ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পার্বত্য এলাকায়ৎ ফলের হাট

এক আনারসে দুই স্বাদ, রাঙ্গামাটিতে যা- ঢাকায় তার উল্টো

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১০ জুন ২০১৫

এক আনারসে দুই স্বাদ, রাঙ্গামাটিতে যা- ঢাকায় তার উল্টো

মোরসালিন মিজান ও মোহাম্মদ আলী আপনি খেলে পরে বুঝবেন, কত মিষ্টি আনারস। কিন্তু তারও আগে মুগ্ধ হয়ে যাবেন ফলটি দেখে। রাঙ্গামাটির আনারস এত সুন্দর! পাকা আনারসের গায়ের রং তো দুধে আলতা! কোথাও ময়লা লেগে নেই। বরং মনে হয় এইমাত্র ফটিক জলে ধুয়ে আনা হয়েছে। বেশি কাঁচা নয়। পাকাও এমন নয় যে, আঙুল দিয়ে চাপলে দেবে যাবে। বাগান খুব কাছাকাছি হওয়ায় বাজারে ওঠার পরও এমন আকর্ষণীয় দেখতে হয় আনারস। আর দেখলে পরে, ইচ্ছে ছিল না, তবু কিনতে হয়। খেতে হয়। আর খাওয়া যখন শেষ হবে, স্বাদ লেগে থাকবে জিহ্বায়! এর রস, মিষ্টি স্বাদ ভোলার নয়। রাঙ্গামাটির একই আনারস প্রতিদিন ট্রাকভর্তি হয়ে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। কাওরান বাজার ভর্তি আনারসে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ঢাকায় যেতে যেতে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। গায়ের রং বদলে যাচ্ছে। স্বাদ হয়ে যাচ্ছে দুটি। রাঙ্গামাটিতে যা, ঢাকায় এর সম্পূর্ণ উল্টো! বলা বাহুল্য, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আনারস হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হয় পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তরুণ ভট্টাচার্যের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ২ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ফলন ২৫.৩০ মেট্রিক টন। দারুণ মিষ্টি আনারসে এখন ভরে উঠেছে স্থানীয় বাজার। মধুমাস জ্যৈষ্ঠের আরও অনেক ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে রাজত্ব আনারসের। শহরের আঁকাবাঁকা রাস্তা। রাস্তা ধরে হেঁটে বা গাড়িতে যাওয়ার সময় কিছুদূর পর পর চোখে পড়ে আনারস। গ্রীষ্মের গরমে ক্লান্ত মানুষ এসব আনারস কিনে ওখানেই খাচ্ছেন। কেউ নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি। তবে রাঙ্গামাটির ফলের হাটে আনারস দেখে চোখ ছানাভরা হয়ে যায়! শহরের কলেজ গেটের সামনে প্রতিদিন বসে ফলের হাট। মঙ্গলবার সেখানে পৌঁছে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে প্রায় আধা কিলোমিটার জায়গাজুড়ে পসরা সাজানো হয়েছে মৌসুমী ফলের। হাট পর্যন্ত যাওয়ার আগেই নাকে মিষ্টি ঘ্রান এসে লাগে। আম আছে। আছে কাঁঠালসহ অন্যান্য ফল। আর হাটের বড় অংশটি আনারসের। লম্বা সারিতে বিক্রেতারা বসেছেন। চাষীরাও নিজের বাগান থেকে বিশেষ ঝুড়ি ভর্তি করে আনারস নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাঙ্গামাটির নানিয়াচর উপজেলার ইসলামপুর, বগাছড়ি, কুতুবছড়ি, বুড়িঘাটে প্রচুর বাগান আছে আনারসের। সদর উপজেলার কাটাছড়ি, সারিখং, বিহারপুর, রাজস্থলীতেও বিপুল পরিমাণে আনারসের চাষ হয়ে থাকে। এসব এলাকার আনারস সকাল হতেই চলে আসে হাটে। হাট ঘুরে প্রধানত দুই ধরনের আনারসের দেখা মেলে। একটি জাত ক্যালেন্ডার বা সিঙ্গাপুরী নামে পরিচিত। ক্যালেন্ডার জাতের আনারস আকারে বড়। তবে সবচেয়ে ভাল জাতটিÑজলডুবি। নামটি যেমন বিখ্যাত। খেতেও খুব সুন্দর। তারও বেশি মিষ্টি স্বাদের। কিন্তু মুখে বললে বিশ্বাস কী? তাই কিনে খাওয়ার উদ্যোগ নিতে হলো। ওখানেই কেটে খাওয়ালেন এক বিক্রেতা। আর তখন দূর হয়ে গেল সব সংশয়। নাম জলডুবি হলেও ভেতরে রস শুধু। খেয়ে বলতেই হলোÑ মধুর মতো! তরতাজা সুন্দর আনারসের দামও অনেক কম। শুনে অনেকে অবাক হবেন, এখানে মাত্র দুই টাকায়ও আনারস কিনে খাওয়া যায়! প্রতিটি আনারস সর্বনিম্ন ২ টাকা থেকে শুরু করে ২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আকার ও জাত অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হয়। এর পরও হাটের পাশে কিছু আনারস নষ্ট হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কেন? জানতে চাইলে ওঠে আসে ফরমালিন প্রসঙ্গ। প্রীতিময় চাকমা নামের এক চাষীর বলেন, আমরা চাষীরা ফরমালিন বা এ জাতীয় কিছু আনারসে ব্যবহার করি না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে পারলে সব ঠিকঠাক। বিক্রি না হলে রং নষ্ট হয়ে যায়। পচে যায়। আমরা বিবর্ণ পচা ফল কাওকে খাওয়াতে চাই না। তিনি জানান, ষাটের দশক থেকে তাঁর আনারস চাষ শুরু। এখনও চাষ করছেন এবং তা খুব যতেœœর সঙ্গে। সদর উপজেলার কাটাছড়ি গ্রামে বিশাল বাগান তাঁর। সেখানে বেশিরভাগ সময় আনারস বাগানের পরিচর্যা করে কাটে। আর ফরমালিন বা এ জাতীয় কিছু একদমই বাগানে ছোঁয়ান না। ফল পাকলে পরেই কেটে বাজারে নিয়ে আসেন। এ কারণেই রাঙ্গামাটির আনারস এত সুন্দর ও স্বাদের হয় বলে জানান তিনি। তাঁর পাশেই দেখা গেল, প্রাকৃতিক উপায়ে সূর্যতাপ থেকে আনারস রক্ষার চেষ্টা। প্রচ- রোদ থেকে বাঁচাতে লতাপাতা দিয়ে আনারস ঢেকে রেখেছেন এক নারী। হ্যাঁ, পাহাড়ী সমাজে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করেন নারীরা। আনারসের বিশাল বিশাল বাগান করা, পরিচর্যা করা, ফল সংগ্রহ করা এবং বাজারে এনে বিক্রি করাসহ প্রতিটি পর্বে তাঁরা অংশগ্রহণ করেন। তেমন একজনের নাম অঙ্গামনি। বয়সে তরুণী। বাংলা তেমন বলতে পারেন না। ভেঙে ভেঙে যা বলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, মেয়েরা বরং পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করে। মেয়েরা যে বাগানের পরিচর্যা করে সে বাগানে আসারস বেশি মিষ্ট হয় বলেও দাবি তাঁর! তবে এসব সুন্দর নষ্ট হয়ে যায় ঢাকায় আসার পথে। রাঙ্গামাটি থেকে রাজধানী শহরে প্রতিদিন যাচ্ছে ট্রাকভর্তি আনারস। তার আগেই ঘটা করে কিছু গ-গোল করেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা। অনেকদিন সতেজ রাখতে আনারসে ফরমালিন নামের আতঙ্কটি মিশিয়ে নেন। ফলে বাগান থেকে কেটে আনার বেশ কয়েকদিন পর পর্যন্ত টাটকা দেখায়। তবে স্বাদ যথেষ্ট নষ্ট হয়ে যায়। ট্রাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া, যাচ্ছেতাইভাবে উঠানো- নামানোর কারণে মøান হয়ে যায় বাইরের চেহারাটিও। নানা রকমের ময়লা গায়ে লেগে যায়। অতিরিক্ত চাপে এখানে ওখানে দাগ পড়ে যায়। এভাবে একই আনারস ভিন্ন চেহারা পায়। রাঙ্গামাটির স্বাদ আর থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। এভাবে একই আনারসের স্বাদ হয়ে যায় দুটি। গুণাগুণও ভিন্ন! ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি বেড়াতে আসা পর্যটক মাত্রই এটি জানেন। হাটে কথা হলো ঢাকা থেকে সদ্য বদলি হয়ে আসা এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে। নাম আজহারুল। একই আনারসের দুই রং রূপ স্বাদ সম্পর্কে তিনি বললেন, আমি এখানে আসার পর আনারস তেমন কিনতে চাইতাম না। দেখলেই মনে হতো ফরমালিন। ঢাকায় যা খেয়ে এসেছি, এখানেও তাই হবে ভেবেছিলাম। তারপর খেয়ে বোঝলাম, পুরো উল্টো। তিনি জানান, আর্মি এবং পুলিশের সদস্যরা এখান থেকে আনারস কিনে ঢাকার বাসায় পাঠান। হ্যাঁ, আসলটা খাওয়ার এই হচ্ছে ব্যবস্থা। রাঙ্গামাটিও আসতে পারেন। আসুন। বহুদূর থেকে আসার কষ্ট লাঘব করে দেবে রাঙ্গামাটির আনারস।
×