ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটালাইজেশনে বিচার বিভাগ পিছিয়ে ॥ সিনহা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩১ মে ২০১৫

ডিজিটালাইজেশনে বিচার বিভাগ পিছিয়ে ॥ সিনহা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, আমরা বিচারকরা ট্রেড ইউনিয়নের মতো দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হব না। আমরা বিচারক। বিচারকের মতো কাজ করব। আমি যা বলি সেটা হলো বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ। আমরা চাই তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশনে পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের অন্যান্য বিভাগ ডিজিটালের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু বিচার বিভাগ পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের ল্যাপটপ দেয়া হলেও বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা এখনও তা পাননি। বিচার বিভাগকে আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত করা হলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। শনিবার দুপুরে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ মহিলা জজ এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতিকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেছেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দুইজন দার্শনিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, যা বলার তা প্রজ্বলভাবে বলা যায়, যা বলা যায় না তা নিয়ে নীরব থাকা শ্রেয়। অপর একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ওয়ারেন্ট হেস্টিংয়ের ইমপিচমেন্ট হয় তখন তিনি আর নীরব থাকতে পারেননি। তাই বিচার বিভাগের প্রয়োজেন আমারও কিছু বলতে হয়। আমি যদি মুখ বন্ধ করে চলে যাই আর এতগুলো (বিচারক) তারকা অভিযোগ করে। তাদের বুক এবং আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে কেউ কথা বলতে পারছে না। বিচারকরা ট্রেড ইউনিয়নের মতো দাবি দাওয়া নিয়ে হাজির হব না। একই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, প্রধান বিচারপতিকে আশ্বস্ত করতে চাই, বিচার বিভাগের সংস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা যা প্রয়োজন তা করা হবে। আমার মন্ত্রণালয় সর্বদা বিচার বিভাগকে সহযোগিতা করে যাবে। আমার মন্ত্রণালয় থেকে ডে কেয়ার করার জন্য যা যা লাগে তা করা হবে। আইনমন্ত্রী বলেন, জ্যেষ্টতা আর অভিজ্ঞতায় মানদ-ে প্রধান বিচারপতির পদে আসনে এসেছেন। পেশাদারিত্বের মান বজায় রাখতে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু উদ্যোগের কথা জানি। দেশের আদালতসমূহে পাহাড় সম মামলা জট রয়েছে। আমার মন্ত্রণালয় থেকে বিচারকদের ট্রেনিংয়ের জন্য প্রধান বিচারপতি যা বলবেন তা করা হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, আমার জীবনে হয়ত এ আনন্দ পাইনি। সারাদেশের স্টাররা এখানে এসেছেন। বিব্রত বোধ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশনে পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের অন্যান্য বিভাগ ডিজিটালের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু বিচার বিভাগ পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের ল্যাপটপ দেয়া হলেও বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা এখনও তা পাননি। আগামী ৩ মাসের মধ্যে সকল বিচারককে ল্যাপটপ দেয়া হবে। বিচার বিভাগকে আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত করা হলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।’ বিচার বিভাগকে ডিজিটাল করার জন্য তিনি আইনমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশে ৩৪৩ জন মহিলা বিচারক রয়েছেন জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন সুইডেন, ডেনমার্ক ছাড়া পৃথিবীর কোথাও এত মহিলা বিচারক নেই। মহিলা বিচারকদের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, সুপ্রীমকোর্টে ডে কেয়ার সেন্টার চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। শুধু বিচারক নয় মহিলা স্টাফদের জন্য এ সুবিধা থাকবে। মন্ত্রী বলেছেন সারাদেশে ডে কেয়ার সেন্টার করবেন, এ বিষয়ে বললেও প্র্যাকটিক্যালি এটা সম্ভব না। মহিলা বিচারক সম্পর্কে তিনি বলেন, ভারত ফাইট করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে যায়। আমরা পারি না কেন? তিনি বলেন, আমাদের দেশে ১৯ ভাগ মহিলা জজ রয়েছেন। যেখানে ইংল্যান্ডে মাত্র ১০ ভাগ। বাংলাদেশ মহিলা জজ এ্যাসোসিয়েশনের সভানেত্রী বিচারক নুুরুর নাহার ওসমানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আপীল বিভাগের বিচারপতি নাজমুল আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, জামালপুরের জেলা ও দায়রা জজ জেসমিন আনোয়ার, হবিগঞ্জের আফরোজা পারভীন, মৌলভীবাজারের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মমতাজ বেগম, ঢাকার যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ নুরুল নাহার শিউলী, ময়মনসিংহের বিচারক মোহেনা সিদ্দিকী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সহকারী জজ মল্লিকা বসাক। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আপীল বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক, হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাসেফা হোসেন, আইন সচিব আবু সালেহ মোহাম্মদ জহিরুল হক ও সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার (জেলা জজ) সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ও প্রধান বিচারপতির স্ত্রী শ্রীমতি সুষমা সিনহাসহ সারাদেশ থেকে ১৪০ জন মহিলা জজ। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আরও বলেন, আমি ইচ্ছা করে কাউকে আঘাত দিতে চাইনি। আমি যা বলি তা হলো, বিচার বিভাগ একটা রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ। আমরা চাই তাদের (নির্বাহী বিভাগ) সঙ্গে সহযোগিতা করে চলতে। আমাকে কিছু বলতে হবে, যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে যায় সহ্যের সীমা চলে যায়, একজনকে তো বলতেই হবে। আমি যদি মুখ বন্ধ করে থেকে যাই তাহলে...। আজকে এতজন তারকা (মহিলা জজ) আমার সামনে সংক্ষিপ্ত আকারে যে অভিযোগ করলেন, এ ধরনের অনেক বিচারক মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছেন, তাদের বুক ফেটে যাচ্ছে, আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু কথা বলতে পারছেন না। আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আপনি তো আমাদের পরিবারের সদস্য। আপনি জানেন যে আমাদের কাজ করতে হয় বেশকিছু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। আমরা যদি বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, মান-মর্যাদা রক্ষার্থে কিছু ন্যায্য দাবি রয়েছে বিচারকদের। এ ব্যাপারে যদি কিছু বলে থাকি আমি, কোন ব্যক্তি কারও কিছু আঘাত করার জন্য আজ পর্যন্ত কিছু বলি নাই। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য বলি। সরকারের আর দুটো অঙ্গ আমরা, কোনভাবে অস্বীকার করছি না। এই দুই প্রতিষ্ঠান যাই করুক না কেন, বিচার বিভাগের সহযোগিতা ছাড়া প্রশাসনিক বা নির্বাহী বিভাগের কোন কাজ কার্যকর করা যাবে না। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, অপরাধ করলে পুলিশ প্রশাসন অপরাধের ইনভেস্টিগেশন করে। তার বিচার করা বিচার বিভাগের কাজ। চাইলে অপরাধী আজীবন জেলে রাখা যায় না। বিচার বিভাগ রায় দিলে সেটা কার্যকর করে নির্বাহী বিভাগ। একটার সঙ্গে একটা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আমি এটাই বিভিন্ন বক্তব্যে তুলে ধরেছি। আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, উপর পর্যায়ে পদ খালি হলে তা নিচ থেকে পূরণ করবেন। যেমন এ বছরের শেষের দিকে ১০ জেলা জজ অবসরে যাবেন। এটার কোন ডাটাভিত্তিক হিসাব নেই। কিন্তু জনপ্রশাসনে সব অফিসারের ডাটা আছে। যেটা বিচার বিভাগে নেই। আপনার মন্ত্রণালয়ে নেই। অন্যসব মন্ত্রণালয়ে আছে। সুপ্রীমকোর্টে আপডেট করছি। তবে আপনাদের প্রস্তাব ছাড়া এটা কার্যকর হবে না। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, যাকে চান দিয়ে দিব। তবে আপ টু ডেট থাকতে হবে। তাহলে মামলাগুলো তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে। এডিশনাল জজের যত পদ খালি আছে সেগুলো পূরণ করতে হবে। খালি রাখা যাবে না। জেলা জজেও একইরকম করতে হবে। সরকারের প্রতিটি সেক্টরে ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম আছে। পুলিশের সাব ইন্সপেক্টরদেরও ট্যাবলেটগুলো দেয়া হয়েছে। আমাদের বিচারকরা কেউ পাচ্ছেন না। বিচারকদের হাতে লিখতে হচ্ছে। আমি বললাম বিচার প্রশাসন তো সরকারের আলাদা কিছু না। এটাকে বাদ দিয়ে তো অন্যকিছু হবে না। তখন আমাদের ১২৫টা ল্যাপটপ দিল। এগুলো মাঠ পর্যায়ের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের বিতরণ করা হয়েছে। শুক্রবার (গতকাল) আইনমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন, ফিল্ড লেভেলের প্রত্যেক বিচারককে তিন মাসের মধ্যে ল্যাপটপ দেয়া হবে। মহিলা বিচারকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, হাতে আর নয়। এখন ল্যাপটপে পারবেন। ভয়েস রেকর্ডের মাধ্যমে অটোমেটিকভাবে সাক্ষ্য নেয়া হবে। এমন যন্ত্র দেয়া হবে। আইনমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, বিচার বিভাগের ডিজিলাইজেশনের জন্য যে উদ্যোগ নিচ্ছি তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী যে দিন সময় দেবেন, সেদিন সব বিচারক সমবেত হব। অনুষ্ঠানে আপীল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, বিচার বিভাগে লোকবল ও অবকাঠামোগত সমস্যায় জর্জরিত। যে সমস্ত মহিলা জজ আছেন তারা যেন তাদের স্বামীর সঙ্গে একই জেলায় থাকতে পারেন এ বিষয়টি দেখা উচিত।
×