ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আইএস দখলের এক বছর

মসুলে নারকীয় পরিবেশ

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১০ জুন ২০১৫

মসুলে নারকীয় পরিবেশ

দখল করার এক বছর পরে আইএস্ ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী মসুলে যে নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে বিবিসির ঘাড়ি সারির গোপনে ধারণকৃত একান্ত ভিডিও ফুটেজে তা ধরা পড়েছে। সেখানে দেখা যায়, নগরবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনে আইএসের নৃশংস ও নিপীড়নের চিত্র। ভিডিওতে দেখা যায়, আইএস মসজিদ উড়িয়ে দিচ্ছে, স্কুলগুলোকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে এবং নারীদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো পোশাকে তাদের শরীর আবৃত করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অন্যথায় তাদের ভর্ৎসনার শিকার হতে হচ্ছে। বাসিন্দারা চরমপন্থী গোষ্ঠীর ইসলামী আইনের কঠোর ব্যাখ্যার আওতায় কিভাবে শাস্তির আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন তা বর্ণনা করেছেন। তারা সরকারী বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানে আইএসের প্রস্তুতির কথাও তুলে ধরেন। বিবিসি প্রকৃত নাম গোপন করে কয়েকজন নারী-পুরুষের শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। গতবছর কয়েকমাস ধরে এসব ভিডিও চিত্রায়িত করা হয়। ঘরে বসে থাকার একঘেয়েমিতে ক্লান্ত হয়ে হান্না (পরিবর্তিত নাম) নামে একজন নারী একদিন নদীর ধারের একটি মনোরম রেস্তরাঁয় যান, যেখানে তারা তাদের বাগদানের সময় অনেকবার গেছেন। তার পুরো শরীর পূর্ণ খিমার পোশাকে ঢাকা ছিল। স্বামীর কথামতো তিনি মুখেও নেকাব পরেছিলেন। ‘বসার পর আমার স্বামী আমাকে বলেন, এবার আমি মুখের আবরণ খুলতে পারি, কারণ সেখানে আইএসের কোন উপস্থিতি নেই এবং রেস্তরাঁটি পরিবারসহ খাওয়ার একটি একান্ত স্থান। আমিও একগাল হেসে নেকাব সরাতেই রেস্তরাঁ মালিক ছুটে এসে আমার স্বামীকে অনুরোধ করলেন আমি যেন আবার মুখ ঢেকে ফেলি। কারণ আইএস জঙ্গীরা এখানে আকস্মিক পরিদর্শনে আসে এবং আমাকে এভাবে দেখতে পেলে আমার স্বামীকে চাবুক মারা হবে। ‘আমি এরকম গল্প শুনেছি যে, স্ত্রী দস্তানা না পরায় স্বামীকে বেত্রাঘাত করা হয়েছে। এরকম আরেকজন নারীর পিতা-মাতার গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেসব নারী কথা শোনেনি তাদের মারধর ও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আমরা মালিকের অনুরোধমতো কাজ করলাম। আমি ভাবছিলাম, কি অজ্ঞতা ও নির্মমতাই না দেশকে গ্রাস করেছে।’ মরিয়ম নামে একজন খ্রিস্টান স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে আমার বইয়ের বিরাট সংগ্রহ ছিল। কোন বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতজন ইরাক ছেড়ে গেলে তারা তাদের বইয়ের সংগ্রহ আমার কাছে রেখে যেতেন। তারা জানতেন আমি স্থানত্যাগ করব না আর বইগুলোর যতœ নেব।’ ‘আইএসের হাতে মসুল দখল হওয়ার আগে সুন্নি চরমপন্থীরা আমাকে হুমকি দিত ও হয়রানি করত। কিন্তু আমি সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের নারীদের সন্তান প্রসবে সাহায্য করতাম। আমি কখনও রোগীদের মধ্যে বৈষম্য করিনি। আমি বিশ্বাস করতাম সকলেই সমান সেবা পাওয়ার যোগ্য।’ ‘ শেষপর্যন্ত আমাকে মসুল ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। আমি অক্ষত শরীরে পালাতে পারলেও আমার আত্মা ছিল আমার বইগুলোর সঙ্গে। ইরবিলে (ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চল) চলে যাওযার পর আমি মর্মান্তিক খবরটা শুনলাম। আইএস আমার বাড়ি জব্দ করে বাড়িটাকে ‘এন’ (আইএস খ্রিস্টানদের নাসরানি নামে উল্লেখ করে) অক্ষরে চিহ্নিত করেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মসুলে আমার বন্ধুদের টেলিফোন করে বইগুলো রক্ষায় সাহায্য করতে বললাম। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারা আমাকে কলব্যাক করে বলল, আমার সব বই রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছে। অবশ্য, আমার কিছু প্রতিবেশী লুকিয়ে রাখা ু মূল্যবান বই উদ্ধার করতে পেরেছেন।’ ফুটেজে দেখা যায়, মসজিদ ও মাজারগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। বাসিন্দারা জেহাদীদের ইসলামী আইনের ব্যাখার বিরোধিতাকারীদের নির্মম শাস্তিবানের উল্লেখ করেছেন। আইএস মসুল দখলের কয়েক সপ্তাহ পরেই সেখানে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। জায়েদ নামে এক ব্যক্তি উল্লেখ করেন, ‘আইএস নগরীটি দখলের পর থেকে ‘খেলাফতের আইন’ জারি করে। এই আইনে ন্যূনতম শাস্তি চাবুক মারা। ধূমপান করলেও এই শাস্তি দেয়া হয়।’ ‘চুরির শাস্তি হল হাত কেটে ফেলা। পুরুষদের ব্যভিচারের শাস্তি উঁচু ভবনের ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়া আর নারীর ব্যভিচারের শাস্তি পাথর মেরে হত্যা। লোকদের ভয় দেখাতে এসব শাস্তি প্রকাশ্যে কার্যকর করা হয়। শাস্তি প্রয়োগ দেখতে লোকদের বাধ্য করা হয়।’ জায়েদ আরও বলেন, ‘আমি অনেক লোকের কথা জানি যারা আইএসের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। তাদের অনেকে আমার আত্মীয়। অনেককে নিরাপত্তা বাহিনীতে থাকার জন্য হত্যা করা হয়েছে। অন্যদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্তরা কারাগারে আইএসের অকল্পনীয় নৃশংসতার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। অনেকে মুক্তি পেয়ে নির্বাক থেকেছেন। তাদের ভয় ছিল মুখ খুললে হয়তো আবার তাদের গ্রেফতার করা হবে।’
×