ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে পর্যবেক্ষণ;###; ধর্ষণকারী শুকুর আলীর মৃত্যুদ- বহালই রয়েছে;###; আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে পর্যবেক্ষণ;###;ধর্ষণকারী শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহালই রয়েছে

সাজা প্রদানে আদালতের এখতিয়ার সীমিত করা সংবিধানসম্মত নয়

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৯ জুন ২০১৫

সাজা প্রদানে আদালতের এখতিয়ার সীমিত করা সংবিধানসম্মত নয়

বিকাশ দত্ত ॥ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (১৯৯৫) ধর্ষণ করে হত্যা মামলায় একমাত্র সাজা মৃত্যুদ-ের বিধানকে আপীল বিভাগ অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও ধর্ষণকারী শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহালই রয়েছে। অন্যদিকে আপীল বিভাগ তার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার প্রমাণের ধরন অনুসারে সাজা প্রদানের বিষয় বিবেচনা করার আদালতের এখতিয়ারকে সীমাবদ্ধ করে দেয়ার বিধান সংবিধানসম্মত নয়। আইন প্রণেতা আদালতকে নির্ধারিত সাজা দেয়া ছাড়া বিকল্প চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে রায় প্রদানের ক্ষমতা খর্ব করাকে সংবিধানবহির্ভূত উল্লেখ করা হয়েছে। আপীল বিভাগ তার রায়ে ১৯৯৫ সালের আইনের আওতায় দায়েরকৃত মামলা আপীল ঐ আইনের বিধান অনুসারেই চলবে মর্মে উল্লেখ করলেও রায়ের বিষয়টি ২০০০ সালের আইনের অনুকরণে প্রযোজ্য হবে মর্মে বলা হয়েছে। আপীল বিভাগের রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৯৫ সালের আইন অনুসারে দায়েরকৃত মামলার ও আপীলের নিষ্পত্তিতে সাজার বিষয়টি ‘মৃত্যুদ-ের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়োজন হবে না। ফলে আদালত তার নিজস্ব বিবেচনা থেকেই অপরাধের ধরন, সাক্ষ্য, প্রমাণ এবং পারিপার্শ্বিকতাকে বিচারিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করে উপযুক্ত সাজা প্রদানের এখতিয়ার রাখবে। সম্প্রতি আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। অন্যদিকে দেশের আইন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, আদালত যে সমস্ত ধারা অংসাবিধানিক ঘোষণা করেছে, তার সংশোধনী আনতে হবে। তারা আরও বলেছেন, ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬ এর ২, ৩, ৪ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলেও, ২০০০ সালের আইনে ধর্ষণের হত্যায় মৃত্যুদ-সহ যাবজ্জীবন করাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। ধর্ষক শুকুর আলীকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে। আইনটি যদি অবৈধ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে শুকুর আলীর বিষয়ে আইন শাখা থেকে সরকারকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আইন বিশেষজ্ঞগণ আরও বলেছেন, ধর্ষকরা কোনভাবেই উৎসাহিত হবে না। কারণ অপরাধীদের সাজা নির্ভর করে অপরাধের ধরন এবং কিভাবে বা কতটুকু জোরালোভাবে অভিযোগ প্রমাণিত, ওপর। আপীল বিভাগের রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ৬(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার একমাত্র শাস্তি দেয়া হয়েছে মৃত্যুদ-, একইভাবে ২০০০ সালের ৩৪ ধারায় শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- দেয়া আছে। আদালত মনে করে, দুটি ধারাই অসাংবিধানিক। মৃত্যুদ- একমাত্র শাস্তি হতে পারে না। ধারাতে যদি একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ- হিসেবে লেখা থাকে, তা হলে আদালত বিচারিক অনুভূতি প্রয়োগের সুযোগ পায় না। যে কোন অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদ- দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সংবিধানের ২৭,৩১,৩২ ও ৩৫(৫) ধারার কথা উল্লেখ করেছে উচ্চ আদালত। সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩১ এ বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। সংবিধানের ৩২-এ বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। ৩৫(৫) বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনার দ- দেয়া যাবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না। এই রায় প্রকাশের পর আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, আদালত যে ধারাগুলো অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে তা পুরো রায় না পড়ে কিছু বলা যাবে না। তবে অটোমেটিক থাকবে না। ইনকোয়ারি করতে হবে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদও বলেছেন, ১৯৯৫ সালের আইনটি বলবৎ নেই। ১৯৯৫ সালের আইনের পর পুনরায় ২০০০ সালের আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে। আপীল বিভাগ যে ধারাগুলো অসাংবিধানিক বলেছে সেগুলো সংশোধনী আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, এর ফলে ধর্ষণকারীরা উৎসাহিত হবে না। কারণ, বর্তমান আইনে ধর্ষণ করে হত্যা করার শাস্তি মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন করাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। সব কিছু নির্ভর করবে অপরাধের ধরনের ওপর। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রায়টা দেখতে হবে। এর আগে রায় ঘোষণার দিন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তবে আমার মত হচ্ছে, পুরনো আইনে চলা মামলাগুলো এখন ২০০০ সালের আইনে চলতে পারে। কারণ, ২০০০ সালের আইনে ধর্ষণ ও হত্যার শাস্তি যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদ- দুটোই আছে। ১৯৯৫ ঐ বিধান বাতিল হলে বর্তমান আইনে বিচার করতে কোন বাধা নেই। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ.ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, আপীল বিভাগ যে ধারা অসাংবিধানিক বলেছে, সেগুলো সংশোধন করতে হবে। আর ১৯৯৫ সালের আইনে মামলাগুলো রুজু আছে সেই আইনে বিচার হবে তবে সাজার ক্ষেত্রে একমাত্র মৃত্যুদ- থাকবে না। ২০০০ সালের আইনে সাজা ও অপরাধের আইনে বিবেচনা করা। এদিকে বিভিন্ন খবরে দেখা গেছে, গত চার মাসে সারাদেশে শতাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং এর মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। এর বাইরেও অনেক যৌন নিপীড়নের ঘটনা আছে যা অপ্রকাশিত। মৃত্যুদ-ই একমাত্র বিধান নয় এতে কি ধর্ষকগণ উৎসাহিত হবে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে শ.ম রেজাউল করিম বলেন, কোনভাবেই উৎসাহিত হবে না। কারণ, অপরাধীদের সাজা নির্ভর করে অপরাধের ধরন এবং কিভাবে বা কতটুকু জোড়ালোভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তার ওপর। মৃত্যুদ-ে দ-িত করার একমাত্র বিধান থাকলেও তা নির্ভর করবে মামলার প্রমাণ করা বা না করার ওপর। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেছেন, এ রায়ের ফলে ধর্ষকরা উৎসাহিত হবে কিনা এই প্রশ্নটি আর এ রায় দুটি দুই বিষয়। কারণ, রায়টিতে সংসদের একটি আইনের অসাংবিধানিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্যুদ-কে একমাত্র শাস্তি হিসেবে রেখে করা আইনটির সমালোচনা করা হয়েছে। এবং অসাংবিধানিক করা হয়েছে। এরই সঙ্গে ১৯৯৫ সালের অধীনে যেসব মামলা চলমান রয়েছে সেই মামলাগুলোর শাস্তির বিষয়ে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল তারও অবসান ঘটেছে। এবং একই সঙ্গে এই রায়ে এটাও বলা হয়েছে যে, যদি প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় যে ঘটনার ধারাবাহিকতা কোন বিচ্যুতি ছিল না। বা ঘটনার পারিপার্শি¦কতা শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তির দিকেই নির্দেশ করছে। সে ক্ষেত্রে একজন বিচারক সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে মৃত্যুদ- দিতে পারবেন। এই আইনটি বাংলাদেশে শাস্তির বিধান সম্পর্কিত বিষয়ে একটি মাইলফলক হিসেবে থাকবে। ব্লাস্টের পক্ষের আইনজীবী আব্দুল মান্নান খান বলেছেন, এই রায়ের ফলে ১৯৯৫ সালের আইনে যে মামলাগুলো রুজু করা আছে তাতে মৃত্যুদ- সাজা হবে না। তবে ২০০০ সালের আইনে মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন শাস্তি রয়েছে। ধারা অবৈধ হলেও শুকুর আলীর শাস্তি মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এখন শুকুর আলীকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে। আইনটি যদি অবৈধ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে শুকুর আলীর বিষয়ে আইন শাখা থেকে সরকারকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ করে হত্যা মামলায় একমাত্র সাজা মৃত্যুদ-ের বিধানকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় প্রদান করেছে আপীল বিভাগ। ৫ জুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট আপীল বিভাগ এই মাইলফলক রায়টি প্রদান করে। ঐ বেঞ্চে অন্যান্য বিচারপতির মধ্যে ছিলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। সম্প্রতি ৭০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। ঐ রায়ের রায়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধানটিকেই অসাংবিধানিক বলছে আদালত। একই সঙ্গে আইনটির ৬(৩) ও ৬(৪) ধারা এবং ২০০০ সালের সংশোধিত আইনের ৩৪(২) ধারাকেও অসাংবিধানিক বলা হয়েছে । সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়েছে। ৭০ পৃষ্ঠার ঐ রায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছে। ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬ এর ২, ৩, ৪ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। ঐ ধারাগুলোতে ধর্ষণ ও হত্যার ক্ষেত্রে সাজা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। তিনটি ধারায় সাজা হিসেবে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হলেও ৬(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার দায়ে কেবল মৃত্যুদ-ের বিধান ছিল। ২০০০ সালে আইনটি সংশোধন করা হলে পুরনো আইন রহিত হয়ে যায়। নতুন আইনের ৯(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার ক্ষেত্রে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রাখা হয়। কিন্তু ২০০০ সালের আইনের ৩৪ এর ২ ধারায় বলা হয়, এ ধরনের অভিযোগে ১৯৯৫ সালের আইনে যেসব মামলা বিচারাধীন সেগুলো ওই আইনেই চলবে। আপীল বিভাগের রায়ে এই ধারাটিও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে শুধু মৃত্যুদ-ের বিধান আর থাকছে না। মামলার ঘটনা থেকে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার শিবরামপুর গ্রামে শুকুর আলী নামে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। ২০০১ সালের ১২ জুলাই বিচারিক আদালত শুকুর আলীকে মৃত্যুদ- প্রদান করে। ২০০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট মৃত্যুদ- বহাল রাখে। ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপীল বিভাগও সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। শুকুর আলী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ওই বছরের ৪ মে তাও খারিজ করে দেয় আপীল বিভাগ। এর পর শুকুর আলী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১০ সালের ২ মার্চ হাইকোর্ট ৬ এর ২ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। তবে আপীল বিভাগে শুকুর আলীর মৃত্যুদ- বহাল থাকায় হাইকোর্ট তাতে কোন হস্তক্ষেপ করেনি। সাজা না কমায় ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবারও আপীল বিভাগে আসেন শুকুর আলী ও ব্লাস্ট। এছাড়া ওই আইনে দ-প্রাপ্ত আরও ১০টি আবেদনের শুনানি করে গত মাসে আপীল বিভাগ বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। আপীল বিভাগ ওই আপীল মঞ্জুর করে ১৯৯৫ সালের আইনের তিনটি ধারা বাতিল করে।
×