ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস

নিরাপদ মাতৃত্ব সুবিধা থেকে বঞ্চিত ৪৫ শতাংশ নারী

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৮ মে ২০১৫

নিরাপদ মাতৃত্ব সুবিধা থেকে বঞ্চিত ৪৫ শতাংশ নারী

নিখিল মানখিন ॥ বর্তমানে ৫৫ শতাংশ মায়ের নিরাপদ মাতৃত্ব সুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছে সরকার। বাকি ৪৫ শতাংশ মা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। দেশে শতকরা ৬৮ ভাগ প্রসব বাড়িতে হয় এবং অবশিষ্ট ৩২ ভাগ প্রসব হয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাপ্রদানকারীদের মাধ্যমে। গর্ভকালীন সময় শতকরা ১৪ জন মহিলাই নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতায় ভোগেন, যা মাতৃমৃত্যুর জন্য বহুলাংশে দায়ী। প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, গর্ভকালীন জটিলতা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা ও পরিবারের অবহেলা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তবে শতকরা ৫১ ভাগ মৃত্যুই রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে হয়ে থাকে। মাত্র শতকরা ৬৮ ভাগ গর্ভবতী মহিলা একটি প্রসবপূর্ব সেবা এবং ২৬ ভাগ মহিলা চারটি প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণ করে থাকেন। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার অনেক অগ্রগতি হয়েছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে নানা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকল্পে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি এ্যাডমোকেট মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস পেয়ে প্রতি লাখে জীবিত জন্মে ১৯৪ এ কমে এসেছে বলে দাবি করে আসছে সরকার। কিন্তু সরকার ঘোষিত মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাসের পরিসংখ্যান ও প্রচলিত মাতৃস্বাস্থ্য সেবার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও মায়েদের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেশে এখনো স্থায়ী ব্যবস্থাপনা নেই। মায়ের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী যতেœর অভাব প্রকট রয়েই গেছে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ নারী মা হন। আর মায়েদের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা না থাকায় তাদের বড় একটি অংশ সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। মাতৃস্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম শুধু সন্তান প্রসবকেন্দ্রিক সেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। সন্তান প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে যারা মারা যান, তাদেরকে ধরেই এ হিসাব করা হয়। কিন্তু একই ধারাবাহিকতায় এর পরবর্তীতে যারা মারা যান, তাদের হিসাব থাকে না, যা মোটেও সমীচীন নয়। তাই মাতৃমৃত্যুর হিসাব করলে সব মায়ের হিসাব করা দরকার। একইভাবে মাতৃস্বাস্থ্য সেবা বললে সব মায়ের স্বাস্থ্যসেবাকে বিবেচনায় নিতে হবে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ও মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে সরকারের অঙ্গীকার ও টাকার অভাব নেই, অভাব আছে প্রতিশ্রুতি ও মনিটরিং ব্যবস্থার। তাই মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি সবার কমিটমেন্ট নিয়ে এগিয়ে যাওয়া দরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোঃ নূরুল হক জানান, সরকার মাতৃমৃত্যু হার কমানোর জন্য ইতোমধ্যে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। স্বাস্থ্য অবকাঠামো বৃদ্ধির পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরি এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও ওষুধ সরবরাহ বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও ৫৯টি জেলা হাসপাতাল, ৬৮টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং ১৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ জরুরী প্রসূতি সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, দেশে এখনও শতকরা ৬৮ ভাগ প্রসব বাড়িতে হয় এবং শতকরা ৩২ ভাগ প্রসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাপ্রদানকারীদের মাধ্যমে হয়। গর্ভকালীন সময় শতকরা ১৪ জন মহিলাই নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতায় ভোগেন, যা মাতৃমৃত্যুর জন্য বহুলাংশে দায়ী। প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, গর্ভকালীন জটিলতা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা ও পরিবারের অবহেলা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তবে শতকরা ৫১ ভাগ মৃত্যুই রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে হয়ে থাকে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ নূর হোসেন তালুকদার জানান, সুস্থ শিশু ও সুস্থ মা সবার কাক্সিক্ষত বিষয়। এ জন্যই নিরাপদ মাতৃত্ব ১০০ ভাগে উন্নীত করতে হবে। বাল্য বিবাহ এখনো দেশের একটি সামাজিক ব্যাধি। দেশে এখনও মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স ১৬.৪ এবং এক-তৃতীয়াংশ মহিলা ২০ বছর বয়স হওয়ার আগেই মা হয়ে যায়। আর জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২৩ ভাগই হচ্ছে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। এ অল্প বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য কার্যক্রম ইতিবাচক প্রভাবে ফেলতে পারেনি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর পরিকল্পিত পরিবার গঠনের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিরাপদ মাতৃত্ব, জেন্ডার বিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে বিগত ছয় দশক ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সকল সক্ষম দম্পতিদের যদি পরিবার পরিকল্পনা, মা-শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির সহজ সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তবে কর্মসূচীতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ অনেকাংশেই উত্তরণ করা সম্ভব। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ২০০১ সালে প্রতি লাখে মাতৃ মৃত্যুহার ছিল ৩২২ জন। এই হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং তা অর্জনে মা নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নকল্পে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। ২০১০ সালে ওই হার কমিয়ে ১৯৪-এ আনা হয়। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ২০১৫ সালের মধ্যে এই হার ১৪৩-এ কমিয়ে আনা হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে সাফল্যের কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এমডিজি পুরস্কার দেয়া হয়। মাতৃ মৃত্যুহার কমে এলেও বাস্তবে এখনও অনেক অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। এর কারণ সচেতনতার অভাব। এখনও বাংলাদেশে অনেক মা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুবরণ করছেন। একটি কিশোরীর মাঝে নারীত্ব ফুটে উঠলেও মাতৃত্ব, সন্তান লালন-পালন ও গর্ভাবস্থায় যতœ সম্পর্কে সচেতন হতে সময়ের প্রয়োজন হয়। সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে হলে শারীরিক মানসিক সবদিক দিয়ে একজন মাকেও সুস্থ থাকতে হবে। পপুলেশন কাউন্সিলের এক জরিপ মতে, প্রতিবছর ৩০ লাখ শিশু জন্মায়। তার মধ্যে জেলায় ৬০ হাজার, উপজেলায় ৪ হাজার ও ইউনিয়নে ৬০০ জন করে। মাতৃ মৃত্যুহার কমাতে হলে নারী শিক্ষার হার আরও বাড়াতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধ হলেই বছরে ১০ লাখ জন্ম কমবে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ৪৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে মাতৃস্বাস্থ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, দেশটি উন্নতি করছে। সরকারী এক তথ্যে জানা গেছে, দেশে মাতৃমৃত্যুর বর্তমান হার ৩.৪ শতাংশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। গত কয়েক বছরে দেশে মাতৃমৃত্যু রোধের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে।
×