ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বপ্নের সাথী ছিলাম আমি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৮ জুন ২০১৫

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বপ্নের সাথী ছিলাম আমি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সমর্থন আদায়ে ভূমিকার কথা স্মরণ করে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দিল বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ রবিবার বঙ্গভবনে বাজপেয়ীর এই সম্মাননা তুলে দেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, শ্রী বাজপেয়ীর যোগ্য উত্তরসূরি এবং বাংলাদেশের আরেক বন্ধু শ্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে সম্মাননা স্মারকটি হস্তান্তর করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। পূর্বসূরির হয়ে সম্মাননা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, আজ আমার জন্য এক সৌভাগ্যের মুহূর্ত। ভারতবাসীর জন্য এক গৌরবের মুহূর্ত। অটল বিহারী বাজপেয়ী, যিনি আমার মতো অনেকের জন্য প্রেরণা, এমন ভারতরতœকে আজ বাংলাদেশ সম্মানিত করছে। তিনি বলেন, একাত্তরে আমি ছিলাম বাংলাদেশের স্বপ্নের সাথী। তিনি আরও বলেন, ওই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যে সত্যাগ্রহ করেছিল জনসংখ্যা, এক যুবকর্মী হিসেবে তিনি গ্রাম থেকে দিল্লীতে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের যে সৈনিকেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের সবাইকে বাংলাদেশ সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে রাষ্ট্রপতি হামিদ তার বক্তৃতায় জানান। ভারতের মত একটি বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির প্রজ্ঞা এবং সক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করেন মোঃ আবদুল হামিদ। পাশাপাশি গত বছরের ভারত সফরের সময় মোদির সঙ্গে তার সাক্ষাতের স্মৃতিচারণও করেন রাষ্ট্রপতি। সবশেষে নিজের বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় নিহত সকল ভারতীয় সেনাকে সম্মাননা দেয়া হবে বলেও এ সময় ঘোষণা দেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির ভাষণের আগে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা সম্মাননা দেয়া হয় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই ইন্দিরার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে সেই সম্মাননাপত্র তুলে দেয়া হয়। এক বছর আগে দায়িত্ব নেয়ার পর এবার প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন নরেন্দ্র মোদি। রবিবার দুপুরে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত এবং বাজপেয়ীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নিতে তিনি বঙ্গভবনে যান। রাষ্ট্রপতি নিজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গভবনে অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল হলে তাদের সৌজন্য সাক্ষাত হয়। এরই মধ্যে বঙ্গভবনে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গভবনের দরবার হলে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতি যখন পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সে সময় ভারতকে পাশে পেয়েছিল বাংলাদেশ। রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে শ্রী বাজপেয়ীর অকুণ্ঠ সমর্থন ভারতীয় রাজনৈতিক মহলকে আমাদের স্বাধীনতার সপক্ষে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় তিনি যেসব কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সব সময়ই বাজপেয়ীর সহমর্মিতা ও সহযোগিতা পেয়েছে। তিনি যখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনও তার প্রমাণ মিলেছে। একজন মহৎ ব্যক্তি এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুকে সম্মানিত করার মাধ্যমে আমরা নিজেদের সম্মানিত করছি। সূত্র জানায়, ১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে বাজপেয়ীর জন্ম। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে তারুণ্যেই তাকে কারাগারে যেতে হয়। ভারতীয় জনসংঘে যোগ দেয়ার পর ১৯৬৮ সালে এ সংগঠনের সভাপতি হন বাজপেয়ী। ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন এবং প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাজপেয়ীর সেই বিজেপিই এখন ভারতের ক্ষমতায়, নরেন্দ্র মোদি সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। অটল বিহারী বাজপেয়ী ভারতের সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তার জীবনের অর্ধেকের বেশি সময়। ভারত সরকার ১৯৯২ সালে তাকে ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ২০১৪ সালে ‘ভারতরতœ’ পদকে ভূষিত করে। ২০০৫ সালে রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়া বাজপেয়ী একজন কবি ও বাগ্মী হিসাবেও সুপরিচিত। বাজপেয়ী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ওই সময় ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি এবং লোকসভার সদস্য হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারকে সমর্থন দেয়ার জন্য তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে দাবি জানান। তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় জনসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন ও প্রতিবাদ র‌্যালির আয়োজন করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন তিনি। সম্মাননা অনুষ্ঠানে মানপত্র পড়ে শোনান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। এতে বলা হয়, অটল বিহারী বাজপেয়ী একাত্তরে লোকসভার সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। ‘অরগানাইজার’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বাগত জানান এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবিতে জনসংঘ ১৯৭১ সালের ১ থেকে ১১ আগস্ট গণসত্যাগ্রহ এবং ১২ আগস্ট ভারতের সংসদ ভবনের সামনে বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করে। শ্রী বাজপেয়ী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ এবং এদেশের মুক্তিকামী জনতার সমর্থনে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে অটল বিহারী বাজয়েপীর দেয়া বক্তব্য তুলে ধরে নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাজপেয়ীজি যা বলেছিলেন, এই রক্ত এমন সম্পর্কের নির্মাণ করবে যা কখনও ভাঙ্গবে না, কোন কূটনীতির শিকার হবে না। আজ এই পবিত্র মুহূর্তে আমাদের এই সংকল্প করতে হবে যেন এ সম্পর্ক অটুট থাকে। বাজয়েপীজির সম্পর্কের বার্তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। শারীরিক অবস্থা ভাল থাকলে ৯১ বছর বয়সী বাজপেয়ী নিজেই এ সম্মাননা গ্রহণ করতেন এবং তাতে এ আয়োজন আরও পূর্ণতা পেত বলে মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, তার মেয়ের উপস্থিতিতে এ সম্মান দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, যিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, তার হাত থেকে এ সম্মাননা নিচ্ছি। এটাই অনেক গৌরবের। মোদি জানান, রাজনীতিতে তিনি অনেক পরে এলেও একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন জানিয়ে জনসংঘের সত্যাগ্রহে তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। সত্যাগ্রহে যোগ দিতে গ্রাম থেকে দিল্লী এসেছিলাম। যে কোটি ভারতীয় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমিও তাদের একজন ছিলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে ও শেষে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়, যার রচয়িতা একই ব্যক্তি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্মাননা অনুষ্ঠান শেষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ রাষ্ট্রের উর্ধতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ।
×