরের খোঁজ মেলেনি। অপরদিকে, মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পের্লিস প্রদেশের দু’দফায় যে ১৩৯টি গণকবর ও ২৮টি পরিত্যক্ত বন্দীশিবিরের খোঁজ মিলেছে পুলিশ ও সেনা অভিযানে মঙ্গলবার পর্যন্ত এ সংখ্যা আর বাড়েনি। গণকবরগুলো থেকে একের পর এক পচা ও গলিত ক্ষত-বিক্ষত খ- বিখ- লাশ বেরিয়ে আসছে ফরেনসিক বিভাগের মাধ্যমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কফিনবন্দী করছে সে দেশের পুলিশ। সর্বশেষ মঙ্গলবার পর্যন্ত মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষে লাশের সংখ্যা কত তা জানাতে পারছে না বলে দেশী বিদেশী গণমাধ্যম কর্মীদের জানানো হয়েছে। কেননা, গলিত এ সব লাশের হাড়গোড় দিয়ে মৃতের সংখ্যা গণনা করা সম্ভব বলে জানানো হয়েছে। ২৯ মে সতের দেশীয় বিশেষ বৈঠক ॥ এদিকে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশীদের নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আগামী ২৯ মে শুক্রবার থাইল্যান্ড সরকারের উদ্যোগে সে দেশে বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়েছে। সে দেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল চীফ (এনএসসি) আনুসিত কুনাকর্ণ বলেছেন, এ বৈঠকের আয়োজক থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৈঠকে থাইল্যান্ড ছাড়াও ১৬টি দেশ এবং জাতিসংঘের তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা অংশ নেবে। এনএসসি প্রধান আশা করছেন, ওই বৈঠক থেকে সমস্যা সমাধানে একটি সুন্দর পথ বেরিয়ে আসবে। সে দেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, অবৈধ অভিবাসীরা বাংলাদেশের কক্সবাজারের রিফিউজি ক্যাম্প এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের। নির্যাতনেই মৃত্যু এবং গণকবরে শ’ শ’ মনুষ্য কঙ্কাল ॥ মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ পের্লিসে আবিষ্কৃত ১৩৯টি গণকবর থেকে লাশ তোলার কাজ এগিয়ে চলেছে। মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান খালিদ আবু বকর সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত ১১ মে থেকে খুঁজে পাওয়া ১৩৯টি গণকবরের প্রত্যেকটিতে একাধিক মৃতদেহ রয়েছে। তাঁর মতে, মৃতের সংখ্যা শত শত হবে। গত ২৩ মে মালয়েশিয়ার এ জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান লাভের পর থেকে মালয়েশিয়া সরকার এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না কতসংখ্যক অভিবাসীকে নির্যাতনে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়েছে। অভিবাসীদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী চাকরিপ্রার্থী এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে পলাতক রোহিঙ্গা মুসলমান রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, আবিষ্কৃত বন্দীশিবিরে অস্ত্রশস্ত্রও মিলেছে। মানবপাচারকারী চক্র বর্বর নির্যাতন চালিয়ে অভিবাসীদের হত্যা করেছে। মালয়েশিয়া সরকার অবশ্যই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করবে। মানবপাচারকারীদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ॥ সরকার মানবপাচার ঘটনা নিয়ে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, মানবপাচার নিয়ে বিচার কার্যক্রম নিয়ে আগে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের অধীন ছিল। মানবপাচারের সঙ্গে যুক্তদের বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠিত হচ্ছে। থাইল্যান্ডে গ্রেফতার ৮০ ॥ মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে থাই সরকার এ পর্যন্ত ৮০ জনকে গ্রেফতার করেছে। এরা চোরাচালানের সঙ্গেও জড়িত। গ্রেফতারের ঘটনা তাদের প্রথম পদক্ষেপ বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা মূল গডফাদারদের এখনও খুঁজে পায়নি। এছাড়া থাই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শঙ্খলা প্রদেশে অভিযানে আর কোন বন্দীশিবির বা গণ কবরের সন্ধান মেলেনি। নেপথ্যে জড়িতদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ঘোষণা মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রীর ॥ মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক তাঁর টুইটার এ্যাকাউন্টে আবারও বলেছেন, গণকবরের নেপথ্যে জড়িতরা পার পাবে না। এ বর্বরোচিত ঘটনায় জড়িতদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার মাটিতে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ায় তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এর সঙ্গে মানবপাচারকারীরা জড়িত। হোতাদের আমরা খুঁজে বের করবই। মানবপাচারে সন্ত্রাসী বাহিনী ॥ মানবপাচারকারী গডফাদাররা গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেলেও তাদের গঠিত সন্ত্রাসী বাহিনী এলাকায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং নিখোঁজদের অভিভাবকদের গুম করে ফেলার হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। থাইল্যান্ড মালয়েশিয়ার গণকবরে নতুবা সাগরবক্ষে প্রাণ হারানো হতভাগ্য নিখোঁজদের সন্ধানে মামলা করলে প্রাণে শেষ করে দেয়া হবে বলে হুমকি দিচ্ছে মানবপাচারকারী চক্রের অর্থের সন্ত্রাসী বাহিনীর ক্যাডাররা। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া, রামু, মহেশখালী ও সমিতিপাড়া-নাজিরারটেক এলাকায় মানবপাচার সহজ করতে বখাটে যুবকদের নিয়ে গডফাদাররা গোপনে গড়ে তুলেছে সন্ত্রাসী বাহিনী। পাঁচ মাসে ৬৬ দালাল আটক ॥ গত পাঁচ মাসে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ মে পর্যন্ত ৬৬ জন দালালকে গ্রেফতার করেছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। সমাজপতিদের অনেকে জানান, আটক দালালরা হচ্ছে মানবপাচার কাজে চুনোপুঠি। ধলু হোছন নামে একজন গডফাদারসহ ৫ দালাল বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও শীর্ষ গডফাদারদের কাউকে এ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ বলছেÑ শীর্ষ গডফাদাররা গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে থাকায় তাদের পাকড়াও করা যাচ্ছে না। তবে যেভাবেই হোক, মানবপাচারকারী গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রাখবে। মোবাইল কললিস্ট ট্র্যাকিং করার দাবি ॥ জীবন বদলে দেয়ার মিথ্যা আশ্বাসে ফেলে বহু যুবক ও কিশোরকে পরিবারের অজান্তে নতুবা অপহরণ করে মালয়েশিয়ায় পাচারকারী গডফাদারদের সঙ্গে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার গোপন সহযোগিতা ছিল বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। গডফাদাররা মানবপাচার কাজ সহজ করতে পুলিশের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তার সঙ্গে মুঠোফোনে হরদম যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো বলে জানা গেছে। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বপালনকারী ওইসব কর্মকর্তা এবং ধান্ধাবাজ নেতাদের মুঠোফোনের কললিস্ট ট্যাকিং করা হলে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল। আত্মগোপনে থাকা মহিলা গডমাদার রেবি ম্যাডামের সঙ্গে ক’দিন আগে উখিয়ার জনৈক পুলিশ কর্মকর্তার মুঠোফোনে আলাপ হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। ২৫ লাখ টাকাসহ দালাল আটক ॥ মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে সাগরপথে মানবপাচার করে দালাল চক্র কোটি কোটি টাকা জমা করেছে বিভিন্ন ব্যাংকে। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি না থাকায় হঠাৎ এত বেশি টাকা জমা করার বিষয়ে সন্দেহ হওয়ায় ইতোপূর্বে ইসলামী ব্যাংক কক্সবাজার শাখায় গডফাদার শামসুল আলমের এবং কোর্টবাজার শাখায় বাপ্পু দালালের আত্মীয়ে বিপুল টাকা আটকে দিয়েছিলেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই দালালরা ব্যাংক ব্যবস্থাপকের সঙ্গে অবৈধ আর্থিক লেনদেন শেষে সমস্ত টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মঙ্গলবার সকালে টেকনাফ সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে এক সঙ্গে ২৫ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়ার সময় বড়হাজীপাড়ার শাহ আলমের পুত্র নুরুল আলমকে আটক করেছে পুলিশ। আটক ব্যক্তি মানবপাচারের সঙ্গে এবং ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। মিয়ানমার প্রথমে ছিল সরব, এখন নীরব ॥ মিয়ানমারে যে ২০৮ অভিবাসী উদ্ধার হয়েছে তাদের বাংলাদেশী বলে উল্লেখ করে দ্রুত এদেশে ফেরত পাঠাতে সরব হয়। এদের প্রত্যেকের নামের তালিকাও প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে জাতীয়তা নিশ্চিত না করে কাউকে ফিরিয়ে আনা হবে না মর্মে জানিয়ে দেয়া হলে মিয়ানমার থমকে যায়। পরে বাংলাদেশের পক্ষে সে দেশের মংডু শহরে বৈঠক করে উদ্ধারকৃতদের যারা বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত হবে শুধুমাত্র তাদেরকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়। এ বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সিগন্যালের অপেক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার গত তিনদিন ধরে নীরব রয়েছে। মিয়ানমার চাইছে সে দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমরা দেশান্তরিত হোক। এছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে ইতোপূর্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কক্সবাজারে দু’টি শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানকারী মিয়ানমার নাগরিকদের গেল ৯ মাসেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সীমান্তের ওপারের একাধিক সূত্র মতে, বাংলাদেশে অবস্থানকারী শরণার্থীদের খুব তাড়াতাড়ি মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কেননা তারা (রোহিঙ্গা শরণার্থী) মিয়ানমারের নাগরিক কি-না তা যাচাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে দাবি করছে সে দেশের সরকার। ওইসব শরণার্থীদের বাবা-মা দু’জনই দেশটির নাগরিক ছিল কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে হবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। ১৯৮২ সালে প্রণীত সে দেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী যাদের বাবা-মা দু’জনই মিয়ানমারের নাগরিক ছিলেন- শুধু তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে দেশের সরকার।
×