ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সন্দেহভাজন আরও একজন র‌্যাবের নজরদারিতে

গারো তরুণী ধর্ষণে আটক তুষার ও লাভলুর স্বীকারোক্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৮ মে ২০১৫

গারো তরুণী ধর্ষণে আটক তুষার ও লাভলুর স্বীকারোক্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর কুড়িল থেকে তুলে নিয়ে মাইক্রোবাসে গারো তরুণীকে গণধর্ষণে জড়িত দুই ধর্ষক তুষার ও লাভলুকে আটক করেছে র‌্যাব। এ দু’জন আটক হওয়ার পরও গণধর্ষণের প্রকৃত রহস্য থেকে যাচ্ছে। কতজন তাকে ধর্ষণ করেছে- পাঁচ না দুই জন সেটা এখন নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ঘটনার পর মুহূর্ত থেকেই মেয়েটি নিজেই পাঁচ ধর্ষকের কথা বলতে থাকেন এবং সেভাবেই থানায় মামলাও করেন। কিন্তু এখন র‌্যাব দাবি করছে-এটা ঠিক নয়। ধর্ষক দু’জনই। থানায় মামলা করার স্বার্থেই মেয়েটি পাঁচজনের কথা বলেছে। র‌্যাব আটককৃত দুই ধর্ষক তুষার ও লাভলুকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে সুস্পষ্ট করেই বলেছে- পাঁচ জন নয়, মাত্র দুই জনই মেয়েটিকে মাইক্রোবাসের ভেতর ধর্ষণ করে। এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। ধর্ষকদের সঙ্গে মাত্র কয়েকদিন আগেই যমুনা ফিউচার পার্কে মেয়েটির পরিচয় হয়। তারপর মেয়েটিকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ফুঁসলিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে এ কা- ঘটায়। র‌্যাব জানায়, ধর্ষক তুষারকে মঙ্গলবার রাত একটার দিকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় আটক করা হয়। তার কয়েক ঘণ্টা পর বুধবার ভোরে গুলশান-১ থেকে আটক করা হয় লাভলুকে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাইক্রোবাসটিও (ঢাকা মেট্রো-চ ১৫-৪৭০১) রাজধানীর বনানীর ২১ নম্বর সড়ক থেকে উদ্ধার করা হয়। আটকের পর বুধবার সকালে তারা দু’জনই র‌্যাবের কাছে স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। এরই ভিত্তিতে র‌্যাব দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন-ধর্ষণের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। ধৃত তুষার ও লাভলু সব অপরাধ স্বীকার করে র‌্যাবের কাছে স্বীকার করেছে- গত ১৭ তারিখ সাউথ আফ্রিকার দু’জন তরুণীকে নিয়ে তারা যমুনা ফিউচার পার্কে যায়। সেখানে একটি সুপারশপে মেয়েটির সঙ্গে তুষারের পরিচয় হয়। তুষার ওই দিন মেয়েটির ফোন নম্বরও জোগাড় করে। পরদিন ফোনে মেয়েটির বর্তমান চাকরি, বেতন ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে চায় সে এবং তাকে বলে, বায়িং হাউজে চাকরির বেতন ও সুবিধা অনেক। ওই তরুণী বায়িং হাউজে কাজ করতে আগ্রহী কি না, সে জানতে চায়। মেয়েটি সরল বিশ্বাসে বায়িং হাউজে চাকরির আগ্রহের কথা জানায়। এরপর আরও দুদিন তুষার ফোনে কথা বলেন ওই তরুণীর সঙ্গে। ২০ মে তুষার উত্তরার জসীমউদ্দীন মোড়ে গিয়ে মেয়েটিকে বায়োডাটা ও চাকরি সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রস্তুত করতে বলেন। কয়েকদিনের ফোনে কথাবার্তার মধ্যেই তুষার কৌশলে মেয়েটি কোথায় থাকে, কখন কর্মস্থল থেকে বের হয় ইত্যাদি তথ্য জেনে নিয়েছিল। এরপর ঘটনার দিন ২১ তারিখ রাত ৯টার দিকে তুষার মেয়েটিকে ফোন করে বলে, তারা যমুনা ফিউচার পার্কের আশপাশেই আছে, মেয়েটি যেন অফিস থেকে বের হয়ে তার বায়োডাটা তাদের কাছে দেয়। ওই সময় তারা (তুষার ও লাভলু) মাইক্রোবাস নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের উল্টো দিকে একটি রেস্তরাঁর কাছে অপেক্ষার কথা জানায় তরুণীকে। মুফতি মাহমুদ বলেন, “মেয়েটি মাইক্রোবাসের কাছে গেলে তুষার তার হাত ধরে জোর করে গাড়িতে তুলে ফেলে এবং মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে দু’জন তাকে ধর্ষণ করে। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে নির্যাতনের শিকার তরুণীকে উত্তরা জসীমউদ্দীন রোডে ফেলে রেখে দু’জন পালিয়ে যায়। র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মাইক্রোবাসে দু’জনের বেশি আর কারও থাকার তথ্য তারা পাননি। ধর্ষণকারী আসলে কয়জন ছিল, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে কি না- প্রশ্ন করা হলে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এটা এখনই বলা সম্ভব নয়। পরীক্ষা করে দেখতে হবে। র‌্যাব জানায়, বরগুনার আমতলীর চুনাখালি গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে তুষার (৩৫) চুনাখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। ১৯৯৯ সালে ঢাকায় আসার পর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ট্রলারে কাজ শুরু করেছিল তুষার। এরপর সে ড্রাইভিং শিখে ট্যাক্সিক্যাব চালানো শুরু করে। পরে পূর্বপরিচিত একজনের মাধ্যমে গুলশান-১ এলাকার ‘সিগনেট’ বায়িং হাউজে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেয়। গ্রেফতার আরেক আসামি জাহিদুল ইসলাম লাভলুর (২৬) বাবার নাম মোবারক আলী হাওলাদার। বাড়ি ঝালকাঠীর কাঁঠালিয়া থানার তালতলা গ্রামে। মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তার পড়ালেখা। সেও তুষারের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালায়। এদিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার তুষার ও লাভলু র‌্যাবকে জানিয়েছে, ওই তরুণীকে ধর্ষণের পরিকল্পনা পাঁচ দিন আগে করে তারা এবং সেজন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। আরেক বন্ধু ফিরোজও ‘সিগনেট’ বায়িং হাউজের আরেক গাড়িচালক। প্রকৃতপক্ষে কত জন ॥ প্রশ্ন উঠেছে পাঁচ না দুই জন ধর্ষণ করেছে ওই তরুণীকে। ঘটনার শুরু থেকেই মেয়েটি বার বার পাঁজনের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা বলে আসছেন। এখন দুজন ধরা পড়ার পর র‌্যাব দাবি করছে পাঁচ জনের কথা ঠিক নয়। বিশেষ কৌশলগত কারণে মেয়েটিকে পাঁচ জনের কথাই বলতে হয়েছিল। সেই বিশেষ কৌশলটা কি জানতে চাইলে র‌্যাবের কোন কর্মকর্তা সরাসরি স্বীকার করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে র‌্যাবের দায়িত্ববান কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, মেয়েটি বায়োডাটা নিয়ে কুড়িলে এসে তুষারের হাতে দেয়। তখন তুষার তাকে বলে-আসো তোমাকে জসীমউদদীন মোড়ে লিফট দেই। তখন মেয়েটি রাজি হয়নি। তখন হাত টেনে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নেয় তুষার। এক পর্যায়ে তুষার তাকে গালে থাপ্পড় দেয়। এ সময় অবিবাহিত মেয়েটি কৌশলগত কারণে মিথ্যা কথাই বলেন-আমার স্বামী আছে। আমার সর্বনাশ করবেন না। এরপর মেয়েটি কাঁদতে থাকলে তাকে বলা হয়-এতে বেশি বাড়াবাড়ি করলে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলা হবে। এমন ভয় দেখিয়েই তুষার মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। পরে সে চালকের আসনে গিয়ে বসার পর চালক লাভলু এসে মেয়েটির ওপর চড়াও হয়। মাইক্রোবাসটি প্রথমে কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচেই এক চক্কর দেয়। এতেই প্রায় আধ ঘণ্টা চলে। পরে গাড়িটি উত্তরার দিকে ছোটে। কুড়িল থেকে উত্তরা জসীমউদ্দীন মোড়ে নিয়ে গাড়ি থেকে তাকে নামিয়ে দেয়া হয়। র‌্যাব জানায়, মেয়েটি সেখান থেকে বাসায় গিয়ে সব খুলে বলেন। তখন তাকে নিয়ে প্রথমে উত্তরা পশ্চিম থানা, পরে খিলক্ষেত থানা, সর্বশেষ ভাটারা থানায় যাওয়া হয়। পুলিশ মেয়েটির এ বক্তব্যে ধর্ষণ মামলা নিতে গড়িমসি করে। কিছুতেই তার অভিযোগ আমলে নিতে চায়নি। রাত থেকে সকাল পর্যন্ত থানাতেই তিনি অবহেলার শিকার হন। এক পর্যায়ে মেয়েটি তার এক মামার কাছে খুলে বলেন-পুলিশ বেশি আসামি ছাড়া গণধর্ষণের মামলা নিতে চায় না। এ কথা মেয়েটির মামা পুলিশের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে জানান। ওই কর্মকর্তা বিষয়টি আরও ওপর মহলে জানালে সবার টনক নড়ে। এ সময় মেয়েটির মামা পাঁচ জনকে অজ্ঞাত আসামি করেই এজাহার লেখার পরামর্শ দেন। মেয়েটি তাই করেন। র‌্যাব এমনটি দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে কতজন সেই রাতে মাইক্রোবাসে ছিল তা যাচাই করার কোন উপায় নেই। মেয়েটি এখন তেজগাঁওয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আছেন। গতকাল সাংবাদিক সম্মেলন করার আগে একজন র‌্যাব কর্মকর্তা ভিকটিম সেন্টারে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে আলোচনা করেন। জানা যায়, এ ঘটনায় দুই জন সরাসরি জড়িত থাকলেও পরিকল্পনায় আরও একজন জড়িত ছিল। তার নাম ফিরোজ। সেও এ দু’জনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মেয়েটিকে মাইক্রোবাসে তোলার আগেই সেই ফিরোজ ফোন করে তুষারকে বলে-তুই কিন্তু আমাকে বাদ দিয়ে কিছু করিস না। র‌্যাব জানায়, ফিরোজও তাদের নজরে আছে। তাকে এ মামলায় প্রধান সাক্ষী করা হতে পারে। তুষার যা বলে... র‌্যাবের পরিচালক বক্তব্য দেয়ার পর তুষারকে সাংবাদিকদের সামনে সেই ঘটনা নিজের মুখে স্বীকার করতে বলা হয়। এ সময় তুষার বলে- ঘটনার কদিন আগেই একজন বিদেশীকে নিয়ে যমুনা ফিউচারের ওই দোকানে যাই। সেখানেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়। তার নাম সুস্মিতা চাম্বু গম। তারপর থেকেই চলে ফোনালাপ ও দেখাশোনা। আমি তাকে আমার অফিসে বেশি বেতনের চাকরির আশ্বাস দেই। এক পর্যায়ে মেয়েটি আমার কাছে দশ হাজার টাকা কর্জ চায়। আমি তাকে আট হাজার টাকা ধার দেই। তারপর সেই রাতে তাকে বায়োডাটা নিয়ে আসতে বললে সে আসে। তারপর মাইক্রোতে উঠিয়ে প্রথমে আমি পরে লাভলু এই কাজ করি। এ ঘটনায় অপর পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ফিরোজকেও আটক করা হবে বলে জানায় র‌্যাব। সে নজরবন্দী আছে বলে জানায় র‌্যাব। এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা নিতে অবহেলার অভিযোগ ওঠায় পাঁচ মানবাধিকার সংগঠনের রিট আবেদনে হাইকোর্ট তিনটি রুল জারি করে। এ ঘটনায় বুধবারও রাজধানীতে মানববন্ধন করেছে একাধিক সংগঠন।
×