ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ রায়

সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৪ জুন ২০১৫

সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি খুব দ্রুতই ভুটান ও নেপাল সফর করেন। বাংলাদেশে পাঠান তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ওই সফরে বলেন, সার্ক দেশগুলোর ভেতর তাঁরা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেন। তারপরেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার এক বছর পরে মি. মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। মি. মোদির এই বিলম্বিত সফর সম্পর্কে বিজেপির একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি দিল্লীর এক ঘরোয়া আলোচনায় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তাঁর মত ছিল, আর যাই হোক মোদিজী বাঘ রক্ষার চুক্তি করতে বাংলাদেশে যাবেন না। তিনি এমন কিছু করতে বাংলাদেশে যাবেন যা ঐতিহাসিক হিসেবে চিহ্নিত হয়। ঢাকায় হাসিনা-মনমোহন বৈঠক বা মনমোহনের সফরে ওইভাবে বড় কোন ফল পাওয়া যায়নি। কিছু প্রটোকল আর সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার চুক্তিসহ কয়েকটি কম গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়। এ কারণে অনেকেই ওই সফরকে বাঘ রক্ষার চুক্তির সফর হিসেবে ঠাট্টা করেন। কিন্তু বাস্তবে মনমোহনের ওই সফর নিয়ে ঠাট্টা করার কিছু নেই। কারণ, ভারতের সংবিধানে বাধ্যবাধকতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অস্থিরমতি কিছুটা সংকীর্ণ কূট কৌশলী মমতা ব্যানার্জীর কারণে সেদিন ল্যান্ড বাউন্ডারি প্রটোকল হলেও তিস্তার কোন অগ্রগতি হয়নি। তবে ল্যান্ড বাউন্ডারি আর ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয়নি। কেন সে সময়ে ভারতের পার্লামেন্টে তা পাস হলো না এ নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে সব থেকে ভালো যে মন্দ অতীত পেরিয়ে ভালো বর্তমানে পৌঁছানো গেছে- সেই ভালো বর্তমানকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ভারতের পার্লামেন্টে ল্যান্ড বাউন্ডারি পাস হয়েছে একটি সুন্দর পরিবেশে। ভারতের সব দল একাত্ম হয়েই অংশ নেয় এ বিল পাসে। বিশেষ করে রাজ্যসভায় বিলটি পাস হওয়ার ক্ষেত্রে সে দেশের বিরোধী দলগুলো যে ভূমিকা নিয়েছে তাকে প্রশংসা করতে হয়। প্রশংসা করতে হয় সোনিয়া গান্ধীকে। অন্যদিকে শুরুতে ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপির ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি যা বলেছিলেন, মোদি তা বজায় রাখলেন। তিনি দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান করে দুই দেশের জন্যে ইতিহাস সৃষ্টি করেই বাংলাদেশে আসছেন। এ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সফল। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সব থেকে বড় সফলতা হলো, দীর্ঘ চড়াই-উৎরাইয়ের পরে ২০০৯ থেকে বাংলাদেশ-ভারতের ভেতর সম্পর্কের যে নতুন অধ্যায় শুরু হয়, তিনি তা আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন। তার এ সফরে দুই দেশসহ আন্তঃআঞ্চলিক কানেকটিভিটির যে চুক্তিগুলো হবে বা দুই দেশ ও তাদের অন্য প্রতিবেশীদের নিয়ে এ কানেকটিভিটি কতটা এগিয়ে যাবে তাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই কানেকটিভিটি কোন বাধা না পেলে আগামী পঞ্চাশ বছর পর এই যোগাযোগ ও তার ওপর ভিত্তি করে যে অর্থনীতি গড়ে উঠবে তারও একটি ছবি এখন আঁকা সম্ভব। তবে এবার এখনও অবধি মোদির সফরে যে বড় ধাক্কাটি থেকে যাচ্ছে তা তিস্তা পানি চুক্তি। মমতা ব্যানার্জী তার সারদা চিট ফান্ড কেস থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে মোদির সঙ্গে দর কষাকষির মাধ্যম হিসেবে এই তিস্তা চুক্তিকে আরও কিছুদিন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। বিষয়টি এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেলার একটি অস্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে যে পৌরসভা নির্বাচন হয়ে গেল সেখানে যদি বিজেপি, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস ভালো করতে পারত তাহলে মমতার এই তিস্তা অস্ত্রের ধার কমে যেত, সারদা চিট ফান্ডের ধার বাড়ত। যাই হোক, সারদা চিট ফান্ড ও জঙ্গী অর্থ সরবরাহের বিষয়টি এখন সে দেশে বিচারাধীন এবং অনেক ক্ষেত্রে তদন্তে প্রমাণিত। এ কারণে শেষ অবধি এ যুদ্ধে মোদি জিতবেন। মমতা হারবেন। মাঝখান দিয়ে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি একটু প্রলম্বিত হতে পারে। তারপরেও হাসিনা-মোদির বৈঠকের ভেতর দিয়ে হয়ত শেষ মুহূর্তে অন্য একটা আলোর রেখা বের হতেও পারে। একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে ল্যান্ড বাউন্ডারির মতো মানবিক ও দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যা সমাধানের পরে বাংলাদেশ ও ভারত জোর দিচ্ছে বেশি কানেকটিভিটির ওপর। অঙ্কটা সরলভাবে করলে এ মুহূর্তে কানেকটিভিটিই সামনে আসে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরীণ ও কিছু বহির্শক্তির চক্রান্ত সব মিলে বিবেচনায় আনলে তার আগে কি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়টি আসে না? বাস্তবে হিসেব করলে বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশ কিন্তু এখন ভয়ঙ্কর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে দুই দেশের কিছু বৈধ রাজনৈতিক শক্তির অনৈতিক রাজনীতিও। যেমন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোও বাংলাদেশের মধ্যে এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি এবং যে সন্ত্রাসীদের অবাধ চলাচল ছিল তা নব্বই ভাগের বেশি কমে গেছে। তারপরেও অসম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এখনও কিছু রেশ রয়ে গেছে। অবশ্য এখানে দ্বিপাক্ষিক বৈধ রাজনীতির ছত্রছায়াটি কম। বরং এটা এখন বেড়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কিছু সীমান্ত এলাকাজুড়ে। বাংলাদেশে যেমন এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি এই জঙ্গীরা দেশের বৈধ রাজনৈতিক দল বিএনপির আঁচলে থাকার সুযোগ পাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গেও তারা তথাকথিত ভোট ব্যাংকের সহযোগিতায় তৃণমূলের আশ্রয়ে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারতের এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নষ্টের জন্য পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের একটি অবৈধ অর্থ কাজ করছে। যে অর্থের উৎস কোনমতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ভারতের নানান প্রদেশেও রয়েছে এই জঙ্গীদের অর্থের উৎস, অর্থের উৎস রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যতে। আবার পশ্চিমা বিশ্বের নানামুখী রাজনীতি ও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েনে পড়েও বাড়ছে বাংলাদেশ ও ভারতে জঙ্গীদের শক্তি। এক শ্রেণীর শিক্ষিত তরুণ-তরুণী নিজেকে পরিণত করছে জঙ্গীতে, তারাও হয়ে যাচ্ছে মূল জঙ্গী শক্তির অংশ। ২০১৩ সাল জুড়ে এবং ২০১৫ সালে তিন মাসের বেশি বাংলাদেশকে পোহাতে হয়েছে সরাসরি জঙ্গী আক্রমণ। যা ছিল জঙ্গীদের তরফ থেকে ছোট আকারের আরবান গেরিলা যুদ্ধ। শেখ হাসিনা সাহসী নেত্রী বলেই এ দুটো যুদ্ধ খুব দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঠিক একই ধরনের গেরিলা যুদ্ধ ইরাক, সিরিয়া, নাইজেরিয়ায় আইএস ও বোকোহারাম করছে। সেগুলোকে গোটা বিশ্ব জঙ্গীদের গেরিলা যুদ্ধ হিসেবে নিয়ে সেভাবে মোকাবেলা করছে। আর বাংলাদেশের প্রায় একই মানের জঙ্গীদের আরবান গেরিলা যুদ্ধ এখনও বিরোধী দলের রাজনৈতিক আন্দোলন বা কোন কোন ক্ষেত্রে সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি এই জঙ্গী ও তাদের আরবান গেরিলা যুদ্ধকে বড়জোর সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এ কারণে যে, এই জঙ্গী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছে একটি বৈধ রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এখানে আরও বড় সুবিধা পাচ্ছে এই ইসলামিক জঙ্গীরা পশ্চিমাদের কাছ থেকে। সারা পৃথিবীতে এদেরকে পশ্চিমারা ইসলামিক জঙ্গী বললেও বাংলাদেশে তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মী বলছে। পশ্চিমাদের এ ধরনের দ্বিচারিতা চিরকালের। কেন তারা এই চরিত্রে এখানে আবির্ভূত তাও পরিষ্কার। বিস্তারিত লিখতে গেলে লেখার পরিসর অনেক বড় হয়ে যাবে, তাছাড়া লেখা মূল বিষয়বস্তু থেকে দূরে চলে যাবে। এক লাইনে বলতে হয়, ভারত-বাংলাদেশ মিলে সার্কের ছোট দেশগুলো নিয়ে একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠুক এটা ঠেকাতেই তাদের এই ভূমিকা এখানে। পশ্চিমাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কূটনীতির কারণে বাংলাদেশ যতটা জঙ্গীদের পক্ষে কঠোর হওয়া উচিত ততটা হতে পারছে না। অন্যদিকে এই জঙ্গীরা ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল হারিয়ে এখন আশ্রয় পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। বর্ধমানের ঘটনার ভেতরই শুধু তা সীমাবদ্ধ নেই। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে তারা আশ্রয়ের সুযোগ পাচ্ছে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে বৈধ ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তৃণমূলের নেতাদের আশ্রয়েই অনেকে। এমন কি এখন তারা ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের মূল ভূ-খ-ের অন্যান্য প্রদেশেও। যতক্ষণ এ দুই দেশের বৈধ কিছু রাজনৈতিক দল এভাবে জঙ্গীদের সমর্থন বা আশ্রয় দেবে ততক্ষণ শতভাগ জঙ্গী নির্মূল সম্ভব নয়। আর এ জঙ্গী নির্মূল ছাড়া কোনমতেই দুই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যখন বাংলাদেশ সফরে আসছেন সে সময়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জঙ্গীদের হিট লিস্টে। আর জঙ্গীদের হিট লিস্টে একবার কেউ উঠে গেলে তার পরিণতি কী হয় তাও গত কয়েক মাসে অনেক ঘটনা প্রমাণ করে। তাই আসন্ন মোদির সফরে দুই দেশের সামনে এখন সব থেকে বড় বিষয় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। বৈধ রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা ও অবৈধভাবে লুকিয়ে থাকা সকল জঙ্গী দুই দেশ মিলে যাতে নির্মূল করতে পারে সে বিষয়টিকেই দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। জঙ্গীদের দখলে এখন শুধু রাজনৈতিক দল নয়, তাদের দখলে মিডিয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, এমনকি এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীও। তাই দুই দেশ ও আঞ্চলিক সমন্বিত পরিকল্পনা এবং সে পথে এগোনো ছাড়া এই জঙ্গী নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্য আন্তর্জাতিক জনমতও গঠন প্রয়োজন। আর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ছাড়া কানেকটিভিটি কখনই বাস্তবে রূপ নেবে না। কারণ যখন পথে পণ্য বা মানুষ থাকবে জঙ্গীর নিশানা তখন ওই পথ এমনিতেই পরিত্যক্ত হবে। জঙ্গীরা সে কাজই করছে। তাই ৬ ও ৭ এর মোদির সফরে, হাসিনা ও মোদির কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাক দুই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। এ নিরাপত্তার স্বার্থে জঙ্গীকে জঙ্গী হিসেবেই নিতে হবে। তাদের সঙ্গে সাক্ষাত দিয়ে তাদের রাজনৈতিক বৈধতা দেবার কোন যুক্তি নেই। [email protected]
×