ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে

মোদির সঙ্গে খালেদার সাক্ষাত হওয়ায় বিএনপি উজ্জীবিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৯ জুন ২০১৫

মোদির সঙ্গে খালেদার সাক্ষাত হওয়ায় বিএনপি উজ্জীবিত

শরীফুল ইসলাম ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। সরকারবিরোধী টানা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর ঝিমিয়েপড়া নেতাকর্মীর মধ্যে দলের ভবিষ্যত নিয়ে যে হতাশা ভর করে মোদি-খালেদার বৈঠকের পর কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। এর ফলে বিএনপির সামনে পরবর্তী কর্মসূচী নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জোর চেষ্টা চালায় রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপি। তখনও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার আওয়ামী লীগের প্রতি জোরালো সমর্থন দেয়ায় বিএনপি ভারতের কাছে ভিড়তে পারেনি। তবে নানা কৌশলে কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করে তারা। এ জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করলেও কোন কৌশলই সফল হয়নি। ওই বছর ১৬ এপ্রিল ভারতের লোকসভা নির্বাচনের পর ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে স্বাগত জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এর পর ভারতের সঙ্গে অতীতের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে গিয়ে সে দেশের নতুন সরকার ও প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দেখা করে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আমন্ত্রণ না পাওয়ায় ওই যাত্রায় ভারত যেতে না পেরে হতাশ হন খালেদা জিয়া। তবে থেমে থাকেননি তিনি। বিভিন্ন মাধ্যমে বিজেপি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু কংগ্রেসের মতো বিজেপি সরকারও ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে পুরোদমে সহায়তার আশ্বাস দেয়ায় খালেদা জিয়ার আশায় গুড়ে বালি পড়ে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে। এর পর ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতির পর একদিকে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়াসহ দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা গ্রেফতার হওয়া ও অপরদিকে দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুইয়ার নেতৃত্বে শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা আলাদা অবস্থানে থেকে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান করে চরম নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় দলটি। এ পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ দলের অনেক নেতা জামিনে মুক্তি পেলেও সবকিছু এলামেলো হয়ে যায়। এর ফলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভারাডুবি হয়। নির্বাচনের পর বিগত ৩ বছরে দলের জাতীয় কাউন্সিল ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী সফল করতে পারেনি বিএনপি। তবে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৩ সালের শেষের দিকে সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াওসহ ব্যাপক নাশকতা চালিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তারা। সে বছর ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া ঘোষিত মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচী ব্যার্থ হওয়ার পর বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে সারাদেশে কেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যথারীতি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায় এবং নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করে। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ের ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের পাশাপাশি এ বছর ৫ জানুয়ারি থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার প্রস্তুতি নেয় বিএনপি। ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করতে ৩ জানুয়ারি রাতেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন। কিন্তু পুলিশী বাধায় গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে না পেরে ৫ জানুয়ারি বিকেলেই তিনি ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে ৯২ দিন পর তিনি গুলশান কার্যালয় থেকে বাসায় ফিরে যান। টানা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর খালেদা জিয়া ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে রাজধানীতে ক’দিন গণসংযোগ ও জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দরিদ্রদের মাঝে ২ দিন খাবার বিতরণ ছাড়া তেমন কোন কর্মসূচীতে অংশ নেননি। অবশ্য বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচীও এর বাইরে খুব একটা ছিল না। এ পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীরা চরম হতাশায় দিন কাটাতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের খবর শুনে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিভিন্ন মাধ্যমে লবিং করতে থাকেন যেন তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান। প্রথমে সাক্ষাতের আশ্বাস না পেয়ে হতাশ হলেও পরে জোরালো চেষ্টা করে সফল হন। রবিবার বিকেলে দলের ৫ সিনিয়র নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এ সময় তিনি দেশে গণতন্ত্র বজায় রাখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মোদির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এদিকে মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত হওয়ায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। রবিবার বিকেল থেকেই বিএনপির নেতাকর্মীরা একে অপরের সঙ্গে খুশিমনে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশান চেয়ারপার্সন কার্যালয়ে আগত নেতাকর্মীদের খুশি খুশি মনে হয়েছে। প্রসঙ্গত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সাক্ষাত করতে না যাওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। ভারত সরকারও বিএনপিকে বাঁকা চোখে দেখে। সে দেশের সাধারণ মানুষও বিষয়টিকে ভালভাবে নেননি। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সেনারগাঁও হোটেলে গিয়ে সাক্ষাত করার কথা ছিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। সেদিন ছিল ২০ দলীয় জোটে বিএনপির শরিক দল জামায়াতের হরতাল। হরতালের মধ্যে গাড়িবহর নিয়ে গুলশানের বাসা থেকে সোনারগাঁও হোটেলে গেলে হরতাল ভঙ্গ করা হবে এবং এ জন্য দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত নাখোশ হবে বলে সেদিন খালেদা জিয়া প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাত করতে না গিয়ে শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ করেন। তবে খালেদা জিয়ার এ অবস্থানে খোদ বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা নাখোশ হলেও জামায়াতের নেতাকর্মীরা বেজায় খুশি হন। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাত অনুষ্ঠানে না গিয়ে খালেদা জিয়া যে অসৌজন্যতা দেখিয়েছেন তা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ২০১৩ সালের শেষদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশ এগিয়ে এলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত এ ব্যাপারে কোন সাড়া দেয়নি। বরং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তখন বরাবরই বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার সংবিধান অনুসারে নির্বাচন করলে এতে তাদের কোন আপত্তি নেই। প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারতের এ অবস্থানের কারণে বিএনপির কূটনৈতিক মিশন ব্যর্থ হয়। এর ফলে বিএনপি জোটের লাগাতার আন্দোলনসহ নির্বাচন বয়কটের হুমকি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে ফেলে। কিন্তু বিএনপি বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের সমর্থনের পাশাপাশি ভারতের সমর্থন আদায় করে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার কৌশল নিয়ে ব্যর্থ হয়। শুধু যে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়া সাক্ষাত না করার কারণেই বিএনপির প্রতি বিজেপি ক্ষুব্ধ তা নয়। আরও একটি কারণে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার প্রতি বিজেপি ক্ষুব্ধ। আর তা হচ্ছে, খালেদা জিয়া বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকালে ৭ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে ফলাও প্রচার করা হয়। পরদিন দেশ-বিদেশের মিডিয়ায়ও এ খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অমিত শাহর পক্ষ থেকে এ খবর ডাহা মিথ্যা বলে জানালে খালেদা জিয়া ও বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে। খালেদা জিয়া ও বিএনপির পক্ষ থেকে অমিত শাহকে নিয়ে এভাবে মিথ্যাচার করার বিষয়টিকে বিজেপি, নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং ভারতবাসী ভালভাবে নেয়নি। আর এ কারণেই এবার নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাত করে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উঠেপড়ে লাগেন খালেদা জিয়া। তবে মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর সে চেষ্টায় কতটা সফল হন তা এখন দেখার বিষয়। তবে মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়া সাক্ষাত করতে পেরেছেন এটাই এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে বড় পাওয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, এ সাক্ষাত আমাদের জন্য ইতিবাচক। আমরা দেশের গণতন্ত্র অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের দলের চেয়ারপার্সন সাক্ষাত করেছেন এটা অবশ্যই খুশির খবর। বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিএনপিকে মূল্যায়ন করেছেন এটা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে তিনি এবং তার সরকার বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার বিষয়ে সহযোগিতা করবেন, আমরা এমন আশা করছি।
×