ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তি ॥ নবায়নের পর আরও চারটি বর্ডারহাট চালু হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৯ মে ২০১৫

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তি ॥ নবায়নের পর আরও চারটি বর্ডারহাট চালু হবে

এম শাহজাহান ॥ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ থাকছে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তিতে। এই চুক্তি নবায়নের পর ভারতের ভূ-খ- ব্যবহার করে নেপাল-ভুটানে সড়ক এবং রেলপথে পণ্য বাণিজ্য করতে পারবে বাংলাদেশ। চুক্তি নবায়নের পর অন্তত আরও চারটি বর্ডার হাট চালু করা হবে। এসব হাটে বৈধভাবে গরু কেনাবেচার প্রস্তাব দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। এছাড়া ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে তা সমাধানের পদক্ষেপ থাকছে নতুন চুক্তিতে। দু’দেশের উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগ সহজীকরণ করা হবে। বাংলাদেশী উদ্যোক্তারাও ভারতে বিনিয়োগ করতে পারবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিতে বেশ কিছু অন্তরায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- শুল্ক ও অশুল্ক জনিত সমস্যা, কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। এছাড়া স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়া, কাস্টমস হাউসগুলোর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট, ভিসা প্রাপ্তির জটিলতা না কাটা, ব্যবসায়ীদের জন্য মাল্টিপল ভিসা প্রদান বন্ধ থাকা, সীমান্ত হাটগুলো পুরোমাত্রায় চালু না হওয়া, বিএসটিআই ও বিআরটিএ’র ল্যাবরেটরি টেস্টের স্বীকৃতি না দেয়া এবং ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপীর অব্যাহত দরপতনে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমেছে না। তবে এসব বাধাগুলো দূর করতে পারলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস ও রফতানি বাড়াতে বেসরকারী খাতের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কোটা ও শুল্কমুক্ত তৈরি পোশাক রফতানিতে দু’দেশের উচ্চপর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে। তবে বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার উদ্যোগে তেমন সফলতা আসেনি। এজন্য ব্যবসায়ীরা ভারত সরকারের নেয়া বিভিন্ন পলিসিকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রয়োজনেই ভারতের বাজারে প্রবেশ করা জরুরী। এজন্য ওই দেশটিতে রফতানি বাড়াতেই হবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা ও দুই দেশের সীমান্তবাসীদের তৈরি পণ্যের বাজার সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নিয়ে বর্ডার হাট চালু হয়েছে। কিন্তু বর্ডার হাটগুলো সেভাবে কার্যকর করা যায়নি। তবে এবার চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চারদেশীয় ট্রানজিট চুক্তির পথ উন্মুক্ত হবে এই চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তিটি নবায়নের পর ভারতের ভূ-খ- ব্যবহার করে নেপাল-ভুটানে সড়ক ও রেলপথে পণ্য বাণিজ্য করতে পারবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ভারত নৌপথের পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তি নবায়নের সময় নতুন ধারা যুক্ত করে এটি কার্যকর করা হবে। এছাড়া বিদ্যমান নৌপ্রটোকল অনুযায়ী, এক দেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহনের ওপর কোন ধরনের চার্জ বা ফি নেই। তবে এবার সংশোধিত চুক্তিতে সেবার বিপরীতে চার্জ বা ফি নির্ধারণের প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বেশি পণ্য পরিবহন করবে, তাই চার্জ বা ফি আরোপ করা হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে মনে করছে সরকার। এছাড়া বাণিজ্য চুক্তি পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হবে। মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাতে চুক্তিটি নবায়ন হতে পারে সে বিষয়টিও ভেবে দেখা হচ্ছে। প্রতিবেশী এই দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে চুক্তি নবায়নের আর বিকল্প কিছু নেই। তবে এবার নৌ-পরিবহন চুক্তিটি বাণিজ্য চুক্তি থেকে আলাদা করে পৃথক চুক্তি করার বিষয়েও ভেবে দেখছে সরকার। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে স্থল বাণিজ্যে ভারত তার ভূ-খ- ব্যবহার করতে দিতে বাংলাদেশকে সম্মতি জানিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই গত ৩১ মার্চ মেয়াদ শেষ হওয়া বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন করার আগে তাতে নতুন করে বেশ কিছু ধারা-উপধারা যোগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ চুক্তি স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশ থেকে পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল ও ভুটানে যেতে পারবে। একইভাবে ভারতের পণ্যবাহী ট্রাকও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দেশটির এক অংশ থেকে অন্যঅংশে যাওয়ার সুযোগ পাবে। জানা গেছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে ভারতে রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় ইতোমধ্যে ভারতের বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটা ফ্রি বাজার সুবিধা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বিভিন্ন শুল্ক-অশুল্কজনিত কারণ, অবকাঠামো সমস্যা এবং ভিসা জটিলতা কারণে ভারতে রফতানি তেমন বাড়েনি। ফলে প্রতিবছর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে চলছে। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে দু’দেশের বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নৌ-পরিবহন চুক্তিটিকে বাণিজ্য চুক্তি থেকে পৃথক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সূত্র মতে, দ্বিপক্ষীয় এ বাণিজ্যচুক্তির আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটি জলপথে ট্রানজিটের প্রটোকল রয়েছে (বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট এ্যান্ড ট্রেড)। এ চুক্তিটিও ২০১২ সালে নবায়ন হয়, যার মেয়াদ ৩১ মার্চ শেষ হয়েছে। তবে এবার চুক্তি নবায়নকে সামনে রেখে ১০ বছর মেয়াদী নৌ-প্রটোকল চুক্তি করতে চায় ভারত। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারত তাদের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৪১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূলে নয়। এই বাণিজ্য ঘাটতি দ্রুত কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ কমেছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মূলত গত অর্থবছরে রফতানি আয় বাড়ার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় খুব অল্প পরিমাণে বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতিতে এ অবস্থান দেখা গেছে। আশা করছি, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে। বর্ডার হাটের মাধ্যমে গরু কেনাবেচা ॥ ভারতের সঙ্গে বর্তমান তিনটি বর্ডার হাট চালু রয়েছে। তবে দ্রুতই আরও চারটি হাট চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এসব হাটে একজন ক্রেতা ১০০ ডলার বা ৮ হাজার টাকার মতো পণ্য কিনতে পারেন। তবে আগামীতে আরও যাতে বেশি পরিমাণ পণ্য কেনাবেচা করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এমনকি ভারতের গরুও যাতে এসব হাটে কেনাবেচা হতে পারে সেই প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। বাণিজ্য চুক্তি নবায়নে এ বিষয়টি সংযোজন করা হতে পারে। কার্যত তিনটি বর্ডার হাট চালু থাকলেও দু’দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে হাটগুলো তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এবার হাটগুলো কার্যকর করার উদ্যোগ থাকবে।
×