ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা গুদাম মালিকের হাতে জিম্মি

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২ জুন ২০১৫

চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা গুদাম মালিকের হাতে জিম্মি

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে গুদাম মালিকদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন এখানে বখশিসের নামে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছেন গুদাম মালিকরা। অধিকাংশ আমদানিকারকদের নিজস্ব গুদাম না থাকায় গুদাম মালিকরা পণ্য খালাসের সময় বখশিসের নামে চাঁদা আদায় ও দ্বিগুণ ভাড়ায় তাদের নিজস্ব পরিবহন ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করছে। এছাড়া বস্তা থেকে পণ্য সরিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, গুদাম থেকে পণ্য ট্রাকে বোঝাই করতে বস্তাপ্রতি (ধোলাই খরচ) ৫ টাকা দিতে হয় মাঝিদের। এরপর আবার প্রতি ট্রাকে ২২শ’ টাকা বাড়তি বকশিস গুণতে হয়। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, মাঝিরঘাট এলাকায় ‘মাঝির ঘাট ট্রাক পরিবহন মালিক সমিতি’, ‘পোর্ট কলোনি ট্রাক মালিক সমিতি’ ও নীমতলা ট্রাক মালিক সমিতি নামে ৩টি পণ্য পরিবহন মালিক সমিতি রয়েছে। এই সমিতির বাইরে গিয়ে নিজেদের ভাড়া করা ট্রাকে পণ্য পরিবহনে বাধা দেন সমিতির লোকজন। তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়ায় সমিতির ট্রাক ভাড়া করে পণ্য পরিবহনে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। এ সম্পর্কে খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মেসার্স ইসমাইল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন বলেন, ‘নিজেদের ভাড়া করা গাড়িতে মাঝিরঘাট থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ পর্যন্ত একটি ট্রাকের (১২ টন) ভাড়া লাগে ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা। কিন্তু একই দূরত্বে (চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ) মাঝির ঘাটের সমিতির গাড়ি ভাড়া নিতে খরচ গুণতে হয় ৩ হাজার ৭০০ টাকা। একইভাবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের অন্য জেলাগুলোতে ট্রাকপ্রতি (১৮ টন) ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ পড়ে নিজেদের ভাড়া করা গাড়িতে। কিন্তু একই এলাকায় মাঝির ঘাটের ট্রাক সমিতির গাড়িতে খরচ গুণতে হয় ১৮ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ভাড়া বেশি হলেও তাদের গাড়িতে করে মাল আনতে অন্য গাড়িগুলোকে তারা ঢুকতে দেয় না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে আমদানি করা সিংহভাগ ভোগ্যপণ্য নগরীর মাঝিরঘাট, পোর্ট কলোনি, পাহাড়তলী ও নীমতলা এলাকার প্রায় তিন হাজার গুদামে মজুদ করেন আমদানিকারকরা। আমদানিকারকদের নিজস্ব গুদাম না থাকায় তারা এসব গুদামে পণ্য মজুদ করেন। ফলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমদানিকারকদের নিকট থেকে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) কিনলেও পণ্য সরবরাহ নিতে হয় এসব গুদাম থেকে। গুদাম থেকে পণ্য খালাস করতে গেলেই ট্রাক প্রতি বকসিশ গুণতে হয় ব্যবসায়ীদের। মাঝিরঘাট থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের প্রতিট্রাকে (১২টন) ৫০০ টাকা। আর চট্টগ্রামের বাইরে অন্য জেলাগুলোতে পণ্য নিলে দিতে হয় ২ হাজার ২০০ টাকা। তাছাড়া প্রতিট্রাক (১৮-২০ টন) ভোগ্যপণ্য থেকে গুদাম মালিক (মাঝি) কমপক্ষে ৩০০Ñ৫০০ কেজি (প্রায় সাড়ে ৬ মণ) পণ্য রেখে দেয়। জানা গেছে, মাঝিরঘাট, পোর্ট কলোনি ও নীমতলা এলাকা থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১ হাজার ট্রাক পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। বকশিসের নামে ট্রাকপ্রতি ২২শ টাকা হিসেবে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করছে মাঝিরা। সেই হিসেবে প্রতিদিন মাঝিরা ২২ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে। আর চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে যাওয়া (স্থানীয়) প্রতিট্রাকে ৫০০ টাকা করে কমপক্ষে ১০০টি ট্রাক থেকে বখশিস আদায় করা হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ২২ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করছে এসব মোকামের ১৫ থেকে ১৮ জন মাঝি (কমিশন এজেন্ট)। অপরদিকে, পণ্য খালাসকারীদের জন্যে বস্তা প্রতি ৫ টাকা আদায় করলেও পুরো টাকা তারা পায় না। তাদের দেয়া হয় মাত্র এক টাকা। বাকি চার টাকা মেরে দেন মাঝিরা। এছাড়া পণ্য পরিবহনকারী শ্রমিকদের নামে ২২শ’ টাকা করে যে বখশিস আদায় করা হয় তাও শ্রমিকদের দেয়া হয় না। এই বখশিসের সিংহ ভাগই রেখে দেয় গুদাম মালিকরা। খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন বলেন, এই বাড়তি টাকা কোন বখসিশ নয়। এটি এক ধরনের চাঁদাবাজি। ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে তাঁরা এই বাড়তি টাকা আদায় করে। ট্রাকপ্রতি গুদাম মালিকরা ৫শ’ কেজির মতো পণ্য সরিয়ে রাখে বলে জানান তিনি। ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী ও ডাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি আহমদ রশীদ আমু বলেন, ‘আগে মাঝির ঘাটের গুদাম থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পৌঁছতে প্রতিকেজি পণ্য খরচ হতো ৪০ পয়সা। মাত্র দু-তিন কিলোমিটার দূরত্বে এখন প্রতিকেজি পণ্য বাজারে পৌঁছতে খরচ হচ্ছে ১ টাকা। অভিযোগ অস্বীকার করে মাঝির ঘাট এলাকার গুদাম মালিক (কমিশন এজেন্ট) অলি মাঝি বলেন, বাড়তি এই টাকা নেয় শ্রমিক নেতারা। মাঝিদের সঙ্গে এই টাকার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আর বখশিস শ্রমিকদের দিয়ে দেয়া হয়।
×