ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বার্লিন দেয়াল ভাঙ্গা ছিটমহল

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৮ জুন ২০১৫

বার্লিন দেয়াল ভাঙ্গা ছিটমহল

বাংলাদেশ ও ভারতে দীর্ঘ প্রায় সাত দশক ধরে বিদ্যমান ছিটমহলবাসীর কাছে স্থলসীমান্ত চুক্তি কার্যকর হওয়ার মধ্যে যেন ‘বার্লিন ওয়াল’ ভাঙ্গার স্বাদ নিয়ে এসেছে। মুছে গেছে ‘ছিটমহল’ শব্দটি মানচিত্র থেকেও। স্বাধীনতা কাকে বলে তারা জানছে এখন। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অপদখলীয় ভূমি পুনরুদ্ধারের ফলে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান মানচিত্র। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সীমান্ত অঞ্চল ও ছিটমহল নিয়ে সম্পাদিত চুক্তি অকার্যকর থাকায় অমীমাংসিত বিষয়গুলো ঝুলে ছিল। অবশেষে সব জট খুলে গেছে। ১২৬টি ছিটমহলের অর্ধ লাখের বেশি মানুষ (গণনা চলছে নতুন করে) ফিরে পেল নিজ দেশ, পেল মাতৃভূমি, নাগরিকত্ব এবং সর্বোপরি মুক্ত মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার। ছিটমহলবাসী উদার আকাশ আর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বন্দী জীবনের ঘেরাটোপে গ্লানিময় মানবেতর অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে পেয়েছে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার। নিজ বাসভূমে পরবাসী জীবন তাদের ছিল ‘না-মানুষের’। তাদের জীবনে এখন জীবন যোগ হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণটি ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল ভাঙ্গার চেয়ে কম নয়। দেয়াল ভেঙ্গে নিজ দেশে একীভূত হলো তারা। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উভয় দেশের অনেক এলাকা অপদখলীয় সেই ১৯৪৭ হতেই। ছিটমহলের মতো অপদখলীয় এলাকার মানুষজনের জীবনজুড়েও ছিল অমোঘ এক নিষ্ঠুর নিয়তি। মর্যাদার লড়াই, অমীমাংসিত সীমানা দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখাÑ এসব কারণে সেখানকার মানুষকে প্রায়ই মাসুল দিতে হতো। বিএসএফ এবং বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) অতর্কিতে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে অপদখলীয় এলাকা উদ্ধারে গোলাগুলি চালিয়েছে। মেশিনগান-কামানের অবিরাম গুলিবর্ষণ, থেমে থেমে মর্টারের গোলা মাঝেমধ্যেই তছনছ করে দিত এখানকার জনপদ। হতাহতের ঘটনাও কম নয়। শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষদিকে ২০০১ সালের ১৭ এপ্রিল ভারতের অপদখলে থাকা পাদুয়া দখল করে নেয় বাংলাদেশ রাইফেলস তথা বিডিআর। এর জবাবে ভারত বাংলাদেশের অপদখলে থাকা রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ি দখলের প্রচেষ্টা চালায়। অতর্কিতে বিডিআর ক্যাম্পে আক্রমণ করলে প্রচ- গোলাগুলিতে মারা যায় ১৬ জন বিএসএফ সদস্য। বিডিআরের দু’জন জওয়ানও মারা যান। একপর্যায়ে বিএসএফ পিছু হটলে গোটা ছিট বড়াইবাড়ি গ্রাম ভস্মীভূত হয় আগুনে। এই রকম অপদখলীয় এলাকার মানুষ এসব কারণে ২০০৮ পর্যন্ত নির্ঘুম রাত কাটাত আক্রমণের ভয়ে। এখন এই দুটি এলাকা বিনিময় হয়ে গেছে। পাদুয়া বাংলাদেশ এবং বড়াইবাড়ি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলো। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অনুচ্ছেদ ২ অনুযায়ী উভয় দেশের অপদখলীয় এলাকা সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে ছেড়ে দেয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্মতি স্পষ্টভাষায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া এমনকি সময়সীমাও নির্ধারণ করে বলা হয়েছে যে, ‘স্ট্রিট ম্যাপ পেনিপোটেনশিয়ার’ কর্তৃক স্বাক্ষরিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে অপদখলীয় এলাকা হস্তান্তর করা হবে। পরে ১৯৭৫ সালের ২৬-২৯ ডিসেম্বর ভারতের প্রস্তাবে ও বাংলাদেশের সম্মতিতে ওই অনুচ্ছেদ সংশোধিত হয়। সে অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের চুক্তি দু’দেশের রেটিফাইয়ের পর স্ট্রিট ম্যাপ পেনিপোটেনশিয়ার কর্তৃক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। তবে বাংলাদেশ এ চুক্তি রেটিফাই করে ১৯৭৪ সালেই। আর ভারত করল গত মে মাসে। ভূমি নথিভুক্ত ও জরিপ অধিদফতরের ১৯৯৭ সালের আগের তথ্যানুযায়ী ২৬৮৫ দশমিক ৬২ একর ভারতীয় জমি বাংলাদেশের অপদখলে এবং ৩২১৮ দশমিক ২০ একর বাংলাদেশের জমি ভারতের অপদখলে রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হিসাবে গরমিল পাওয়া যায়। নদী ভাঙ্গনের ফলেও হিসাবে তারতম্য হয়। অপদখলীয় জমি হচ্ছে সেসব জমি যা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, কিন্তু দেশভাগের পর তা পড়ে গেছে অন্য দেশে। এক দেশের বাসিন্দা, জমি পড়েছে আরেক দেশে। চাষাবাদ আর হয়ে উঠত না। আবার চাষাবাদ করলেও ফসল তোলার সময় বাধা আসত। ফলে সংঘর্ষ, সংঘাত, হানাহানির ঘটনা ঘটত। সঙ্গে খুন-খারাবিও। অপদখলীয় এলাকার বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ পাবে ৩০২৪ দশমিক ১৬ একর এবং ভারত পাবে ৩৫০৬ দশমিক ৩১ একর। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-নদীয়াতে বাংলাদেশের ১৫৯১ দশমিক ৮০ একর, ভারতের ১১৬৩ একর। পঞ্চগড়-জলপাইগুড়িতে বাংলাদেশের ২৬০ দশমিক ৫৫ একর। কুড়িগ্রাম-গোয়ালপাড়ায় বাংলাদেশ পাবে ১৬০ একর। সিলেট-মেঘালয়ে বাংলাদেশের ১৯৭ দশমিক ৫ একর, ভারতের ৪৬৩ দশমিক ১১ একর। সিলেট-কাছাড়ে বাংলাদেশের ৫৮৯ দশমিক ৭০ একর এবং ভারতের ১৭৪ দশমিক ২৮ একর। কুমিল্লা-নোয়াখালী-ত্রিপুরাতে বাংলাদেশের ৫৫ দশমিক ২৮ একর এবং ভারতের ১৩৬ দশমিক ৯২ একর। সিলেট-ত্রিপুরাতে বাংলাদেশের ১১৯ দশমিক ৭৮ একর এবং ভারতের ১৯৪ দশমিক ১ একর এবং পঞ্চগড়-দার্জিলিংয়ে বাংলাদেশ পাবে ৫০ একর। এই এলাকাগুলো যার যার দেশের ভেতর একীভূত হওয়ার ফলে দু’দেশের মানচিত্রে আসছে পরিবর্তন। বিশ্ব মানচিত্রে দুটি প্রতিবেশী দেশ যার যার ভূ-খ-ের অধিকার ফিরে পাওয়ার পর এই দুই অঞ্চলের মানুষের জীবন থেকে মুছে যাবে সংশয় ও আতঙ্ক। তারা নির্বিবাদে চলাফেরা করতে পারবে নিজ নিজ ভূখ-ে, নিজ নিজ দেশে। কোন অতর্কিত আক্রমণ আর তাদের গ্রাস করবে না। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে বিভাজনকালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার নিয়োজিত র‌্যাডক্লিফ কমিশনের খামখেয়ালিপনা ও তাড়াহুড়োর মধ্যে নিষ্পত্তিকৃত সীমান্ত নির্ধারণী রোয়েদাদের ফসল ছিল ১৬২টি ছিটমহল, যার মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরে ৫১টি ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি। এছাড়া দুই দেশের অপদখলীয় সীমান্তকে ঘিরে সৃষ্ট সমস্যা যা স্বাধীন বাংলাদেশ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। ১৯৫৭ থেকে ৫৮ সালে স্বল্পমেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ছিটমহলগুলো বিনিময়ের বিষয় আলোচনা হয়। ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাঁরা একটি চুক্তি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক জান্তা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৫৮ সালের চুক্তিকে প্রায় অপরিবর্তিত রেখে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সই করেন। পরে তা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হিসেবে পরিচিত হয়। এই চুক্তি সইয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের সংসদে চুক্তিটি অনুসমর্থিত হয়। কিন্তু ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিষয়টি আটকে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারীদের শাসনামলে বোধগম্য কারণেই সীমান্ত চুক্তি নিয়ে ভারত তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরের মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যে ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন ঘটে, তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ক প্রটোকল সই হয়। কিন্তু বিরোধী দল বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের অসহযোগিতায় সংবিধান সংশোধনী বিলটি সংসদে উত্থাপিত হলেও অনুমোদন করানো যায়নি। এখন নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার সকল দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই ইস্যুতে ভারতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলে এবং রাজ্যসভা ও লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস ও ভারতের সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের জট এভাবে খুলে গেল। আর ৪১ বছর ধরে ঝুলে থাকা চুক্তিটি আলোর মুখ দেখল। ছিটমহলবাসী বিশ্বমানবের তালিকাভুক্ত হলো। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী চুক্তি অনুমোদনের পর দু’দেশের মধ্যে অনুমোদনের দলিল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে চুক্তিটি কার্যকর হয়েছে। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী তা বিনিময় করায় এখন ছিটমহলবাসী স্বাধীনতা পেয়েছে। পেয়েছে দেশ ও নাগরিকত্ব। অপদখলীয় এলাকাগুলো আর কারও অপদখলে থাকছে না। মুক্ত বিহঙ্গের মতো এই অঞ্চলের মানুষ ডানা মেলতে পারবে। নিজ বাসভূমে-মাতৃভূমিতে নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। খাঁচার পাখিরা আর নেই খাঁচায়। ইতিহাসের দায়ভার মুক্ত করলেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারতের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বলেছেন, ‘পৃথিবীর অন্য কোথাও এ ধরনের একটি চুক্তি হলে মানুষ বার্লিন ওয়াল ভাঙ্গার সঙ্গে এর তুলনা করত। আমাদের প্রতিবেশী দেশের মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে গেছে সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারিত্বের বার্তায়।’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানি দ্বিখ-িত হয়ে যায়। সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি আর ধনতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানি দুই শত্রুদেশে পরিণত হয়। কিন্তু জনগণ এই রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ, শত্রুতা ও বিভেদকে মেনে নিতে পারেনি। একদিন তারা বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে। দুই দেশের মানুষ এক দেহ এক আত্মায় লীন হয়ে যায়। বদলে যায় খ-িত মানচিত্র। বিশ্বমানচিত্রে এখন একক জার্মানি জ্বল জ্বল করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সীমানারেখা নির্ধারণকালে ছিটমহলগুলোকে এমনভাবে রেখে দেয়া হয় যে, মানুষ দু’দেশে বন্দী হয়ে পড়েন। বিশ্বমানবের তালিকায়ও তাদের ঠাঁই হয়নি। রাষ্ট্রীয় বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করতে কিংবা তাদের এই মানবেতর জীবন থেকে উদ্ধার করতে বিশ্বের কোন মানবাধিকার সংগঠনও এগিয়ে আসেনি। সাহায্যের হাতও কেউ বাড়ায়নি। ভারতবর্ষের আর কোথাও এমনটি ঘটেনি। বিশ্বে আর ছিটমহল রয়েছে কেবল অস্ট্রেলিয়ায় ও নিউজিল্যান্ডে। অবশ্য তারা দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধায় বন্দী জীবন নয় বরং আনন্দের জীবনই অতিবাহিত করে আসছে। প্রায় সাত দশক দুই দেশের ছিটমহলবাসী যে নারকীয় জীবনযাপন করেছেন তা থেকে উদ্ধার পেয়ে তারা যে স্বাধীন জীবন প্রথম পেয়েছে তা বিশ্ব মানব ইতিহাসে অনন্য ও নজিরবিহীন। তাদের এই মুক্তির পেছনে মূল অবদান দুই মহান ব্যক্তিত্বের। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী না হলে এই চুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা না হলে এই চুক্তি বাস্তবায়ন হতো সুদূরপরাহত। দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক সময় এখন। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে ‘গোলামির চুক্তি, দাসত্বের চুক্তি, দেশ বিক্রির চুক্তি’ ইত্যাকারভাবে ভূষিত করা হয়েছে। বিশেষত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা এই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান বজায় রেখে দু’দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিল। ছিটমহলবাসীর প্রতিও করেছে অন্যায়, অমানবিক ও গ্লানিকর আচরণ। বঙ্গবন্ধু চুক্তি বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপের পক্ষেই ছিলেন। সে অনুযায়ী কার্যকর ভূমিকাও রাখা হয়। কিন্তু নির্মম হত্যা সে পথ রুদ্ধ করে। জান্তা শাসকরা জনগণকে জানার সুযোগও দেয়নি। কী ছিল চুক্তিতে? ৫টি অনুচ্ছেদের এই চুক্তিতে প্রথম অনুচ্ছেদে রয়েছে ১৫টি ধারা, যেখানে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে কার সীমানা কতটুকু। সেই চুক্তিটি পর্যালোচনাই স্পষ্ট করে এটা কোন গোলামির চুক্তি নয় বরং স্বাধীন সত্তার বিকাশের চুক্তি। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষরিত চুক্তিটি একটি মাইলফলক, যা দুই দেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত। অনুচ্ছেদ ১-এর ১ নম্বর ধারা হচ্ছে বাংলাদেশ-মিজোরাম সেক্টর : সর্বশেষ দেশ বিভাগ-পূর্বকালের বিজ্ঞপ্তিসমূহ ও নথিপত্রের ভিত্তিতে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন করতে হবে। ২. সিলেট-ত্রিপুরা সেক্টর : ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিতকরণে এরই মধ্যে যে অগ্রগতি হয়েছে তা যথাশীঘ্রই সম্ভব সম্পন্ন করতে হবে। ৩. ভগলপুর রেলওয়ে লাইন : পূর্বগামী রেলওয়ে বাঁধের প্রান্তমুখী ৭০ ফুট সমান্তরাল দূরত্বে সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। ৪. গৌরাঙ্গখালী-শিবপুর সেক্টর : ১৯১৫-১৯১৮ সালের জেলা ভূমি জরিপ মানচিত্রের ভিত্তিতে ১৯৫১-৫২ সালে শুরু করা প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে চিহ্নিত করতে হবে। ৫. মুহুরী নদী (বিলোনিয়া) সেক্টর : এ অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিতকরণের সময় মুহুরী নদীর মাঝপ্রবাহ বরাবর চিহ্নিত করতে হবে। এই সীমানাই হবে স্থায়ী। উভয় সরকার নদীটির গতিধারা অপরিবর্তিত রাখার লক্ষ্যে নিজ নিজ অংশে বাঁধ নির্মাণ করবে। ৬. ত্রিপুরা-নোয়াখালী/কুমিল্লা সেক্টরের বাদবাকি অংশ : এ সেক্টরের সীমানা চিহ্নিতকরণ ১৮৯২-৯৪ সালের চাকলা-রোশনাবাদ এস্টেট মানচিত্রের ভিত্তিতে হবে এবং এতে অনুল্লেখিত অঞ্চলসমূহের সীমানা জরিপ জেলা ভূমি মানচিত্রের (১৯১৫-১৮) ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। ৭. ফেনী নদী : সার্ভে অব ইন্ডিয়া ম্যাপশীট নং ৭৯ এম/১৫, প্রথম সংস্করণ ১৯৩৫ সালের ফেনী নদীর ওই শাখা চিহ্নিতকরণের সময় মাঝপ্রবাহ বরাবর সীমানা চিহ্নিত করা হবে। উল্লেখিত মানচিত্রের এ নদীকে এখনও আশালং সি-তে (আশালং ছড়া) প্রবাহিত দেখানো হয়েছে। সীমানা চিহ্নিত করার সময় ভাটার ওই স্থান থেকে ফেনী নদীর মাঝপ্রবাহ বরাবর সীমানা চিহ্নিত করা হবে। এই সেক্টরে এই সীমানা হবে স্থায়ী। ৮. ত্রিপুরা-পার্বত্য চট্টগ্রাম সেক্টরের বাকি অংশ : সীমানা, ৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ফেনী নদীর ওই শাখার মাঝপ্রবাহে গ্রিড রেফারেন্স ০০৯৭৭৯ পর্যন্ত অনুসৃত হবে (৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ম্যাপশীট অনুযায়ী) যেখান থেকে সীমানা প্রান্তবর্তী জলস্রোতের মাঝপ্রবাহে অনুসৃত হবে। এই জলস্রোতের উৎস থেকে সীমানা রেখা চলে যাবে উল্লেখিত মানচিত্রে বর্ণিত বয়ান আশালং জলস্রোতের মাঝপ্রবাহের স্বল্প দূরত্ব দিয়ে এবং অতঃপর সীমানা রেখা সংযোগস্থলে এর উৎসে না পৌঁছা পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এই নদীর মাঝপ্রবাহ বরাবর এগিয়ে যাবে (উল্লেখিত মানচিত্রের গ্রিড রেফারেন্স ০৪৬৮১০ নির্দেশিত) সেখান থেকে সীমারেখা সংযোগস্থলের শীর্ষ বরাবর চলে যাবে ভগবান ট্রিগ স্টেশন পর্যন্ত। সীমারেখা ভগবান ট্রিগ স্টেশন থেকে বাংলাদেশ-অসম-ত্রিপুরা সীমান্তের ত্রিমুখী জংশন পর্যন্ত (খানতালাং ট্রিগ স্টেশন) দু’দেশের নদীপ্রবাহের অববাহিকায় বিভাজন রেখা বরাবর চলে যাবে। মানচিত্র ও ভূমির অবস্থানের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকলে সেক্ষেত্রে ভূমিই প্রাধান্য পাবে। এ সেক্টরের সীমানা হবে স্থায়ী। ৯. করিমগঞ্জ-বিয়ানীবাজার সেক্টর : উমাপতি গ্রাম ভারতে ফেলে এই গ্রামের পশ্চিম সীমানার অচিহ্নিত করা অংশ চিহ্নিতকরণে সম্মত ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিহ্নিত করা হবে। ১০. হাকার খাল : ইছামতি নদী থেকে পৃথক করে হাকার খালকে একটি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৫৮ সালের নেহরু-নূন চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সীমানা চিহ্নিত করা হবে। এ সীমানা হবে স্থায়ী। ১১. বৈকারী খাল : বৈকারী খালের ক্ষেত্রে সীমানা ১৯৪৯ সালের পশ্চিমবঙ্গ ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি নথিভুক্তি ও জরিপের পরিচালকদের মধ্যে সম্পাদিত বা সম্মত নীতিমালা অনুযায়ী করতে হবে। এক্ষেত্রে ভূমি প্রাধান্য পাবে। ১২. ছিটমহলগুলো : ১৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ছিটমহলগুলো ব্যতীত বাংলাদেশে ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতীয় বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো অতিসত্বর বিনিময় করতে হবে। বাংলাদেশে যে বাড়তি এলাকা পড়বে তার জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া হবে না। দেয়াও হবে না। ১৩. হিলি : এ অঞ্চলে র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ও র‌্যাডক্লিফ কর্তৃক মানচিত্রের আঁকা রেখার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিহ্নিত করতে হবে। ১৪. বেরুবাড়ী : ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং ১২-এর দক্ষিণ দিকের অর্ধাংশ ও পার্শ্ববর্তী ছিটমহলগুলোর অধিকারী হবে, যে এলাকার পরিমাণ ২ দশমিক ৬৪ বর্গমাইল এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের অধিকারী হবে। বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার (পাটগ্রাম থানা) সঙ্গে দহগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে তিনবিঘা নামক স্থানের কাছে ১৭৮ মিটার ও ৮৫ মিটার এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবে। ১৫. লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ী : সর্বশেষ চিহ্নিত সীমানা পিলারের পয়েন্ট ওয়াই থেকে পাথেরিয়া হিলস বরাবর দক্ষিণ অভিমুখী সেই পয়েন্ট পর্যন্ত যাবে, যেখানে সীমারেখা ডুমাবাড়ী মৌজার পশ্চিম সীমানায় মিলিত হয়। অতঃপর ডুমাবাড়ী ও লাঠিটিলা মৌজাদ্বয়ের জংশন হয়ে ডুমাবাড়ী মৌজা বরাবর ডুমাবাড়ী, লাঠিটিলা ও বড় পুতনিগাঁও মৌজাত্রয়ের জংশন পর্যন্ত যাবে। এ পয়েন্ট থেকে সীমারেখা পুতনিচরের মাঝপ্রবাহে মিলিত হয়ে স্বল্প দূরত্ব বরাবর এগিয়ে যাবে। অতঃপর সিলেট ও ত্রিপুরার মধ্যকার সীমানায় মিলিত হওয়া অবধি চিহ্নিতকরণের সময়ে সীমারেখা পুতনির গতিপথের মাঝপ্রবাহ বরাবর দক্ষিণ দিকে এগোবে। অনুচ্ছেদ ২-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার সম্মত হয়েছে যে, অঞ্চলগুলোর বিপরীত অবস্থানের যে ভূখ- এরই মধ্যে চিহ্নিতকরণ হয়ে গেছে, যার সীমারেখা মানচিত্র এর মধ্যে প্রস্তুত হয়েছে, সীমারেখা মানচিত্রগুলোতে পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যে বিনিময় করতে হবে। উভয় সরকার কর্তৃক চুক্তি অনুমোদন বা রেটিফিশনের পর পরই তারা সংশ্লিষ্ট মানচিত্রগুলোতে যথাশীঘ্রই সম্ভব স্বাক্ষর করবে ( যা কোন ক্ষেত্রেই ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের পরে নয়)। অন্য অঞ্চলে এরই মধ্যে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন হয়েছে, তাসহ মানচিত্রগুলো ছাপানোর ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এগুলো ৩১ মে ১৯৭৫ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। যেসব সেক্টরে ভূখ- হস্তান্তরের বিষয়টি এখনও চিহ্নিত করা হয়নি, তা সংশ্লিষ্ট সীমারেখা মানচিত্রগুলোতে পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের স্বাক্ষরের ৬ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। অনুচ্ছেদ ৩-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার সম্মত হয়েছে, যে অঞ্চলগুলো হস্তান্তর করা হবে, সেসব অঞ্চলের জনগণকে মালিকানা হস্তান্তরিত জায়গায় বা অঞ্চলের মধ্যে অবস্থান করার অধিকার দেয়া হবে। ওই রাষ্ট্রটিরই নাগরিক হিসেবে যে রাষ্ট্রে অঞ্চলগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। সীমানা চিহ্নিতকরণ ও ভূখ- বিনিময় পারস্পরিক সম্মতির মধ্য দিয়ে করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থিতাবস্থার কোন অন্তরায় সৃষ্টি করা যাবে না এবং সীমান্ত অঞ্চলের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখতে হবে। দু’দেশ এ ব্যাপারে সীমান্ত অঞ্চলের স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবে। অনুচ্ছেদ ৪-এ বলা হয়েছে যে, এ চুক্তির ব্যাখ্যা অথবা বাস্তবায়ন বিষয়ক যে কোন বিরোধ পারস্পরিক সলাপরামর্শের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করা হবে। অনুচ্ছেদ ৫-এ উল্লেখ রয়েছে যে, চুক্তিটি বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার অনুমোদন করবে এবং অনুমোদনের দলিল যথাশীঘ্র সম্ভব বিনিময় করা হবে। অনুমোদনের দলিল বিনিময়ের তারিখ থেকে চুক্তিটি কার্যকর হবে। ৬ জুন শনিবার দুই প্রধানমন্ত্রী দলিল বিনিময় করেন। আর মুছে যায় ছিটমহল শব্দটি। বার্লিন ওয়াল ভেঙ্গে গেছে অনেক আগেই। এবার ছিটমহল আর অপদখলীয় এলাকার দেয়ালগুলোও ভেঙ্গে গেল। নতুন মানচিত্রে জ্বল জ্বল করবে এখন হাসি মাখা দু’দেশের মানুষের মুখ। নতুন মানচিত্রে বাংলাদেশ জুড়ে উড়বে লাল সবুজের পতাকা। দেশের আত্মার সঙ্গে মিলিত হবে একদার ছিটমহলবাসী।
×