ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রানার অপেক্ষায় ফোন নিয়ে বসে বাবা, বিলাপ করছেন মা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩০ মে ২০১৫

রানার অপেক্ষায় ফোন নিয়ে বসে বাবা, বিলাপ করছেন মা

ফিরোজ মান্না/ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে ॥ রানা আর ফিরবে না। আদম দালাল তাকে ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছিল। দুই বছর ধরে তার কোন খোঁজ নেই। দিনমজুর পিতা কলিম উদ্দীন দিনরাত ছেলের অপেক্ষায় ফোন নিয়ে বসে থাকেন। মা তার ছেলের জন্য বিলাপ করেন। নির্বাক এই পরিবারকে এখন দালালচক্র ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। যাতে পুলিশের কাছে গিয়ে নালিশ করতে না পারে। ভয়ে ডরে চুপসে যাওয়া রানার শোকের চেয়ে এখন তারা জীবন নিয়ে বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ছেলের হদিস না মিললেও নিজেদের টিকিয়ে রাখতে ঘরের মধ্যেই বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন তারা। বাইরে গেলে যদি ছেলের কথা বলাবলি করেনÑ তাহলে পুলিশ জেনে যাবে। তখন দালালচক্রের অসুবিধা হবে। এমন এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন টাঙ্গাইল সদর থানার গন্ধবপুর গ্রামের কলিম উদ্দীনের পরিবার। শুধু কলিম উদ্দীনই এই অবস্থায় দিন যাপন করছেন তা নয়Ñ গোটা এলাকার এক থেকে দেড় হাজার যুবকের পরিবারের ছেলে না পাওয়ার বেদনায় মাতম চলছে। যমুনার ভাঙ্গনে নিঃস্ব হত দরিদ্র মানুষ প্রতিকার চাইতে পুলিশের কাছ পর্যন্ত যেতে পারছেন না। পুলিশও তাদের জন্য এখন পর্যন্ত এগিয়ে যাচ্ছে না। সম্প্রতি টাঙ্গাইল সদর থানার পশ্চিমাঞ্চল ঘুরে জানা গেছে, কাকুয়া, হুগড়া ও কাতুলি ইউনিয়নের দেড় হাজারের বেশি মানুষ দালালদের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছেন। কেউ ছয় মাস আগে আবার কেউ দুই বছর থেকে আড়াই বছর আগে। এদের কারও কোন হদিস নেই। তারা কোথায় কিভাবে আছেন, তা দালাল চক্রও বলতে পারে না। আবার তারা পরিবারের কারও কাছে ফোনও করেন না। নিখোঁজ এই মানুষগুলো কি বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন কেউ তা নিশ্চিত করে বলতেও পারছেন না। দালাল মাইন উদ্দীন, আজাদুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলমের হাত ধরে অনেকে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। এই দালালরা তুলে দেন কাতুলি ইউনিয়নের লাল চান দালালের হাতে। লাল চান দালাল হচ্ছে চর এলাকার মাফিয়া। মানব পাচার করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। এই লাল চান দালালের ওপরে রয়েছে আরেকজন বড় দালাল। মানব পাচার দালাল চক্রের নেটওয়ার্ক যমুনার চর গ্রাম থেকে শুরু করে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ প্রশাসনের সব পর্যায়ে তাদের যোগাযোগ। যেসব পরিবোরের যুবককে ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে সাগরপথে পাচার করেছে তাদের কাছ থেকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা করে নিয়েছে। এখন এই দালালচক্রের কাছে তারা টাকা চাইতে গেলে ছেলের যে পরিণতি ঘটেছে তাদেরও সেই পরিণতি ঘটবে বলে হুমকি দিচ্ছে। তাছাড়া এ নিয়ে যদি কেউ পুলিশের কাছে যায় তাহলে তাদের পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে। মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত এমন কয়েক জন দালালের সঙ্গে কথা হলে তারা জোর গলায় বলেছে, যারা মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছে, আমরা তাদেরই পাঠিয়েছি। কাউকে জোর করে পাঠানো হয়নি। আরও অনেকেই আমাদের কাছে টাকা দিয়ে রেখেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি কেটে যাওয়ার পর তাদের পাঠানো হবে। আমরা ব্যবসা করি। আমাদের কেউ কিছু বলতে পারবে না। আদমপাচারকারীদের এমন বড় গলা একমাত্র টাঙ্গাইলের এ চরাঞ্চলেই শোনা যাচ্ছে। অন্য সব এলাকা থেকে পাচারকারীরা গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু এ এলাকায় বীরদর্পে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিষয়টি টাঙ্গাইল পুলিশ প্রধান সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কেউ এসে যদি অভিযোগ করেন তাহলে সব দালালকে গ্রেফতার করা হবে। মানব পাচারকারী যেই হোক তাকে কোনভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। কোন শক্তির কাছে পুলিশ মাথা নত করবে না। এমন একটি জঘণ্য কাজের সঙ্গে যুক্তদের আইনের আওতায় আনার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদি কেউ অভিযোগ করতে সাহস নাও পান তাহলেও গোপনে পুলিশ পাচারকারী দালালদের খুঁজে বের করবে। মানব পাচারের বিষয়টি মানবতার চরম লঙ্ঘন বলে তিনি উল্লেখ করেন। পুলিশ সুপার বলেন, চরাঞ্চল থেকে লোভ দেখিয়ে দরিদ্র মানুষকে পাচার করার বিষয়টি তিনি শুনেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোন অভিযোগ তার কাছে আসেনি। আদম পাচারের সঙ্গে ক্ষমাতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এসেছে। যারা সমাজের বিবেক হিসেবে নিজেদের পরিচয়ের পরিধি বাড়িয়েই চলেছেন। অর্থবিত্ত তাদের শক্তির মূলনিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলের মানুষ বার বার জিম্মি হচ্ছেন। পাচারের শিকার টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষের ভাগ্যে কি ঘটেছে তার কোন খবর কেউ জানেন না। এই মানুষগুলোকে উদ্ধার অথবা হদিস জানার জন্য দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। বিষয়টি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন চরাঞ্চলের অসহায় মানুষ। ভাল চাকরি, ভাল বেতন, জীবনের স্বপ্ন-সাধ পূরণের অনন্ত বাসনা কার না আছে। এই চাওয়াকে পূরন করতে জীবন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে অনিশ্চিত যাত্রা। কপালে ভাল চাকরি আর ভাল বেতন মিলবে কিনা তার হিসাব মিলানোর আগেই অনেকে ডুবে গেছে সাগরের গভীর অতলে আর কেউ কেউ মরছে থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে। আবার অনেকে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নির্যাতন করে কৌশলে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে পাচারকারীরা। পাচারকারীদের প্রলোভনে সেই স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার রুটটি সাগর পাড়ি দিয়ে থ্যাইল্যান্ডের গভীর বনভূমি। এখান থেকে সীমানা পার হয়ে মালয়েশিয়া। তবে বেশির ভাগের ভাগ্যেই মালয়েশিয়া পৌঁছানো হয় না। যারা পৌঁছুতে পারেন তাদেরও থাকে আটকের ভয়। এক পর্যায়ে তারা আটক হয়ে মালয়েশিয়ার কারাগারে স্থান পান। এমন এক ভয়ঙ্কর পথ পার হয়ে ভাল চাকরি, ভাল বেতন আর তাদের কপালে জোটে না। এই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে রয়েছে কক্সবাজার টেকনাফের প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের যোগসূত্র। পাচার বাণিজ্যের একটি অংশ তাদের হাতেও যাচ্ছে।
×